কাউসার লাবিব : সৃষ্টিলগ্ন থেকে সময়ের এক কঠিন চক্রাবর্তের ভেতর আটকা পড়ে আছে এ গ্রহ—পৃথিবী। তখন থেকে অদ্যাবধি একে একে কেটে গেছে বহু শতাব্দী। এর ভেতর মানবজাতি দেখে উঠেছে যুগ-বদলের করুণ কিছু অধ্যায়। জগতের এক অমোঘ বিধানের নাম—‘মানবের কর্মের যথাযথ প্রতিফল’। সকল যুগের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই বিধানেরই কিছু বাস্তব দৃশ্য আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি।
মানবজাতির উন্নতি-অবনতির ইতিহাস, বড় বড় রাজা-বাদশাহর প্রতিষ্ঠা ও পতনের উপাখ্যান, পৃথিবীর প্রাচীন সব মতবাদ কিংবা ধর্মভিত্তিক লড়াইয়ের বিজয়, সফলতা ও অগ্রগতির দাস্তান, সবই মহান আল্লাহর এই অকাট্য বিধানের প্রতিফলন; অবশ্যম্ভাবী বাস্তবায়ন। একটা স্বতঃসিদ্ধ বাস্তব কথা হল—আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতির সম্মিলিত অপরাধ কখনো ক্ষমা করেন না। তাঁর কর্মফল-সংক্রান্ত উল্লিখিত কার্যকরী বিধানটি সকল জাতিগোষ্ঠীর জন্যই সমান।
হিজরি ষষ্ঠ শতকের কথা। এরই ধারাবাহিকতায় তখন মুসলিম উম্মাহর মাঝেও পূর্ণতা পেয়ে যায় তাদের তাবৎ সম্মিলিত অপরাধ। উম্মাহ তখন পারস্পরিক বিক্ষিপ্ততার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ছাড়ে। অন্যদিকে কাফের শাসকরা শুরু করে পুরো ইসলামিবিশ্বকে টুকরো-টুকরো করে ফেলার গোপন পাঁয়তারা।
একদা রাসুল সা. উম্মাহর ‘ঐক্যবদ্ধতা’ বোঝাতে গিয়ে চমৎকার একটি উপমা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—‘টুকরো-টুকরো ইট-সুড়কি নিয়ে যেভাবে গড়ে ওঠে একটি মজবুত সুরম্য প্রাসাদ, হে মুসলমান, তোমাদের সবল-দুর্বল প্রত্যেক সদস্য মিলে তেমনই এক জমাটবদ্ধ সঙ্ঘ; এক অজেয় ঐক্য।’
কিন্তু ষষ্ঠ শতকে এসে এই সঙ্ঘবদ্ধ উম্মাহর ধ্বংস ও বরবাদির যাবতীয় কার্যকারণ সম্পন্নতা পেয়ে যায়। দিন-দিন চারিত্রিকভাবে মুসলিম সোসাইটির অবনতি ঘটতে থাকে। শাসকরা নিমগ্ন থাকেন আরাম-আয়েশ ও হরেক রকমের রঙ-তামাশায়। ফলে ধ্বংসের একেবারে দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছোয় মুসলিমবিশ্ব। তখন কেবল ধপ করে ভূগর্ভে ধসে পড়বার অপেক্ষা।
তবু মহান আল্লাহ ক্রমাগত বিভিন্ন আসমানি মুসিবত পাঠিয়ে মুসলিমদেরকে তাদের পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে তুলতে চাচ্ছিলেন। লাগাতারভাবে পাঠাচ্ছিলেন ঝড়ঝঞ্ঝা, মহামারি ও ভূমিকম্প, যাতে বান্দারা পুনরায় ফিরে আসে তাঁরই চৌকাঠে।
এইসব বালা-মুসিবতের শক্ত ঝটকাতেও যখন মুসলিমবিশ্ব জেগে ওঠেনি, অবশ্যম্ভাবী বিধান হিসেবে নেমে আসে কানুনে ইলাহির এক শক্ত চপেটাঘাত। তা হলো—মোঙ্গলিয়ার জান্তব তাতারদের নারকীয় আগ্রাসন। তাদের এই আগ্রাসন পুরো মুসলিমবিশ্বের অস্তিত্ব একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকাংশ তারা এমনভাবে বিরান করে ফেলে—যেন সারি সারি পোড়োবাড়ি; সর্বত্র লেগে আছে একটি ধ্বংসচিহ্ন, ভগ্নস্তূপের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যে উঠছে ধোঁয়া; বোঝা যায়—এই কদিন আগেও এখানে ছিল মনুষ্যজাতির বসবাস।
তাতার হামলার সময় পর্যটক ইয়াকুত আল-হামাবি খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের মার্ভ শহরে অবস্থান করছিলেন। সে-সময়কার ধ্বংসচিত্রগুলো বড় বেদনাপূর্ণ ভাষায় ছোট্ট একটি পত্রে তুলে ধরেছেন তিনি। লিখেছেন—‘খাওয়ারিজমের এই সবুজ-শ্যামল-নিরাপদ শহরগুলোতে আল্লাহর একদল অবাধ্য হিংস্র পশু ঢুকে পড়েছে। এখানে এখন শাসন চলছে দুশমনদের। এরা সমস্ত পাড়া-মহল্লা মানচিত্র থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, যেভাবে পত্র থেকে মুছে ফেলা হয় ভুল হরফ।
রাজ্যের সর্বত্র পড়ে রয়েছে অজস্র মরদেহ। বাতাসে ভাসছে পচা লাশের গন্ধ। লাশের ওপর উড়ে উড়ে কাক-শকুনের পাল নামছে একের-পর-এক। এখানে কেবল ভল্লুকের গা-ছমছমে আওয়াজ শোনা যায় এখন। সাম্রাজ্যের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে লু-হাওয়ার প্রচণ্ড ঘূর্ণি। কী ভয়াবহ, কী নির্মম!
আমরা দেখছি—ধ্বংসপ্রাপ্ত কাউকে কেউ-একজন সমবেদনা জানাতে গেছে, আর কী আশ্চর্য, কাছে গিয়ে ওই সমব্যথী লোকটিও দুম করে হিংস্র হয়ে উঠছে আচমকা। ভয়ানক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে এ রাজ্য। নারকীয় এই তাণ্ডবলীলায় ইবলিসও হয়তো আজ গাইছে মর্সিয়া-গীতি।’
তাতার আগ্রাসন নিয়ে আল্লামা ইবনুল আসির লিখেছেন—‘পৃথিবীর প্রাচীন ও আধুনিক কোনো ইতিহাসেই তাতারদের আগ্রাসনের কোনো নজির নেই। তাদের পাষণ্ড জান্তবতা ছিল এতই লোমহর্ষক যে, আল্লাহর কসম, আমার এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, পরবর্তীকালের লোকেরা যখন বইয়ের পাতায় এসমস্ত ঘটনা পড়ে উঠবে, এগুলিকে তারা সম্পূর্ণ মিথ্যে ও যুক্তিবিবর্জিত বলে মনে করবে। অর্থাৎ, এই ঘটনাগুলিকে অতিরঞ্জিত কিছু বলতে বাধ্য হবে। তারা যখন একে সুদূরপরাহত কোনো বিষয় বলে ভাববে, তখন এ রচনার প্রতিও যেন দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় যে, আমরা আগেই এমনকিছুর আশংকা করেছিলাম এবং তা লিখেও গিয়েছিলাম।’
সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদবি রহ. লিখেছেন—‘তাতার আগ্রাসন ছিল মুসলিমবিশ্বে নেমে-আসা এক মহাবিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ে ইসলামিবিশ্বের কঠিন অস্তিত্বসংকট দেখা দিয়েছিল। প্রতিমুহূর্তে সন্ত্রস্ত ও শশব্যস্ত ছিল মুসলমান। এক সীমান্ত থেকে অন্য সীমান্ত পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল আতঙ্কে ও হতাশায় ছেয়ে গিয়েছিল। তাতারদের নিরঙ্কুশভাবে অপ্রতিরোধ্য এবং অপ্রতিহত ভাবা হতো—যেন কোনোভাবেই তাদের সাথে মোকাবেলা করা সম্ভব না। তাতাররাও যে পরাজিত হতে পারে তা কারুর যুক্তিতেই ধরত না। এমনকি প্রবাদ হিসেবে মুখে মুখে এই কথা ছড়িয়ে পড়েছিল : ‘কেউ যদি বলে, তাতাররা কোথাও পরাজিত হয়েছে, বিশ্বাস করো না।’
মুসলিমদের এই মাত্রাতিরিক্ত গাফলতির দিনে হঠাৎই মাটি ফুঁড়ে উঠে এলেন রক্ত আর সাম্রাজ্যের নেশায় উন্মত্ত অভিশপ্ত চেঙ্গিজ খান। রক্তচোষার বুভুক্ষা নিয়ে পাশবিক শক্তির নারকীয় তাণ্ডবে মুসলিমবিশ্বের একের-পর-এক শহর তিনি পদানত করতে লাগলেন। বিশ্বজুড়ে হয়ে উঠলেন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ পুরো মানবজাতির জন্য এক জ্বলন্ত আতঙ্ক। ঠিক তখনই, ঐশী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে অমিত তেজে জ্বলে উঠলেন সিংহহৃদয় এক মুসলিম সুলতান। তিনি সকলের কাঙ্ক্ষিত মহাপুরুষ সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ খাওয়ারিজম শাহ রহিমাহুল্লাহ।
তখন এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ মুসলিম সাম্রাজ্য ছিল খাওয়ারিজম। কী আয়তনে, কী প্রাচুর্যে, কী শক্তিতে—সর্বদিক থেকেই অন্যসব সাম্রাজ্য থেকে ছিল বহুদূর অগ্রসর। এ-রাজ্যের অধিপতি ছিলেন সুলতান আলাউদ্দীন মুহাম্মদ খাওয়ারিজম শাহ। সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ খাওয়ারিজম শাহ হলেন তাঁরই গুণধর পুত্র। তাতারিদের নারকীয় আগ্রাসনের মুখগহ্বর থেকে মুসলিমবিশ্বকে উদ্ধার করে তিনি উম্মাহকে দেখিয়েছিলেন প্রতিরোধের প্রথম আলো। সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে তাঁর প্রায় চল্লিশ বছর পর, আইনজালুতের যুদ্ধে, তাঁরই ভাগ্নে সুলতান সাইফুদ্দীন কুতুজ চূড়ান্তভাবে তাতারদের পরাজিত করেছিলেন।
কিন্তু এরও বহু আগে, সুলতান জালালুদ্দীনের হাতে, তাতাররা যে প্রায় সাত-সাতবার অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে, ইতিহাসের ধূসর ক্যানভাসে কিছু প্রতিহিংসাধর্মী পারিপার্শ্বিক কারণে অনালোচিতই থেকে গেছে সুলতানের সংগ্রামমুখর সুকঠিন সেই অধ্যায়। (1)
অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তাই তাতারদের প্রথম পরাজয় বলতে সুলতান সাইফুদ্দীন কুতুজ কর্তৃক আইনজালুতের যুদ্ধে ঘটে-যাওয়া ঐতিহাসিক পরাজয়কেই বুঝে থাকেন। অথচ মধ্য-এশিয়ায় যখন চলছিল তাতার বাহিনীর প্রচণ্ড উদ্দামতার কাল, সেই কঠিন সময়টাতেই সুলতান জালালুদ্দীন তাদেরকে প্রায় সাত-সাতবার পরাজয় খাইয়েছিলেন। তাদের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মুখগহ্বর থেকে মুসলিমবিশ্বের, বিশেষত পবিত্র হারামাইন শরিফাইনের প্রতিরক্ষায় দেখিয়েছিলেন অনন্য জিহাদি অগ্রগামিতা। রাজ্যহারা, সম্বলহীন অবস্থাতেও হিংস্র তাতারদের তিনি ভীষণভাবে নাকানি-চোবানি খাইয়েছিলেন।
বক্ষ্যমাণ ‘খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ গ্রন্থটি অবলম্বনহীন সেই বিপর্যস্ত সময়েরই করুণ গল্পগাথা। জনপ্রিয় ঐতিহাসিক মাওলানা ইসমাইল রেহানের কলমে নির্মোহ সত্যের নিরেট বয়নে ফুটে উঠেছে তাতার হায়নাদের ভয়াবহ আগ্রাসনের সামনে এক দুর্ধর্ষ মুসলিম সুলতানের অমর যশোগাথা। উঠে এসেছে তাতার হামলার মূল কার্যকারণ, পরিণতি ও প্রতিক্রিয়া এবং হিজরি সপ্তম শতকের সময় ও সমাজের নানারূপতা। সপ্তম শতকের অত্যন্ত লোমহর্ষক অধ্যায়গুলোকে উপজীব্য করে, একের-পর-এক শব্দের খোয়া গেঁথে, গড়ে তুলেছেন তিনি ইতিহাসের এক সুরম্য অট্টালিকা।
ইতিহাসে সুলতান জালালুদ্দীনের কীর্তিগাথা এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে ঐতিহাসিকদের কলমের কাছে তা যেরকম বিন্যাস-বিশ্লেষণ আর ব্যাখ্যার দাবি রাখত, সেটা তারা প্রদান করেননি। আরব-অনারব ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউই তাঁর জীবনী নিয়ে অদ্যাবধি পূর্ণাঙ্গ কোনো কাজ করে উঠতে পারেননি।
লেখক ইসমাইল রেহান বলেন—‘পামির মালভূমি থেকে নিয়ে কুহেকাফ পর্যন্ত, এবং কাসপিয়ান সাগর থেকে সিন্ধু-তীর পর্যন্ত সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদের জিহাদি অভিযাত্রার এমন-সব কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল, যা খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবির জিহাদের চাইতে কোনো অংশেই কম ছিল না। মুসলিম সুলতান ও বিজেতাদের মধ্যে সুলতান জালালুদ্দীনই হলেন সেই বিরলপ্রজ বাহাদুর, যিনি পৃথিবীর এমন চারটে সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, যারা ছিল পুরো উম্মাহর শক্ত দুশমন।
তিনি মোঙ্গলিয়া থেকে ধেয়ে-আসা তাতার বাহিনীর আক্রমণের মুখে মুষ্টিবদ্ধ যুদ্ধে নেমেছিলেন। তাঁরই খরধার তরবারি হিন্দু রাজাদের হাত থেকে স্বাধীন করেছিল উপমহাদেশের বিপুল-বিস্তৃত এলাকা। তিনি ক্রুসেডারদের সাথেও জিহাদ করেছিলেন। খ্রিষ্টানদের থাবার ভেতর থেকে জর্জিয়াকে বের করে এনেছিলেন এবং প্রথমবারের মতো একে করেছিলেন পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরই তরবারি ঝলসে উঠেছিল অ্যাসাসিনদের খঞ্জরের মোকাবেলায়। ইসলামের এই দুশমনদের তিনি এমনভাবে থেঁতলে দিয়েছিলেন যে, তারা মাথাই ওঠাতে পারেনি বহু শতাব্দীকাল।
আফসোস, তাঁর এই মহান কীর্তির কথা ইতিহাসের পাতায় যত্ন নিয়ে কেউ সংরক্ষণ করেনি। বড় অনীহা দেখানো হয়েছে। উচিত ছিল—তাঁর একনিষ্ঠ জিহাদ আর সুচিন্তিত পদক্ষেপ থেকে উম্মাহর হৃদয়ে আলোকবিভার সঞ্চার করা। তাঁর অসামান্য বীরত্বগাথা এবং প্রতিরক্ষামূলক দুঃসাহসিকতা থেকে গভীর সবক গ্রহণ করা।’
তারপর লেখক এক জায়গায় বলেন—‘দীর্ঘ একটা সময় ধরে আমি এই আশায় ছিলাম যে, সুলতানের জীবন নিয়ে রচিত নতুন অথবা পুরোনো কোনো পূর্ণাঙ্গ বইয়ের সন্ধান হয়তো পেয়ে যাব। আমার কাজটাও তাতে সহজ হবে। কিন্তু সময়ে-অসময়ে বড়-বড় কুতুবখানায় ঢুঁ মেরেও তেমন কোনো বই মেলেনি। এই মহান মর্দে মুজাহিদের জীবন-বৃত্তান্ত নির্দিষ্টভাবে কোনো এক কিতাবে আমি পেয়ে উঠিনি। যেসব গ্রন্থে সুলতান জালালুদ্দীনের আলোচনা এসেছে, সেখানে ভিন্ন কোনো আলোচনার ফাঁকে-ফুঁকে টুকিটাকি এসেছে কেবল। পূর্ণাঙ্গ না, ছেঁড়া-ছেঁড়া কিছু ঘটনা। শুধু তাঁর জীবনী সংরক্ষণই সেসব গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য ছিল না।
ইতিহাসে সুলতান জালালুদ্দীনের সংগ্রামমুখর জীবনযাপন খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও, যে বিন্যাস-বিশ্লেষণ আর ব্যাখ্যার দাবি রাখত ঐতিহাসিকদের কলমের কাছে, সেইসব টুকিটাকি আলোচনায় তার এক সুতোও উঠে আসেনি। আমার মনে তখন আবারও উদয় হলো—হায়, এই মহান মুজাহিদের অসামান্য কীর্তিমালা যদি সুনির্দিষ্ট একটি কিতাবে একসঙ্গে পেয়ে যেতাম!
এত খোঁজাখুঁজির পরেও যখন তেমন কোনো পূর্ণাঙ্গ বই আমার হাতে আসেনি, তখন হঠাৎ-ই একদিন মনে হলো—সুলতানের জীবনীভিত্তিক যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে আমি নিজেই কেন আলাদা একটা বই লিখে ফেলছি না? জানি, শত অযোগ্যতা রয়েছে আমার। রয়েছে পুঁজির স্বল্পতা। তবু সময়ের বিশেষ প্রয়োজন এবং সুলতান জালালুদ্দীন রহ. এর পক্ষ থেকে অর্পিত গুরুভার ভেবে এই কঠিন কর্মযজ্ঞের বোঝা আমি আমার এই দুর্বল কাঁধেই তুলে নিয়েছি।’
বহুকাল ধরে সুলতান জালালুদ্দীনের পক্ষ থেকে তাঁর জীবনী সংরক্ষণের যে গুরুভার উম্মাহর কাঁধে বর্তে ছিল, উর্দুভাষী ঐতিহাসিক মাওলানা ইসমাইল রেহান সুদীর্ঘ এক যুগের নিবিড় অধ্যবসায়ের ভেতর দিয়ে সেই গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে উঠতে পেরেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এক্ষেত্রে আমাদের তিনি জানাচ্ছেন—‘তখন শাওয়াল মাস, হিজরি ১৪১৮। ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ। হঠাৎ একদিন পরম করুণাময়ের নামে লিখতে বসে গেলাম আমি—বিগত আট শতাব্দী ধরে উম্মাহর আহলে ইলমদের উপর বর্তে ছিল যার মহা দায়ভার।
মুসলিমবিশ্বের প্রতিরক্ষায় সুলতান জালালুদ্দীনের সুমহান কীর্তিগাথাকে উপজীব্য করে সাজানো এই বিষয় ছিল খুব গভীর, অত্যন্ত বিস্তৃত। ফলে, কালের শক্ত আবরণ ভেদ করে প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনতে গিয়ে এমন অনেক বিষয় আমার সামনে এসে গিয়েছিল, যেগুলো হয়ে উঠেছিল দ্বিগুণ তাহকিক আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবিদার। মহান আল্লাহর বড় মেহেরবানি ও সাহায্য যে, আমার মতো এক অযোগ্য লোকের হাতে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে এই কাজটি সম্পন্নতা পেয়েছে। তাঁর অপার কৃপা না-হলে এ কাজে আবর্তিত কঠিন-কঠিন সমস্যা উৎরে যাবার ক্ষমতা আমার ছিল না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ফজল ও করমে, ১৪১৮ হিজরির শাওয়াল মাসে (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮) গৃহীত এ-কাজ ১৪৩১ হিজরির পবিত্র রমজানে (আগস্ট, ২০১০) পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে।’
সুলতান জালালুদ্দীন খাওয়ারিজম শাহকে নিয়ে আমাদের বাংলা ভাষাতেও এ পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ বই চোখে পড়েনি। তবে বড় আনন্দের কথা—মাওলানা ইসমাইল রেহান প্রণীত ‘খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ প্রকাশের মাধ্যমে এবার সেই ঘাটতি পূরণ করতে চলেছে সময়ের আলোচিত প্রকাশনা-সংস্থা নাশাত পাবলিকেশন। নাশাতের এই খেদমত আল্লাহ কবুল করুক।
লেখক সম্পর্কে
মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল রেহান দীর্ঘদিন ধরে জামিয়াতুর রশিদ করাচির ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করে আসছেন। ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়ে ইতোমধ্যে তাঁর বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে বোদ্ধামহলে। তাঁর রচনার দারুণ এক বৈশিষ্ট্য হলো—ইতিহাসের সুকঠিন অধ্যায়গুলোকে প্রাঞ্জল গদ্যে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করে যান তিনি। ‘খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের ইতিহাস’ গ্রন্থটি তাঁর উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সৃষ্টি।
বই সম্পর্কে
পুরো বইটি তিনি দুখণ্ডে লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথম খণ্ডকে বলা যায় দ্বিতীয় খণ্ডের একটা ভূমিকার মতো। মানে, এতো চমৎকারভাবে তিনি একদম গোড়া থেকে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সুতো ধরে টান দিয়েছেন যে, পাঠকরা ইতিহাসের দীর্ঘ একটা জার্নি আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত যেতে যেতে দেখে উঠতে থাকে যে, চোখের সামনে তাদের ছায়াছবির মতো উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে তখনকার ও এখনকার ইসলামিবিশ্বের সমস্ত হালচাল। এতে করে উম্মাহর ব্যক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্ম ও পরিণতি সম্পর্কেও মনে জেগে উঠছে গভীর এক সচেতনতা-বোধ।
এ ব্যাপারে লেখকের বক্তব্য হলো— ‘আমার মনে হয়েছে, ইতিহাসে সুলতান জালালুদ্দীনের সঠিক অবস্থান কেমন, পাঠকরা তা ততক্ষণ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর উদ্দাম অভিযাত্রার সুকঠিন অধ্যায়গুলো জেনে না-উঠবে পুরোপুরি।
ফলত, এই প্রয়োজনবোধেই বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি আমি দুখণ্ডে লিখেছি। প্রথম খণ্ডে বিন্যস্ত করে তুলেছি সেসব প্রাথমিক পটভূমি, যার ছাঁচে ফেলে সুলতানের প্রাণান্তকর মেহনত-মুজাহাদার একটা সুষ্ঠু-সুন্দর বিচার করে উঠতে পারবে পাঠক। বলা যায়, সুলতান জালালুদ্দীনের জীবনকীর্তির একপ্রকার ভূমিকাই প্রথম খণ্ড। এতে বিভিন্ন ঘটনার প্রাসঙ্গিক বর্ণনায় ফাঁকে-ফুঁকে তাঁর জীবনচিত্রের টুকটাক ঝলক ফুটেছে মাত্র।
আর দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পঙক্তিই সুলতানের দুর্ধর্ষ জিহাদি অভিযাত্রার গল্প বলা আরম্ভ করে দেয়। একদম তাঁর ক্ষমতাগ্রহণ থেকে শাহাদাত পর্যন্ত যাবতীয় আখ্যানের বর্ণনা চলে এসেছে তাতে।’ প্রথম খণ্ডে রয়েছে মোট ১২টি অধ্যায়। এ খণ্ডের পটভূমি সুলতান আলাউদ্দীন মুহাম্মদের ৫৯২ হিজরির ক্ষমতাগ্রহণের আরও আগ থেকে আরম্ভ করে আলাউদ্দীনের মৃত্যু পর্যন্ত সময়। এই দীর্ঘ সময়ের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ খণ্ড। কালের পরিধিতে এই সময়টা মোটামুটি বড় একটা পর্যায় এবং একটি জনগোষ্ঠীর বিপর্যয়ের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। এর ভেতর সংঘটিত হয়ে গেছে মর্মান্তিক নানা ঘটনা। সেসব ঘটনার অভিঘাতে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের পৃথক একেকটি অধ্যায়। প্রথম খণ্ড হলো এই সময়টারই দারুণ এক শিল্পিত শব্দরূপ।
দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পঙক্তি থেকেই মুখ খুলতে আরম্ভ করে সুলতান জালালুদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযাত্রার গল্পের ঝাঁপি। চোখের সামনে এক-এক করে ঘটে যেতে থাকে রাজ্যহারা সহায়-সম্বলহীন এক সুলতানের অগণিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ঘোড়ার পদাঘাতে ওঠা ধুলোর মেঘের ঝাপসা আঁধারে হারিয়ে যায় মধ্য-আকাশেরও গনগনে সূর্য, সেপাইদের গলগলে রক্তস্রোতে পিছলে যেতে থাকে ঘোড়াদের পা, বারবার বিজয়ের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে উম্মাহর গাদ্দারদের নগ্ন ষড়যন্ত্র, নেমে আসে কতশত আসমানি পরীক্ষা; সেইসঙ্গে রচিত হতে থাকে দীনের জন্য সাম্রাজ্যহীন এক সুলতান ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রাণোৎসর্গের অমর কাহিনিকাব্য।
ইতিহাসের এইসব গলিপথের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে গভীর এক দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে পাঠকের বুক। গা শিউরে-তোলা আপাত-অবিশ্বাস্য গল্পগুলো পড়তে পড়তে জাঁকিয়ে বসে সুতীক্ষ্ণ এক ব্যথাতুর অনুভূতি। মনে হতে থাকে—মগজের ঈষদুষ্ণ কোমল মাংসে যেন কেউ এসে সূক্ষ্ম একটা আলপিন বসিয়ে দিয়েছে।
শেষে, লেখক তাঁর পাঠকদের এমন একটা অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়ে দেন, যেখান থেকে তাদের চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকে নিরালম্ব ঝুলে থাকে হিজরি সপ্তম শতকের তাতার-তাণ্ডব ও মুসলিমবিশ্বের করুণ পরিণতির ছায়াছবি, তৎসঙ্গে তারা মেলাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে বর্তমান বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীরও প্রকৃত অবস্থান ও তাদের ভবিষ্যত পরিণতি।