মোস্তফা ওয়াদুদ: ভারসাম্যপূর্ণ ও অল্পেতুষ্টের মেসদাক ছিলেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ.। বর্তমান জামানার একজন জামে’ শখসিয়াত (যোগ্য ব্যক্তিত্ব) ছিলেন তিনি। গতকালের জানাজায় আমরা হুজুরের যে মাকবুলিয়াত দেখলাম। এ মাকবুলিয়াত আওসাফ (গুণাবলি) এর মাধ্যমে আসছে। শুধু মৌখিক বক্তৃতা আর খুব সুন্দর বলতে পারা, কিংবা সাজিয়ে-গুছিয়ে বলতে পারার মাঝে মাকবুলিয়াত আসে না।
সুন্দর কথা ও ভালো ভাষা ভালো এটা মানুষের অন্তরকে আকর্ষণ করে। এটার প্রকাশ মানুষেরা আকল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু রুহের উপরে এর কোনো প্রভাব নেই। যখন মানুষের মাঝে আল্লাহর তাকওয়া থাকবে। তখন মানুষের কথা রুহের উপরে প্রভাব পড়বে। কিন্তু যদি তাকওয়া না থাকে তাহলে রুহের উপরে কোন প্রভাব থাকে না। সুন্দর কথা বলে এটা চাপাবাজি ছাড়া আর কিছু না। এটার দৌড় মানুষের আকল পর্যন্ত। চাপাবাজির দ্বারা মাকবুলিয়াত হাসিল হয় না।
যদি কথার মাঝে আওসাফ থাকে তাহলে সেটা যদি তত সুন্দরও না হয়, তবুও মানুষের জীবনের মাঝে প্রভাব সৃষ্টি হয়। মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়। মানুষের জীবনের মাঝে একটা ইনক্লাব আছে সে সকল কথার মাধ্যমে।
আমাদের কাসেমী সাহেব রহ. হুজুর কোন ভাষাবিদ ছিলেন না। বলতে কোনো দ্বিধা নেই। তিনি কোনো আরবি সাহিত্যিক, উর্দূ সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু তার কথা শুনলে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতো।
আর হুজুরের যে মাকবুলিয়াত ছিলো সেটার প্রকাশ আজকে আমরা বায়তুল মোকাররমে দেখেছি। বুজুর্গদের মকবুল এর প্রধান কারণ হলো তাদের আওসাফ। আজকে আমরা সকল আওসাফ থেকে সরে গিয়েছি। মুরুব্বীদের দেখানো পথ থেকে সরে এসেছি। আমরা শুধু আলফাজের পিছনে, শব্দের পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছি।
আমাদের ছেলেরা আজকে সাহিত্যের পেছনে দৌড়াচ্ছে, সুন্দর বলতে পারার পেছনে দৌড়াচ্ছে। এটা আসলে কোন আওসাফের বিষয় নয়। আর এটার নাম দেওবন্দিয়্যাতও নয়। হুজুর যেটা করতেন সেটা ছিল মূল দেওবন্দিয়াত। তিনি দেওবন্দিয়াতের হামেল ছিলেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ভারতীয় উপমহাদেশের নাম হল দেওবন্দিয়াত। দেওবন্দিয়াত নতুন কোন বিষয় না। বরং যেটা ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সেটাই হলো মূল দেওবন্দিয়াত। যারা আকাবিরে দেওবন্দ তারা উচ্চ মানের আওসাফের অধিকারী ছিলেন।
হুজুর সম্পর্কে আমি কি বলবো অনেক লম্বা চরা কথা আমি এত কিছু বলতে পারব না তবে শুধু একটা কথা বলি।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ওলামায়ে দেওবন্দের, ওলামায়ে হক এর একটা বড় বড় বৈশিষ্ট্য বা ইমতিয়াজ হলো, ন্যায়পরায়ণতা। আলোচনার ভারসাম্যতা, আকিদার ভারসাম্যতা, আমলের ভারসাম্যতা, আখলাকের ভারসাম্যতা। আচার-ব্যবহারের ভারসাম্যতা। সবকিছুর মাঝে ভারসাম্যতা, মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধ এ জামাতের বৈশিষ্ট্য। অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করা বা ছাড়াছাড়ি করা। অথবা সীমালংঘন করা বা শিথিলতা করা এটা বাতিল এর বৈশিষ্ট্য। আহলে হকের সবকিছু হবে ভারসাম্যপূর্ণ। আমি হুজুরের ভিতর লক্ষ করেছি, তিনি একজন পূর্ণভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থার আলেমে হাক্কানী ছিলেন। গত চার-পাঁচ বছর এর ভিতর হুজুরের যে সকল রাজনৈতিক বক্তব্য, সিয়াসী বক্তব্যগুলো আসছে সে সকল বক্তব্যগুলো যদি আপনারা লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন যে বক্তব্যগুলো ছিল ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যমপন্থার বক্তব্য। বাড়াবাড়িও ছিলো না। আবার শীতলতা বা ছাড়াছাড়িও ছিল না।
বর্তমানে আমরা এসব ভারসাম্যপূর্ণতা থেকে সরে আসছি। আর এ ভারসাম্যপূর্ণতা থেকে সরে আসলে গোমরাহী আসবে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হবে।
হুজুরের ভেতরে ভারসাম্যতা ছিল। হুজুর যদি কারো সমালোচনা করতেন। যারা হুজুরের বিরুদ্ধে আছে। তাদের যদি কখনো কোনো সমালোচনা করতেই হতো। তাহলেও হুজুরের ভাষাটা ছিল অত্যন্ত ভদ্রতাজণিত। অত্যন্ত শালীন ও অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। এমনকি যারা হুজুরের বিরোধী প্রতিপক্ষ যা তাদের সম্পর্কে কোন কথা বলতে গেলেও কখনো একটু বাড়িয়ে বলতেন না। আমরা তো আমাদের বিরুদ্ধে হলে কি করি, যে আবার বিরোধী, যে আমার শত্রু বা যার সাথে আমার শত্রুতা, তার ব্যাপার আমি বাড়িয়ে বলি। যতটুকু না দোষ করেছে তার থেকে বলি। অথচ বাড়িয়ে বলা জায়েজ নাই। এটাতো আদলের খেলাফ। এটাতো ন্যায়পরায়ণতার খেলাফ।
একজন অমুসলিম, একজন ইহুদী, একজন খৃষ্টান বা একজন বেদাতি হোক, তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলার কোন সুযোগ নেই। বাড়িয়ে বলতে পারবোনা। সে যতটুকু করেছে তত টুকুই। হুজুরের মাঝে আমি এটা দেখেছি, হুজুর প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতে গেলেও যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ রক্ষা করে কথা বলতেন। অনেক সময় এমন হয়েছে যে, মঞ্চে হুজুরের সামনে বক্তৃতা হয়েছে, হুজুরের সামনে কথা হয়েছে, তারপর হুজুর যখন কথা শুরু করেছেন, তখন বলেছেন যে, আমি মঞ্চে বর্ণিত সকল কথার সাথে একমত না বা এই সকল কথার সাথে আমি একমত না। এরকম অনেকবার হয়েছে আমি নিজে দেখেছি।
আরেকটা হুজুরের বড় গুণ ছিল, যে হুজুরের মাঝে ছিলো পরহেজগারিতা বা অল্পেতুষ্টতা। যে গুণটাই মূলত হুজুরকে চমকে দিয়েছে। আজকে যে হুজুরের মকবুলিয়াত, এ মকবুলিয়াতের পেছনে যে গুণটা সবচেয়ে বড় কাজ করেছে, সেগুলি হল হুজুরের পরহেজগারিতা। আরেকটা হলো অল্পেতুষ্টতা। আমি মনে করি, এসব গুণের কারণে আজ সারা বাংলাদেশের হুজুরের মকবুলিয়াত ছড়িয়ে পড়েছে।
দুনিয়ার প্রতি হুজুরের মাঝে কোন আগ্রহ ছিল না। দুনিয়াকে হুজুর সবসময় তুচ্ছ মনে করেছেন এবং টাকা-পয়সা হুজুরের কাছে লেদের মতো ছিলো। ঘোড়ার লেদ, গরুর লেদ যেরকম, সে রকমই ছিল তার কাছে টাকা পয়সা।
আর হুজুরের যখন ফুতুহাত এসেছে তখন দেখেছি হুজুর নিজের কাজে টাকা বেশি খরচ করতেন না। বরং টাকা পয়সা দিয়ে মাদ্রাসা, জমিয়ত এবং ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে বিলিয়ে দিতেন। নিজের জন্য নিজের ঘরের জন্য খুব কম টাকা রাখতেন।
দুনিয়ার প্রতি কোন লোভ হুজুরের মাঝে ছিল না। কখনো অন্যের ভালো থাকা বা অন্যের ভালো অবস্থান, এটার প্রতি আগ্রহ কখনোই খুঁজে পাইনি হুজুরের মাঝে।
আজকে হুজুরের দুটি কথা আপনাদের সামনে বললাম। একটি হলো, ভারসাম্যপূর্ণতা আরেকটি হলো অল্পেতুষ্টতা। এই দুটি গুণের কারণে হুজুর এগিয়ে গিয়েছেন। আজকে আমাদের মাঝে এ দুটো গুণ অনেক কমে গেছে।
আজকে আমরা যারা তালিবুল ইলম, আমাদের থেকেও এসব গুণ চলে গেছে। এজন্য সাধারণ মানুষের মোহাব্বত উঠে গেছে আমাদের থেকে। কারণ দুনিয়ার মহব্বত আমাদের ভিতরে ঢুকে গেছেঅ দুনিয়ার লিপ্সা আমাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে।
এজন্য হুজুরের কাছ থেকে শেখার একটা বড় সিফাত হলো এটা যে, হুজুরের কাছ থেকে ভারসাম্যপূর্ণতা ও অল্পেতুষ্টতা শেখা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুক। আর যে সকল ভুল ত্রুটি হয়ে গেছে, মানুষ মাত্রই ভুল। আল্লাহ তায়ালা সে সকল ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিন। আমিন।
এমডব্লিউ/