শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


শোকে কাতর ২০২০: যে আলেমদের হারালাম আমরা!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

২০২০ সালে যারা আমাদের ছেড়ে প্রভূর সান্নিধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ ধারাবাহিক তালিকা উল্লেখ করবো আমরা। মোট ৩২ জন আলেমের জীবনী তিনটি পর্বে উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। ধারাবাহিক তিন পর্বের আজ থাকছে প্রথম পর্ব। এ তালিকার সিরিয়াল জৈষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়। বছরের শেষ দিক (ডিসেম্বর-জানুয়ারি ২০২০) থেকে হিসেব করে সাজানো হয়েছে নিম্মের আয়োজন-মোস্তফা ওয়াদুদ, নিউজরুম এডিটর।।


২০২০। আমুল হুজুন। শোকের বছর। বাংলার শীর্ষ আলেমদের হারানোর বছর। দেশের জনগণের শোকে কাতরের বছর। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ আলেম হারানোর বেদনায় মর্মাহত। কোটি জনতার হৃদয়ের মানুষগুলো বিদায় নিয়েছে এ বছর।

যারা মানুষকে ডাকতো হকের পথে। শোনাতো কুরআনের বাণী। পৌঁছাতো রাসূলের কথা। যাদের হৃদয়গ্রাহী আলোচনা শুনে দীনের পথ লাভ করতো এদেশের কোটি কোটি মানুষ। হেদায়াতের আলোয় আলোকিত হতো মানুষের চিত্ত-মন-হৃদয় ও অন্তর। কিন্তু এখন থেকে তারা আর কোনোদিন মানুষকে নামাজের জন্য ডাকবেন না। শোনাবেন না হেদায়াতের বাণী। তাদের দরদমাখা নসিহত আর আমাদের কর্ণকুহরে বেজে উঠবে না।

এ বছর দেশের যত আলেমরা বিদায় নিয়েছেন। বাংলাদেশ জন্মের পর এক বছরে এতো আলেম কখনোই বিদায় নেয়নি। বছরের প্রথম থেকেই শুরু হয় আলেমদের মৃত্যু মিছিল। কিন্তু শেষ অবধি এ মিছিলের সারি এতো লম্বা হবে! তা হয়তো বছর শুরুর প্রারম্ভে কেউই ভাবেনি। আমরা হিসেব করে দেখেছি সারাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় ৩২ জন বিখ্যাত আলেমেদীন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। পাড়ি দিয়েছেন আসল বাড়িতে। ‘মাউতুল আলিম মউতুল আলম’-একজন আলেমের মৃত্যু মানে একটি পৃথিবীর মৃত্যু। ২০২০ সালের ক্যালেন্ডারের লাল দাগ দেয়া তারিখগুলো আমাদেরকে আরবি বহুল শ্রুত এই প্রবাদ কথাটিই মনে করিয়ে দেয়।

০১. হাজী সাহেব হুজুরখ্যাত আরজাবাদের হাফেজ তাজুল ইসলাম রহ. (১৯৬০-২০২০)

জামিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদরাসার হিফজ বিভাগের সাবেক প্রধান শিক্ষক ‘হাজী সাহেব হুজুরখ্যাত’ হাফেজ তাজুল ইসলাম রহ. মারা গেছেন। গত ২৫ ডিসেম্বর’২০ (শুক্রবার) সকাল ৬ টায় ফজরের নামাজ পড়ার পর ইন্তেকাল করেছেন তিনি। মিরপুর ৯নং ওয়ার্ড গোলারটেক ঈদগাহ ময়দানে বাদ জুমা জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় তার। জানাজার ইমামতি করেন তার ছেলে হাফেজ মাওলানা সালিম আহমাদ। হাফেজ তাজুল ইসলাম রহ. দীর্ঘ ২০ বছর যাবত আরজাবাদ মাদরাসার হেফজ বিভাগে অত্যান্ত সুনামের সাথে পড়িয়েছেন।

০২. উজানীর শায়খুল হাদিস মাওলানা রশীদ আহমাদ রহ. (১৯৫৫-২০২০) (লাকসামের হুজুর)

চলতি মাসের ২০ ডিসেম্বর (রোববার) বিকেল পোনে ৪ টায় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন চাঁদপুরের জামিয়া ইসলামিয়া ইব্রাহিমিয়া উজানী মাদরাসার শাইখুল হাদীস, সুপ্রসিদ্ধ বক্তা হজরত মাওলানা রশীদ আহমাদ (লাকসামের হুজুর)। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিলো ৬৫ বছর।

তিনি পুরান ঢাকার নয়াবাজার মসজিদে আয়শার খতীবের দায়িত্বও পালন করেছেন। চাঁদপুরের উজানী মাদরাসায় প্রায় ৩০ বছর শিক্ষকতা করেছেন তিনি।

০৩. বাংলার মাদানী আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী রহ. (১৯৪৫-২০২০)

১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারী মোতাবেক ১৮ আষাঢ় ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ রোজ শুক্রবার বাদ জুমআ কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিনি বাবা-মায়ের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করেন। তার বাবা পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সাথে প্রথমে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাড়ির পাশেই ছিলো স্কুল। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এ স্কুলেই তিনি পড়াশুনা করেন।

তারপর তিনি চড্ডার পাশের গ্রামে কাশিপুর মাদরাসায় ভর্তি হোন। এখানে মুতাওয়াসসিতাহ পর্যন্ত পড়েন। তারপর বরুড়ার ঐতিহ্যবাহী মাদরাসায় ভর্তি হোন। সেখানে হেদায়া পর্যন্ত পড়েন। বর্তমান সময়ের অন্যতম রাহবার আল্লামা তাফাজ্জল হক হবিগঞ্জী সাহেবের কাছে খুসুসীভাবে এ সময় তিনি দরস লাভ করেছেন। (তাঁকে উস্তাদের মর্যাদায় সর্বদা দেখেন তিনি)

বাবার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও তাঁর অগাধ প্রতিভার ফলে উচ্চ শিক্ষার জন্য তখন বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে পাড়ি জমান। কিন্তু ভর্তির নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারায় সাহারানপুর জেলার বেড়ীতাজপুর মাদরাসায় ভর্তি হোন। সেখানে জালালাইন জামাত পড়েন।তারপর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও ইলমী পিপাসাকে নিবারণের জন্য ভর্তি হোন দারুল উলুম দেওবন্দ এ। দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে তাঁর মেধার স্বাক্ষর প্রতিফলিত হতে থাকে। ধারাবাহিক সফলতা তাঁর পদচুম্বন করতে থাকে।

এখানে তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ. এর কাছে বুখারী শরীফ পড়েন। মুরাদাবাদী রহ. এর অত্যান্ত কাছের ও স্নেহভাজন হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ফলে অল্প সময়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাকমীল জামাত পড়ার পর আরো তিন বছর বিভিন্ন বিষয়ের উপর ডিগ্রি অর্জনে ব্যাপৃত থাকেন। এ সময় তাকমীলে আদব, তাকমীলে মাকুলাত, তাকমীলে উলুমে আলিয়া সমাপ্ত করেন।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী দা.বা. তার ছাত্র জীবনে তখনকার সময়ের যুগশ্রেষ্ট উস্তাদদের কাছে দরস নেয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন মাওলানা সায়্যিদ ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী, মাওলানা মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী, মাওনানা শরীফুল হাসান, মাওলানা নাসির খান, মাওলানা আব্দুল আহাদ, মাওলানা আনজার শাহ, মাওলানা নাঈম সাহেব, মাওলানা সালিম কাসেমী রহ.সহ বিশ্ববরেণ্য ওলামায়ে কেরামের কাছে তিনি দরস লাভ করেন

দীর্ঘ ২৭ বছর যাবৎ অর্জিত জ্ঞানকে প্রচারের নিমিত্তে তার উস্তাদ মাওলানা আব্দুল আহাদ রহ. এর পরামর্শে হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী রহ. এর প্রতিষ্ঠিত মুজাফফরনগর শহরে অবস্থিত মুরাদিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। মুরাদিয়া মাদরাসায় ১ বছর শিক্ষকতা করার পর মাতৃভূমির টানে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

দেশে এসে সর্বপ্রথম শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদরাসায় শায়খুল হাদীস ও মুহতামীম পদে যোগদান করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসায় যোগদান করে চারবছর সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে শিক্ষকতা করেন। এ সময় তিনি অনেক মেহনতী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও দেশদরদী ছাত্র তৈরি করেছিলেন।

ফরিদাবাদে দীর্ঘদিন পর্যন্ত দারুল ইকামার দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ১৯৮২সালে চলে আসেন কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ. প্রতিষ্ঠিত জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে। এখানে অত্যান্ত দক্ষতার সাথে তিরমিজি শরীফের দরস দান করেন। এখানে ৬ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৮ সাল থেকে অধ্যাবধি পর্যন্ত অত্যান্ত যোগ্যতা ও মেহনতের সাথে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা এবং ১৯৯৮ সাল থেকে অধ্যাবধি জামিয়া সুবহানিয়ার শায়খুল হাদীস ও মুহতামীমের দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন।

২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সাথে তিনি আল হাইআতুল উলয়ার সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি ছিলেন।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেব কিশোর বয়স থেকেই ইবাদাত প্রিয়। ইসলামী বিধিবিধানের প্রতি তার ঝোঁক বরাবর অবাক করার মতো। এ বৃদ্ধ বয়সে হুইল চেয়ার দিয়ে চলাচলকারী এ মানুষটি যেভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে নামাজ আদায় করেন তা যে কাউকে বিস্মিত করে।

তিনি শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. এর কাছে প্রথমে বায়আত হোন। তার সাথে রমজানে ইতেকাফ করেন। তখন তিনি মুরাদিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনা করাতেন।

তার ইন্তেকালের পর মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ. এর হাতে পুনরায় বায়আত হোন। এরপর ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। মালিবাগ জামিয়ায় ইতেকাফ করেন। ইয়ারপোর্ট মাদরাসায় অবস্থান কালে তার কাছ থেকেই ১৯৯৫সালে খেলাফত লাভ করেন।

আল্লামা কাসেমী একজন দেওবন্দী মাসলাকের আলেম। সর্বদা সুন্নাতের অনুসরণ ও আকাবির আসলাফের দেখানো পথে চলেন। সাদাসিধে জীবন তার ঐকান্তিক ব্রত। রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীসের খেদমাত আর সমাজে ইলমে দ্বীন পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বদা মগ্ন থাকেন এ রাহবার। কালক্রমে তিনি এখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত। তার কাছে হজার হাজার মানুষের মুরীদ হওয়ার চাহিদা এবং অনেক পীড়াপীড়ির পরও তিনি বিষয়টিকে এড়িয়ে যান। কাউকে মুরীদ বানাতে আগ্রহী দেখানোতো অনেক দূরের বিষয়। তবে তার কাছে কেউ মুরীদ হতে এলে তিনি মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ. এর জানেশ্বীন মুফতি ইব্রাহীম আফ্রিকী দা.বা. এর কাছে পাঠিয়ে দেন।

প্রচারবিমূখ এ আধ্যাত্মিক রাহবার আল্লামা কাসেমী তেমন কাউকে খেলাফত দেননি। তিনি খেলাফত লাভ করেছেন প্রায় ২০ বছর পূর্বে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে মাত্র ৩ জন আলেমকে খেলাফত দিয়েছেন। তারা হলেন গাজীপুরের মাওলানা মাসউদুল করীম, সৈয়দপুরের মাওলানা বশির আহমদ ও মানিকনগরের মাওলানা ইছহাক।

রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি আকাবিরদের রেখে যাওয়া সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে যুক্ত। ১৯৭৫ সাল থেকেই তিনি জমিয়তের একনিষ্ঠ সক্রিয় কর্মী। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘকাল জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক মরহুম মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী রহ. এর নেতৃত্বে সকল আন্দোলনে শরীক থাকতেন। জমিয়তে তাঁর মাধ্যমেই যোগদান করেছিলেন। ১৯৯০ সালে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের গত ৭ নভেম্বর ২০১৫ ইংরেজী রোজ রবিবার জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এবং নিজস্ব মেধা, দক্ষতা ও পরামর্শের মাধ্যমে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের আলোচিত অরাজনৈতিক সংগঠন খতমে নবুওয়াত আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

বর্তমানের আলোচিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরীর সম্মানিত সভাপতির দায়িত্বভার তাঁর উপর ন্যস্ত করা হয়। তিনি অত্যান্ত সূচারুরুপে অতীতের সকল দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে এসেছেন। বর্তমানেও প্রচুর শ্রম ও মেধা খাটিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সবগুলো ইস্যুতে চমৎকারভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি যেসব বিষয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তাতে সফলতা তার পদচুম্বন করেছে।

মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. পারিবারিক জীবনে ২ ছেলে মাওলানা যুবায়ের হুসাইন ও মাওলানা জাবের কাসেমী এবং দুই মেয়ের জনক ছিলেন।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ১৩ ডিসেম্বর বেলা ১ টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৪ ডিসেম্বর জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমে জানাযা শেষে টঙ্গীতে তার প্রতিষ্ঠিত সুবহানিয়া মাদরাসায় তাকে দাফন করা হয়।

০৪. আল্লামা ইমদাদুল হক হবিগঞ্জী রহ. (১৯৪১-২০২০)
বাংলাদেশের জাতীয় ঈদগাহের সাবেক ইমাম শায়খুল হাদিস আল্লামা ইমদাদুল হক হবিগঞ্জী ইংল্যান্ডের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। গত ৬ ডিসেম্বর’২০ দিবাগত রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর। তিনি আল্লামা তাফাজ্জল হক হবিগঞ্জী রহ. এর আপন ভাই ছিলেন।

০৫. গোলাম সারোয়ার সাঈদী রহ. (১৯৬৬-২০২০)
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার আড়াইবাড়ি আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ, পীরসাহেব গোলাম সারোয়ার সাঈদী ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ২১ নভেম্বর’২০ ভোররাত ৪টা ২০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৫২ বছর।

০৬. ফেনীর মুফতি রহিম উল্লাহ কাসেমী রহ. (১৯৪৯-২০২০)

হেফাজতে ইসলামের নবনির্বাচিত সহকারী মহাসচিব, গুণকবাবুপুর দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও ফেনীর লালপোল সোলতানিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস, মুফতি রহিম উল্লাহ কাসেমী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহির রাজিউন)। গত ২৬ নভেম্বর মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছে ছিল ৬৯ বছর।

০৭. মাওলানা আবুল কাশেম রহ. ফেনী জেলা হেফাজতে ইসলামের আমীর (১৯৫১-২০২০)

গত ১৮ অক্টোবর (রোববার) ইন্তেকাল করেছেন ফেনী জেলা হেফাজতে ইসলামের আমীর ও জহিরিয়া মসজিদের খতিব মাওলানা আবুল কাশেম। রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। মাওলানা আবুল কাশেম জীবদ্দশায় ফেনী পৌর ইমাম কমিটির সভাপতি ছিলেন। এর আগে দীর্ঘদিন তিনি ফেনী কোর্ট মসজিদের খতিব ছিলেন।

০৮. হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. (১৯১৫-২০২০)

উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন, বাংলাদেশের ইসলামি শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন শাহ আহমদ শফী; যিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী বা আল্লামা শফী নামেও পরিচিত। একাধারে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা সমূহের শীর্ষ সংগঠন আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া এর চেয়ারম্যান, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি, হেফাজতে ইসলামের আমির, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী চট্টগ্রাম মাদ্রাসার দীর্ঘ দিনের সম্মানিত মহাপরিচালক। তিনি ১৯১৫ সালে, মাতান্তরে আনুমানিক ১৯২০ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বরকত আলী ও মায়ের নাম মেহেরুন্নেছা।

শাহ আহমদ শফী রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। তারপর তিনি হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করার পর ১৯৪১ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্তি হন এবং চার বছর অধ্যয়ন করেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন আহমদ মাদানির সংস্পর্শে আসেন এবং তার কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভ করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. কাছে বুখারি, শায়েখ ইবরাহীম বেলওয়াবি রহ. এর কাছে মুসলিম, শায়েখ এজাজ আলী রহ. এর কাছে আবু দাউদ, শায়েখ ফখরুল হাসান রহ. এর কাছে নাসায়ী, জহুরুল হক দেওবন্দী রহ. এর কাছে মুয়াত্তায়ে মালেক এবং শায়েখ আব্দুজ জলিল রহ. এর কাছে মুয়াত্তায়ে মুহাম্মাদ এর দরস গ্রহণ করেন।

আল্লামা আহমদ শফী ১৯৪৬ সালে দেওবন্দ থেকে ফিরে বাড়িতে যাননি। সরাসররি এসে উপস্থিত হন দারুল উলুম হাটহাজারীতে। মাদরাসার তৎকালীন মুহতামীম শাহ আবদুল ওহহাব সাহেব রহ. তাকে বললেন, ‘হাটহাজারী থাকবে?’ আহমদ শফী বললেন, ‘আপনি বললে থাকবো।’ তারপর তিনি দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষকতা শুরু করেন। হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম ছিল–পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কাউকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো। আগে কোথাও শিক্ষকতা করেছে এমন। কিন্তু আহমদ শফী ছিলেন একমাত্র শিক্ষক, যার পূর্ব অভিজ্ঞতা তালাশ করা হয়নি। শিক্ষা শেষ করার পর সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

১৪০৭ হি./১৯৮৬ সালে মাদরাসার মজলিশে শুরা তাকে মহাপরিচালক বা মুহতামিম নিযুক্ত করে। পরবর্তীতে তিনি মাদরাসাটির শায়খুল হাদিসের দায়িত্বও পান। তার পরিচালনার সময়ে তরতর করে উন্নতি হয় মাদরাসার। শিক্ষাগত এবং কাঠামোগত–দুটো ক্ষেত্রেই। তার পরিচালনার সময়েই মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষাচুক্তি হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী হাটহাজারী মাদরাসার সার্টিফিকেট দিয়ে কেউ চাইলে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে।

২০০৮ সালে শাহ আহমদ শফী কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি কওমি মাদরাসাগুলোর সরকারি স্বীকৃতির দাবিতে অনুষ্ঠিত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল সুদীর্ঘকালের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের (আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ) সমমান ঘোষণা করেন। তখন আইন অনুসারে কওমি মাদরাসার ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ গঠন করা হয়। এ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও আহমদ শফীর উপর ন্যস্ত করা হয়।

২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে মাদরাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। দুপুর থেকে এ আন্দোলন শুরু হয়, রাত্রে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা হয় এবং পরদিন আহমদ শফী পদত্যাগ করেন।

বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রভাব রাখা আলেমদের একজন ধরা হয় আল্লামা শফীকে। দেশে অনসৈলামিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ও নাস্তিকদের শাস্তির দাবিতে তাঁর ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রভাব তৈরি করে। তিনি ১৯ জানুয়ারি ২০১০ সালে হাটহাজারী মাদরাসার এক সম্মেলনে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালে দেশে নাস্তিক্যবাদী তৎপরতায় মুসলিম জনসাধারণের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেলে একটি খোলা চিঠি লিখে জাগরণ সৃষ্টি করেন আল্লামা আহমদ শফী । ৬ এপ্রিল ২০১৩ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইসলাম ও মহানবী সা.-এর কটূক্তিকারীদের বিচারের দাবিতে ঢাকায় বৃহত্তম সমাবেশ হয়। অতঃপর ৫ মে ঢাকাসহ পুরো দেশ অবরোধ করা হয়।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকদিন। ভারতে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ, ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের প্রতিবাদ, তাসলিমা নাসরীন খেদাও আন্দোলনসহ সরকারের ফতোয়া বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে তৎকালীন সময়ে আল্লামা শফি ছিলেন প্রথম সারিতে।

স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে পারিবারিক জীবন গড়েন আল্লামা আহমদ শফী। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক তিনি। বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ পাখিয়ারটিলার মাদরাসার পরিচালক। ছোট ছেলে মাওলানা আনাস হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। মেয়েদের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে পাত্রস্থ করেছেন।

আল্লামা শফী ছিলেন ঊর্দু, ফার্সি, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষায় একজন সুদক্ষ পণ্ডিত। তিনি বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে ৯টি বই রচনা করেছেন।

তার রচিত বাংলা বইগুলো হলো–হক্ব ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, ইসলামী অর্থব্যবস্থা, ইসলাম ও রাজনীতি, ইজহারে হাকিকত, মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম, সত্যের দিকে করুণ আহ্বান, ধূমপান কি আশীর্বাদ না অভিশাপ, একটি সন্দেহের অবসান, একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া, তাবলিগ একটি অন্যতম জিহাদ, ইছমতে আম্বিয়া ও মিয়ারে হক, সুন্নাত-বিদআতের সঠিক পরিচয়, বায়আতের হাকিকত।

তার রচিত উর্দু বইগুলো হলো–আল বয়ানুল ফাসিল বাইনাল হককে ওয়াল বাতিল, আল হুজাজুল ক্বাতিয়াহ লিদাফয়িন নাহজিল খাতেয়াহ, আল খায়রুল কাসির ফি উসুলিত তাফসির, ইসলাম ওয়া ছিয়াছত, তাকফিরে মুসলিম, চান্দ রাওয়েজাঁ, ফয়ুজাতে আহমদিয়া, সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফয়জুল জারি ও মিশকাতুল মাসাবিহের ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

১৯ আগস্ট ২০০১ সালে ওমরা পালনকালে হারামাইন শরিফাইনের মহাপরিচালক শায়খ সালেহ বিন আল হুমাইদ পবিত্র কাবার গিলাফের একটি অংশ উপহার প্রদান করেন। ২০০৫ সালে জাতীয় সিরাত কমিটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে সম্মাননা ও স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তাঁকে নানা সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে শাহ আহমদ শফী বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।

পরদিন হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তার বড় ছেলে ইউছুফ মাদানি। স্থান সংকুলান না হওয়ায় তার লাশ ডাকবাংলোতে নিয়ে আসা হয়। পুরো হাটহাজারীর সব প্রবেশ পথে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিতে প্রশাসন বাধ্য হয়। ৪ উপজেলায় ১০ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ এবং ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়। জানাযা শেষে তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বায়তুল আতিক জামে মসজিদের সামনের কবরস্থানে দাফন করা হয়। মিডিয়া এটিকে বাংলাদেশের স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাযা বলে অবহিত করে।

০৯. মাওলানা আবুল হাসান রহ.

৫ জুলাই রোববার ইন্তেকাল করেছেন হেফাজতে ইসলাম কক্সবাজার জেলা সভাপতি, জোয়ারিয়ানালা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আবুল হাসান রহ.। তিনি বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগছিলেন।

১০. মাওলানা নুরুল ইসলাম হাশেমি রহ.
গত ২ জুন ভোরে না ফেরার দেশে চলে যান দেশের আলেম, শায়খুল হাদিস আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমি রহ.। তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক একটি বিশেষ শ্রেণির একজন জনপ্রিয় আলেম ছিলেন।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ