মোস্তফা ওয়াদুদ
নিউজরুম এডিটর
বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ও নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত পোরশা উপজেলা। শত বছর আগের কথা। চারদিকে শুধু বিভিন্ন গাছগাছড়ার জঙ্গলে ঘেরা। পায়ে হেঁটে চলাই ছিল সে সময়ের একমাত্র উপায়। পায়ে হেঁটে চলতেই নেমে যেত সন্ধ্যা। ছিল চোর-ডাকাতের উপদ্রব। মুসাফিররা সন্ধ্যা নামলেই খুঁজতেন আশ্রয়স্থল। এখানে তেমন কোনো আবাসিক বাসভবন না থাকায় কারো ভাগ্যে জুটত নিরাপদ আশ্রয়, আবার কারো ভাগ্যে জুটত ভোগান্তি।
মানুষের এমন ভোগান্তি আর কষ্টের কথা চিন্তা করে প্রায় শত বছর আগে তৎকালীন পোরশা গ্রামের জমিদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ তৈরি করেছিলেন মুসাফিরদের রাত যাপনের জন্য একটি মাটির ঘর। আর তিনি এই মাটির ঘরটির নাম দিয়েছিলেন মুসাফিরখানা। বিভিন্ন স্থান বা গ্রাম থেকে পোরশায় আশা মানুষ বিপদে আপদে যেন এখানে আশ্রয় পান। খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ নিজ অর্থে মুসাফিরখানায় আশ্রয়গ্রহণকারীদের জন্য খাবারেরও ব্যবস্থা করতেন। আর এটি সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিচালনার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠানটির নামে ওয়াকফ্ করে দিয়েছিলেন ৮০ বিঘা জমি। তখন থেকেই ৮০ বিঘা জমি থেকে আয়কৃত অর্থ দিয়ে মুসাফিরখানার যাবতীয় খরচ চালানো হচ্ছে।
বর্তমানে মানবদরদি খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ বেঁচে নেই। আছে তার প্রতিষ্ঠিত মুসাফিরখানাটি। উন্নত রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এ যুগেও টিকে রয়েছে নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার পোরশা গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত এ মুসাফিরখানা। এখন আর নেই মাটি দিয়ে নির্মিত ঘরটি। বর্তমানে এটি একটি সুউচ্চ অট্টালিকায় পরিণত হয়েছে। আগের মতোই দূর-দূরান্ত থেকে আশা মুসাফির বা পথিকদের স্বাগত জানানো হয় এখানে। আর মুসাফিরখানাটি পোরশা গ্রামের প্রাণকেন্দ্র মিনা বাজারে অবস্থিত। বাজারের প্রধান রাস্তার সাথে লাগানো পূর্ব-পশ্চিম লম্বা দোতলা ভবন। ভিতরে প্রবেশের আগেই রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা।
এখানে একসাথে ৬০ জন মুসাফির দিন বা রাত্রি যাপন করতে পারবেন। এদের সবার বিনামূল্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ মারা যাওয়ার পর সিরাজুল শাহ্ চৌধুরী মুসাফিরখানা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে তার অপারগতায় বর্তমানে পোরশা আল জামেয়া আল আরাবিয়া দারুল হেদায়া মাদরাসার মহাপরিচালক আলহাজ মাওলানা শাহ্ শরিফুদ্দীন চৌধুরী পরিচালনা করছেন। এখানে একটি শক্তিশালী কমিটি ছাড়াও একজন ম্যানেজার ও একজন কর্মচারী মুসাফিরখানাটি দেখভাল করেন।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পরে তৎকালীন বাদশা আলমগীরের আমলে ইরান থেকে হিজরত করতে বাংলাদেশের বরিশালে আসেন কয়েকজন শাহ্ বংশের মুরব্বি। এদের মধ্যে ফাজেল শাহ্, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ্, ভাদু শাহ্, মুহিদ শাহ্, জান মোহাম্মদ শাহ্, খান মোহাম্মদ শাহ্ অন্যতম।
পরবর্তীতে বরিশাল থেকে তারা আসেন বর্তমান পোরশা নামক গ্রামে। যদিও সে সময় এখানে কোনো বসতবাড়ি ছিল না। চারিদিকে ছিল শুধু বন-জঙ্গল। তারপরেও এলাকাটি ভালো লাগায় তারা এখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। এখানে বসবাস করার সুবাদে এই এলাকার জমিজমা নিয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানে জমিদারি করেন। তাদেরই বংশধর খাদেম মোহাম্মদ শাহ্ যিনি এই মুসাফিরখানাটি নির্মাণ করেছিলেন।
মুসাফিরখানা পরিচালনা কমিটির প্রধান আলহাজ মাওলানা শাহ্ শরিফুদ্দীন চৌধুরী জানান, ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৮০ বছর মাটির ঘরেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। পরে ১৯৮৮ সালে মুসাফিরখানার জমি হতে আয় দিয়েই বর্তমান ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে আমাদের এ এলাকায় কোনো আবাসিক হোটেল না থাকায় প্রতিদিন এখানে মুসাফির হিসেবে অনেক মানুষ থাকেন। আমরা তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি। তবে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় রমজান মাসে এখানে আলেম-ওলামাসহ মানুষের ব্যাপক ভিড় হয় বলে তিনি জানান।
এমডব্লিউ/