করোনা অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে মানুষের জীবনে। কাউকে ধনী করেছে। কাউকে করেছে পঙ্গু। করোনা যেন রোগের নয় দারিদ্র্যের মহামারী লাগিয়েছে। উচ্চবিত্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত। নিম্ন-মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত। আর নিম্নবিত্ত হয়েছে পথের ভিখারি। এই শেষের স্তরটাই মাঝে সাঝে পথেঘাটে দৃশ্যমান হয়। বাকিরা বুকে পাথর চাপা দিয়ে কোনো রকমে দিন পার করছেন। শুধু কোনো ঝড়-ঝাপটা আসেনি ক্ষমতা ও তার আশেপাশে থাকা লোকজনদের। বিস্তারিত দেখুন আওয়ার ইসলামের নিউজরুম এডিটর মোস্তফা ওয়াদুদএর প্রতিবেদনে।।
একটি বেসরকারি কলেজে চাকুরি করতেন প্রফেসর আরমান মাহমুদ। বয়স ৪০। তিনটি সন্তান আছে তার। বাড়িতে নিজের বাবা-মা ও পরিবারের ভরণ-পোষনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার উপর। পড়ানো ছাড়া আর কাজ ছিলো না তার। কলেজ থেকে যে নির্দিষ্ট বেতন পেতেন তা দিয়ে সচ্চলভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিন। কোনোরকমের অভাব চোখে দেখেনি কখনো। কিন্তু গতবছরের মার্চ মাসে বন্ধ হওয়া তার কলেজ খোলেনি এখনও। কলেজ বন্ধের পর মিলেনি কোনো বেতনও। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির লোক হওয়াতে কারো কাছে হাতও পাততে পারেননি আরমান মাহমুদ। আরমান মাহমুদ এখন মুখ ঢেকে রিক্সা চালান। হালাল কাজ করে পরিবার চালান। এখন আর মধ্য আয় নেই। নিম্ন আয়ে সংসার জীবন কেটে যাচ্ছে তার। এক সময়ের প্রফেসর আরমান মাহমুদের মতো আরও যারা সীমিত আয়ের মানুষ। অথবা যাদের কম বেতন এক কথায় তারা এই করোনাকালে সংকটে আছেন। বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে যারা চাকরি করছেন, তারা নানামুখী সমস্যায় ভুগছেন। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন বেসরকারি খাতের কোনও প্রতিষ্ঠানে চাকরির ওপর নির্ভরশীলরা। এরই মধ্যে যাদের কম বেতন, তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকেও অনেকে চাকরি হারিয়ে এলাকায় ফিরে গেছেন।
তবে করোনাকালে উদ্যোক্তা হয়েছেন অনেকেই। অসংখ্য মাদরাসার ছাত্র-উস্তাদ করোনাকালে চাকরি হারিয়ে ব্যবসার পথ ধরেছেন। বেছে নিয়েছেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। কিন্তু কম বেতনে চাকরি করতেন যারা তারা উদ্যোক্তাও হতে পারছেন না। ফলে তারা হয়ত এখন বেকার। না হয় খেয়ে না খেয়ে পার করছেন দিন। দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে সরকারি কর্মচারীরা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। কারণ সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমেনি, বরং বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্ধা এম এ খালেক বলেন, করোনাকালে সবাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে বেসরকারি কর্মচারীরা বেশি সমস্যায় পড়েছেন।
রাজধানীর মানিক নগর এলাকার একটি ১০ তলা ভবনে দারোয়ানের চাকরি করেন মো. জয়নাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে কয়েকজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দেওয়ার কারণে তাকে ভবনের বাসিন্দারা ঠিকমতো বেতন দেয়নি। এখন পর্যন্ত তার ২ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে।’ এতে যে খুব বেশি ভালো নেই তিনি সেটা তার শুকনো চেহারা দেখেই অনুমান করা গেছে।
এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী ও আলেম মাওলানা হারুনুর রশিদ বলেন, ‘করোনার সময়কালে জিনিসপত্রের দাম বেশি ছিল। ওই সময় তার অতিরিক্ত কোনও আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে ঠিকই। এ কারণে দেখা যায়, নিম্ম আয়েরা মানুষেরা পড়েছে বিপদে। আগের চেয়ে তেমন ভালো দিন কাটছে না তাদের।’
করোনায় ঢাকার একটি গার্মেন্ট কারখানা থেকে চাকরি হারানো পাবনা জেলা ভাঙ্গুড়ার সোহেল রানা জানান, চাকরি হারিয়েই তিনি শুরু করেছেন মাছের ব্যবসা। ভোরে আড়ত থেকে মাছ কিনে এলাকার বাজারে বিক্রি করছেন। এতে করে তিনি কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারলেও এখনো উঠে দাড়াতে পারেননি ঢাকার আরেকটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করা দিনমুজুর মো. জুয়েল। লকডাউন চলাকালে বাড়িতে চলে আসার পর চাকরিটা আর ফিরে পাননি তিনি। এতে করে পরিবার নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন মো. জুয়েল।
মুগদা এলাকার বাসিন্ধা এম এ খালেক, রাজধানীর মানিক নগর এলাকার ১০ তলা ভবনে দারোয়ানের চাকরি করা মো. জয়নাল হোসেন, চাকরি হারানো পাবনা জেলা ভাঙ্গুড়ার সোহেল রানাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা ভালো নেই মোটেও। এর সত্যতা অনেকটাই উঠে এসেছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনেও। সেসব প্রতিবেদনে দেশে চাকুরি হারিয়েছে কত শতাংশ মানুষ তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র দেখানো হয়েছে।
যেমন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক যৌথ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ লাখ তরুণ কাজ হারিয়েছে। ‘ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত বছরের আগস্টে প্রকাশ হয়।
অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, করোনার তাণ্ডবে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ মানুষ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। এখানে ৭৪ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন।
তরুণদের চাকরি হারানোর সাতটি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে কৃষি খাতে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ, খুচরা বাণিজ্য খাতে ১২ দশমিক এক শতাংশ, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাতে দুই দশমিক ছয় শতাংশ, অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা খাতে সাত দশমিক চার শতাংশ, নির্মাণ খাতে ১২ দশমিক আট শতাংশ, টেক্সটাইল খাতে ১৩ দশমিক ছয় শতাংশ ও অন্যান্য সেবা খাতে চাকরি হারিয়েছেন চার দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, করোনার কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছে মোট দেড় কোটি মানুষ। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, করোনার কারণে ৮০ শতাংশ যুবকের আয় কমে গেছে।
চাকরি হারানো এসব মানুষেরা ভালো নেই। তারা না পারে কারো কাছে কিছু চাইতে। আর না তাদের প্রতি এগিয়ে আসছে কোনো মানবাধিকার সংস্থা। তারা মুখে চাপা কান্না আর বুকে পাথর বেঁধেই কাটিয়ে দিচ্ছে দিন। সংকটে পড়লেও মুখ খুলে কখনো কারো কাছেই যে কিছু চাওয়ার যোগার নেই। তাই ধৈর্য আর প্রভূর সাহায্যেই এখন তাদের ভরসা। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকগণ।
এমডব্লিউ/