কাউসার লাবীব: জিকিরের মজলিস কায়েম করে জিকির করা জায়েজ আছে। সাহাবায়ে কেরামগণ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এমন জিকিরের হালকা করার প্রমাণ ভুরি ভুরি পাওয়া যায়। তবে সকলে একসাথে সমস্বরে সুরের সাথে সুর মিলিয়ে কোরাস কণ্ঠের জিকিরের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই এ পদ্ধতির জিকিরকে সুন্নাত বলার কোন সুযোগ নেই।
যদি নির্দিষ্ট কোন হক্কানী পীর সাহেব প্রশিক্ষণ হিসেবে এভাবে জিকির করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তাহলে তা প্রশিক্ষণ হিসেবে করাতে কোন সমস্যা নেই। তা বিদআতের সংজ্ঞায় পড়বে না। কিন্তু এভাবে দলবদ্ধ জিকিরকে সুন্নাহ মনে করলে অবশ্যই তা বিদআত হবে।
তাই জিকিরের হালকা কায়েম করে স্বতন্ত্র স্বরে জিকির করাকে বিদআত বলাটা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়। আর যদি প্রশিক্ষণ হিসেবে সমস্বরেও করে তবুও তা বিদআত হবে না।
হালকায়ে জিকির বা জিকিরের মজলিস কায়েম করে জিকির করা জায়েজ আছে। হাদীসের মাঝে এর অনেক প্রমাণ ও ফযীলত বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-
এক- হযরত আবূ হুরায়রা ও হযরত আবূ সাঈদ রাঃ দুইজনই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন যে, যে জামাত আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকে, ফেরেশতারা উহাকে চারিদিক থেকে ঘিরে নেয়। আল্লাহর রহমাত তাদেরকে ঢেকে নেয়। তাদের উপর সকীনা নাজিল হয়। আর আল্লাহ তাআলা নিজ মজলিসে (গর্ব করে) তাদের আলোচনা করেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৭০০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১১৮৭৫]
দুই- আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে;আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৭৪০৫]
তিন- আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মু’আবিয়াহ (রাযিঃ) মাসজিদে গেলেন। তিনি (মাসজিদে কিছুলোক বসা দেখে তাদেরকে) বললেন, তোমাদের কিসে বসিয়ে রেখেছে? তারা বললেন, আমরা বসে বসে আল্লাহ তা’আলার যিকর করছি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে আল্লাহ তা’আলার যিকরই কি বসিয়ে রেখেছে? তারা বললেন, আল্লাহর শপথ আল্লাহ তা’আলার যিকরই আমাদেরকে বসিয়ে রেখেছে। তিনি বললেন, শোন! তোমাদের মিথ্যা বলার সন্দেহে আমি তোমাদেরকে শপথ করাইনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে আমার চেয়ে কম হাদীস বর্ণনাকারীও কেউ নেই।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদের এক দরবারে পৌছে বললেনঃ তোমাদেরকে কিসে বসিয়ে রেখেছে? তারা বলেন, এখানে বসে আমরা আল্লাহ তা’আলার যিকর করছি এবং তার প্রশংসা করছি, কেননা ইসলামের দিকে তিনিই আমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন এবং ইসলামের মাধ্যমে আমাদের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর শপথ! এটাই তোমাদেরকে বসিয়ে রেখেছে কি? তারা বললেন, আল্লাহর শপথ! আমাদেরকে শুধুমাত্র এটাই বসিয়ে রেখেছে। তিনি বললেনঃ তোমাদের মিথ্যা বলার সন্দেহে আমি তোমাদেরকে কসম দেইনি। জিবরীল (আঃ) আমার কাছে এসে আমাকে জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের সম্মুখে তোমাদের নিয়ে গর্ব করছেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩৩৭৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৭০১]
চার- হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে সমস্ত লোক আল্লাহর জিকিরের জন্য একত্রিত হয় এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তখন আসমান হতে এক ফেরেশতা ঘোষণা করে যে, তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের গোনাহকে নেকী দ্বারা পাল্টে দেয়া হয়েছে। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১২৪৫৩, মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৬৭৬৪]
পাঁচ- হযরত আবু দারদা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কিছু লোকের হাশর এমনভাবে করাবেন যে, তাদের চেহারায় নূর চমকাতে থাকবে, তারা মোতির মিম্বরে বসা থাকবে। অন্যান্য লোক তাদের প্রতি ঈর্ষা করতে থাকবে। তারা নবীও হবেন না, শহীদও হবেন না। কেউ বলল যে, হে আল্লাহর রাসূল, তাদের অবস্থা বলে দিন, যেন আমরা তাদের চিনতে পারি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা ঐ সমস্ত লোক যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে এবং বিভিন্ন খান্দান হতে এক জায়গায় একত্রিত হয়ে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন হতো। [মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৬৭৭০]
ছয়- আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা যখন জান্নাতের বাগান দিয়ে পথ অতিক্রম করবে তখন তাতে বিচরণ করো। সাহাবীরা বললেনঃ জান্নাতের বাগান কি? তিনি বললেনঃ যিকিরের হালাকাসমূহ। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩৫১০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১২৫২৩, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৬৯০৭]
সাত- আব্দুর রহমান বিন সাহল বিন হুনাইফ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এক ঘরে থাকাকালীন সময়ে সূরা কাহাফের ২৮ নং আয়াত وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ নাজিল হয়। তখন তিনি তাদের
অনুসন্ধানে বের হলেন। তখন এক জামাতকে পেলেন যারা আল্লাহর জিকিরে মশগুল। যাদের মাঝের কিছু লোকের মাথার চুল এলোমলো, শরীরের চামড়া শুকনা, এবং একটি মাত্র কাপড় পরিহিত। যখন নবীজী তাদের দেখলেন তখন তাদের সাথে বসে গেলেন। তারপর বললেন, আল্লাহর শুকরিয়া যিনি আমার উম্মতের মাঝে এমন লোক সৃষ্টি করেছেন, স্বয়ং আমাকে যাদের সাথে বসার হুকুম করেছেন। [মারিফাতুস সাহাবা, লিআবী নুআঈম, হাদীস নং-৪৬১৭, মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১০৯৯৮, তাফসীরে তাবারী-৬/১৮, তাফসীরে ইবনে কাসীর-৫/১৩৯, ফাতহুল কাদীর, শাওকানীকৃত-৩/৩৩৬]
ইমাম হায়ছামী হাদীসটির ক্ষেত্রে মন্তব্য করেছেন- رِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِঅর্থাৎ এ হাদীসটির রাবীগণ বুখারীর রাবী।
عَنْ أَبِي الْبَخْتَرِيِّ، قَالَ: بَلَغَ عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ أَنَّ قَوْمًا، يَقْعُدُونَ مِنَ الْمَغْرِبِ إِلَى الْعِشَاءِ يُسَبِّحُونَ يَقُولُونَ: قُولُوا كَذَا وَقُولُوا كَذَا، قَالَ عَبْدُ اللهِ: «إِنْ قَعَدُوا فَآذِنُونِي» ، فَلَمَّا جَلَسُوا أَتَوْهُ فَانْطَلَقَ فَدَخَلَ مَعَهُمْ فَجَلَسَ وَعَلَيْهِ بُرْنُسٌ، فَأَخَذُوا فِي تَسْبِيحِهِمْ فَحَسَرَ عَبْدُ اللهِ عَنْ رَأْسِهِ الْبُرْنُسَ، وَقَالَ: «أَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ مَسْعُودٍ» ، فَسَكَتَ الْقَوْمُ، فَقَالَ: «لَقَدْ جِئْتُمْ بِبِدْعَةٍ ظَلْمَاءَ، أَوْ لَقَدْ فَضَلْتُمْ أَصْحَابَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِلْمًا» ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ بَنِي تَمِيمٍ: مَا جِئْنَا بِبِدْعَةٍ ظَلْمَاءَ، وَلَا فَضَلْنَا أَصْحَابَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِلْمًا، فَقَالَ عَمْرُو بْنُ عُتْبَةَ بْنِ فَرْقَدٍ: أَسْتَغْفِرُ اللهَ يَا ابْنَ مَسْعُودٍ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ، فَأَمَرَهُمْ أَنْ يَتَفَرَّقُوا، (المعجم الكبير للطبرانى، رقم الحديث-8630، مصنف عبد الرزاق، رقم الحديث-5409)
أَخْبَرَنَا الْحَكَمُ بْنُ الْمُبَارَكِ، أَنبَأَنَا عَمْرُو بْنُ يَحْيَى، قَالَ: سَمِعْتُ أَبِي، يُحَدِّثُ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: كُنَّا نَجْلِسُ عَلَى بَابِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَبْلَ صَلَاةِ الْغَدَاةِ، فَإِذَا خَرَجَ، مَشَيْنَا مَعَهُ إِلَى الْمَسْجِدِ، فَجَاءَنَا أَبُو مُوسَى الْأَشْعَرِيُّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فَقَالَ: أَخَرَجَ إِلَيْكُمْ أَبُو عَبْدِ الرَّحْمَنِ قُلْنَا: لَا، بَعْدُ. فَجَلَسَ مَعَنَا حَتَّى خَرَجَ، فَلَمَّا خَرَجَ، قُمْنَا إِلَيْهِ جَمِيعًا، فَقَالَ لَهُ أَبُو مُوسَى: يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، إِنِّي رَأَيْتُ فِي الْمَسْجِدِ آنِفًا أَمْرًا أَنْكَرْتُهُ وَلَمْ أَرَ – وَالْحَمْدُ لِلَّهِ – إِلَّا خَيْرًا. قَالَ: فَمَا هُوَ؟ فَقَالَ: إِنْ عِشْتَ فَسَتَرَاهُ. قَالَ: رَأَيْتُ فِي الْمَسْجِدِ قَوْمًا حِلَقًا جُلُوسًا يَنْتَظِرُونَ الصَّلَاةَ فِي كُلِّ حَلْقَةٍ رَجُلٌ، وَفِي أَيْدِيهِمْ حصًا، فَيَقُولُ: كَبِّرُوا مِائَةً، فَيُكَبِّرُونَ مِائَةً، فَيَقُولُ: هَلِّلُوا مِائَةً، فَيُهَلِّلُونَ مِائَةً، وَيَقُولُ: سَبِّحُوا مِائَةً، فَيُسَبِّحُونَ مِائَةً، قَالَ: فَمَاذَا قُلْتَ لَهُمْ؟ قَالَ: مَا قُلْتُ لَهُمْ شَيْئًا انْتِظَارَ رَأْيِكَ أَوِ انْتظارَ أَمْرِكَ. قَالَ: «أَفَلَا أَمَرْتَهُمْ أَنْ يَعُدُّوا سَيِّئَاتِهِمْ، وَضَمِنْتَ لَهُمْ أَنْ لَا يَضِيعَ مِنْ حَسَنَاتِهِمْ»، ثُمَّ مَضَى وَمَضَيْنَا مَعَهُ حَتَّى أَتَى حَلْقَةً مِنْ تِلْكَ الْحِلَقِ، فَوَقَفَ عَلَيْهِمْ، فَقَالَ: «مَا هَذَا الَّذِي أَرَاكُمْ تَصْنَعُونَ؟» قَالُوا: يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ حصًا نَعُدُّ بِهِ التَّكْبِيرَ وَالتَّهْلِيلَ وَالتَّسْبِيحَ. قَالَ: «فَعُدُّوا سَيِّئَاتِكُمْ، فَأَنَا ضَامِنٌ أَنْ لَا يَضِيعَ مِنْ حَسَنَاتِكُمْ شَيْءٌ وَيْحَكُمْ يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ، مَا أَسْرَعَ هَلَكَتَكُمْ هَؤُلَاءِ صَحَابَةُ نَبِيِّكُمْ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَوَافِرُونَ، وَهَذِهِ ثِيَابُهُ لَمْ تَبْلَ، وَآنِيَتُهُ لَمْ تُكْسَرْ، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، إِنَّكُمْ لَعَلَى مِلَّةٍ هِيَ أَهْدَى مِنْ مِلَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أوْ مُفْتَتِحُو بَابِ ضَلَالَةٍ». قَالُوا: وَاللَّهِ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ، مَا أَرَدْنَا إِلَّا الْخَيْرَ. قَالَ: «وَكَمْ مِنْ مُرِيدٍ لِلْخَيْرِ لَنْ يُصِيبَهُ، إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدَّثَنَا أَنَّ» قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ “، وَايْمُ اللَّهِ مَا أَدْرِي لَعَلَّ أَكْثَرَهُمْ مِنْكُمْ، ثُمَّ تَوَلَّى عَنْهُمْ (سنن الدارمى-1/286، رقم-210
ফতোয়া প্রদানে- মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
-সূত্র আহলে হক মিডিয়া