আওয়ার ইসলাম: ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনসহ শিরকি সংস্কৃতি আরও আগে থেকে শুরু হলেও ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এর প্রচলন ঘটে বিগত শতকের শেষের মেয়াদের সরকারের আমলে। তখন থেকেই দেশের আলেম সমাজ এই অপতৎপরতার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
দেশের ইসলামবেত্তাগণ সর্বসম্মতভাবে এই তৎপরতাকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে প্রতিরোধের ডাক দিলে এক দিকে যেমন দমন-পীড়ন চালানো হয়, তেমনি কিছু ঠুনকো বক্তব্য আর ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে এগুলো ইসলামবিরোধী নয় মর্মে খোড়া যুক্তি দাঁড় করানো হয়। ঈমানি প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ই দেখা যায় একটি মহল ইসলামের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি।
ইতোপূর্বেও যখন শিখা অনির্বাণ ও চিরন্তন স্থাপন করা হয়েছিল তখন আলেমসমাজ এর বিরোধিতা করলে এই মহলটি একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আলেম সমাজের বক্তব্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে অমুসলিম জাতির ধর্মীয় উপাস্য বা তাদের ধর্মীয় নীতির আলোকে কোনো উদ্যোগ মুসলিম দেশে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আগুন হলো অগ্নিপূজকদের উপাস্য। তারা আগুনকে প্রতীকরূপে সম্মান জানায় ও উপাসনা করে।
আগুনের শিখাকে অনির্বাণ বা চিরন্তন নাম দিয়ে তার সামনে পুস্পস্তবক অর্পণ করা বা দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা একটি শিরকি রীতি। তাওহিদ তথা একত্ববাদে বিশ্বাসী কোনো ঈমানদার এটা মেনে নিতে পারে না। আলেম সমাজের এমন স্পষ্ট ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা সম্বলিত বক্তব্য উপস্থাপিত হওয়ার পরও কেউ কেউ খোড়া যুক্তি দেখিয়েছিলেন। আগুন দিয়ে রান্না করে খাবার খাওয়া গেলে শিখা চিরন্তন স্থাপন করা যাবে না কেন? অথচ দুটি ক্ষেত্রের পার্থক্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
আগুনকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মানুষের খেদমতের জন্য। মানুষের কাজে ব্যবহারের জন্য। উপাসনা করা বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য নয়। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এমন অযৌক্তিক তুলনার মাধ্যমে শিখা চিরন্তন বা অর্নিবাণের বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন অনেক শিক্ষিত বিবেকবান মানুষ!
ঠিক তেমনি ভাস্কর্য-মূর্তি স্থাপনের বিষয়ে যখন ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধীতা আরোপ করা হলো, তখনও একটি মহল এমন ভুল বক্তব্য প্রচার করতে লাগল। কিছুদিন তাদের প্রচারণার মূল কথা ছিল, ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। ইসলাম ধর্মে মূর্তির ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও ভাস্কর্যে সমস্যা নেই।’ নাউজুবিল্লাহ।
এ প্রেক্ষিতে খোদ বাংলা ভাষার গ্রহণযোগ্য প্রতিটি ডিকশনারী ও প্রামাণ্য সূত্রের বরাত দিয়ে এ কথা তুলে ধরা হলো যে, ভাস্কর্য ও মূর্তি এক ও অভিন্ন। শব্দের ভিন্নতা ছাড়া মর্মের কোনো ভিন্নতা মূর্তি ও ভাস্কর্যের মাঝে নেই। ইদানীং লক্ষ্য করছি, মূর্তিপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবী মূর্তি ও ভাস্কর্যের অভিন্নতা মেনে নিয়ে বিতর্কে নুতন আরেকটি মাত্রা যুক্ত করেছেন আর তা হলো ‘প্রতিমা’। তারা বোঝাতে চাইছেন, ইসলামে নিষিদ্ধ হলো প্রতিমা।
মূর্তি আর ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়। অতঃপর প্রতিমার সাথে মূর্তি ভাস্কর্যের পার্থক্য বর্ণনা করেন এভাবে যে, প্রতিমা হলো যার উপাসনা করা হয়, আরাধনা করা হয় এবং তার কাছে ইহ-পরকালের কল্যাণ প্রার্থনা করা হয়। আর মূর্তি/ভাস্কর্য হলো, যা সম্মান প্রদর্শন বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য স্থাপন করা হয়।
মূর্তিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের এহেন তৎপরতা মূর্তি স্থাপনের চেয়েও জঘন্য ও ধৃষ্টতাপূর্ণ। অন্যায় করা তো অন্যায়। কিন্তু অন্যায়কে বৈধ প্রমাণ করার চেষ্টাকেই বলা হয় ‘চুরির উপর সিনাজুড়ি’। প্রাণীর মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামি শরিয়তের বিশেষজ্ঞ সকল ইমাম ও মুজতাহিদদের মতে অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ। কুরআন সুন্নাহর শত শত বিবরণ এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন।
মূর্তি ও ভাস্কর্য বৈধ প্রমাণের বিভ্রান্তিমূলক চেষ্টা
কুরআন-সুন্নাহর ভুরি ভুরি প্রমাণ প্রতিমা ও ভাস্কর্য নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে কিছু মিথ্যা গল্প, অস্পষ্ট বিবরণ আর রহিত বিধানের উপর ভিত্তি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। ভাস্কর্য বা মূর্তিকে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ প্রমাণ করার জন্য মোটামুটি চারটি বিষয় পেশ করা হচ্ছে।
এক. হজরত আয়েশা রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর ঘরে পুতুল নিয়ে খেলা করতেন। সেই পুতুলগুলোর মধ্যে একটা ডানাবিশিষ্ট ঘোড়ার পুতুলও ছিল। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. এগুলো দেখেছেন কিন্তু নিষেধ করেননি। বুখারি-মুসলিমসহ অনেক হাদিসগ্রন্থে এ বিষয়টি উল্লেখ আছে।
দুই. রাসুল সা. পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের ভিতর ও আশপাশ থেকে যখন সকল মূর্তি অপসারণ করেন তখন বাইতুল্লাহর ভিতরে হজরত ঈসা আ. এবং মেরি ( হজরত মারয়াম ) এর প্রতিকৃতি ভাঙতে নিষেধ করেন। সিরাতে ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের বরাতে উপরোক্ত বর্ণনাটি তারা উল্লেখ করে থাকেন।
তিন. পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হজরত সুলায়মান আ. এর ঘটনা। যেখানে বলা হয়েছে নবী সুলায়মান আর. এর নির্দেশে জিনরা আকৃতি নির্মাণ করত।
চার. মুসলিম খলিফাদের শাসনকাল থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অমুসলিমদের দেশ বিজয়ের পর সেখানকার মূর্তি অপসারণ করা হয়নি। বর্তমানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য স্থাপিত রয়েছে।
ভ্রান্তির অপনোদন
মূর্তিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি আর প্রমাণগুলো পড়লে বুঝা যায়, তারা কুরআন হাদিস কিছু ঘাটাঘাটি করেছেন। তবে তা করেছেন কুরআন সুন্নাহর সঠিক বক্তব্য অনুসন্ধানের জন্য নয়, বরং নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তার স্বপক্ষে কিছু বিভ্রান্তিমূলক সূত্র সন্ধানের নিমিত্তে। এ ধরনের কর্মকণ্ড খুবই গর্হিত। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কেই বলা হয়েছে ‘আল্লাহ কুরআনের দ্বারা অনেককে সঠিক পথ দেখান, আবার অনেককে ভুল পথে চালান। আর যারা অপরাধী কেবল তাদেরকেই কুরআনেরর দ্বারা বিভ্রান্ত করেন। [সুরা বাকারা]
হজরত আয়েশা রা. এর পুতুল সংক্রান্ত বিবরণগুলো যেকোনো সত্যানুসন্ধিৎসু পাঠক পড়লেই বুঝবেন, নয় দশ বছরের এক বালিকার খেলার জন্য স্বহস্তে বানানো ছিল পুতুলগুলো। পুতুল বলতে হুবহু মানুষ বা কোনো প্রাণীর আকৃতি ছিল না সেগুলো। বরং শিশুদের কঁচি হাতে কাপড় চোপড় দিয়ে তৈরি ছিল এবং নিঃসন্দেহে তাতে কোনো মুখায়বয়ব ছিল না। যদি পুতুলগুলোতে প্রাণীর আকৃতি দৃশ্যমান থাকত তবে তা কস্মিকালেও নবীজি সা. এর ঘরে থাকতে পারত না। পূর্ণাকৃতির পুতুলতো দূরের কথা, কাপড়ে অঙ্কিত প্রাণীর দৃশ্যও তো রাসুল সা. বরদাশত করেননি। খোদ হজরত আয়েশা রা. কে এ জন্য কড়া শাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
হজরত আয়েশা রা. প্রাণীর আকৃতি যুক্ত একটি চাদর ক্রয় করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সা. তা দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন, ঘরে ঢুকলেন না। আয়েশা রা. নবীজির সা. চেহারায় ক্ষোভ লক্ষ্য করলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের নিকট তওবা করছি, আমার থেকে কী অপরাধ প্রকাশ পেয়েছে? নবীজি সা. বললেন, এ চাদরের কী দশা? আয়েশা রা. বললেন, আমি এটা কিনেছি আপনার বসার ও হেলান দেয়ার জন্য। তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, এই আকৃতি অঙ্কনকারীদেরকে কেয়ামতের দিন কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। [বুখারি : ৫৯৬১]
পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের দেয়ালে হজরত ঈসা ও মারয়াম আ. এর অঙ্কিত ছবির বিষয়ে মূর্তিপন্থীদের প্রচারণাকে সত্যের অপলাপ বলা ছাড়া উপায় নেই। প্রথমত, সিরাতে ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিশামের বরাতে যা কিছু বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তা আদৌ সঠিক তথ্য নয়। বরং প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ঈসা ও মেরির (মারয়ামের) ছবি বাইতুল্লাহর দেয়ালে রেখে দেয়ার কল্পিত যে কাহিনীটি তারা বর্ণনা করেছেন, সেটা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রেস থেকে প্রকাশিত ইংলিশ লেখক আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত ‘দি লাইফ অব মোহাম্মদ’ গ্রন্থের বর্ণনা। [প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠা ৫৫২] আলফ্রেড গিয়োম সিরাতে ইবনে ইসহাকের সংক্ষেপিত রূপ সিরাতে ইবনে হিশামের অনুবাদ করেছেন ঠিক, কিন্তু তাতে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করেছেন।
এমন অনেক বর্ণনা তিনি এই গ্রন্থে সংযুক্ত করেছেন যা মূলগ্রন্থ সিরাতে ইবনে ইসহাকেও নেই। সিরাতে ইবনে হিশামের কোনো পাণ্ডুলিপি বা মুদ্রিত সংস্করণেও নেই। ঈসা আ. ও মেরির ছবি রেখে দেওয়ার বর্ণনাটিও আলফ্রেড গিয়োমের সংযোজন, যা তিনি আযরাকি কৃত ‘আখবারু মক্কা’ থেকে সংগ্রহ করে ইবনে ইসহাকের নামে চালিয়ে দিয়েছেন এবং বর্ণনাটির সূত্রও যাচাই করে দেখা গেছে সেটি সবৈর্ব ভুয়া ও জাল। প্রশ্ন ওখানেই যে, বিশুদ্ধ বর্ণনার অগণিত হাদিস হাতের নাগালে থাকতে আলফ্রেড গিয়োমের এই বর্ণনাটি বুদ্ধিজীবীদের কেন পছন্দ হলো? এটাকে অজ্ঞতা বলব না জ্ঞানপাপ বলব?
২০০৮ সালে হুমায়ুন আহমেদও এই নির্জলা মিথ্যা তথ্যের বরাত দিয়ে মূর্তির বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন। তখন বিষয়টি নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন ও প্রচার করেছিলেন মুহতারাম হজরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মালেক, (মাসিক আল কাউসার : ডিসেম্বর ২০০৮)।
আট বছর পর আবার সেই একই কাসুন্দি ঘেটে ২০১৭ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি হাসান মাহমুদ বিভ্রান্তি ছড়ালেন! (কালের কণ্ঠ)। একেই বুঝি বলে চোখ থাকিতে অন্ধ!
হজরত সুলাইমান আর. এর যুগে পবিত্র কুরআনে জিন জাতি কর্তৃক আকৃতি গঠনের বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে। তবে এটাতো নবী সুলাইমান আ. এর আনীত শরিয়তের ঘটনা। এদ্বারা আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর আনীত শরিয়তে মুহাম্মাদিয়ায় কী রূপে প্রমাণিত হবে। অথচ পূর্বের শরিয়ত ও বর্তমান শরিয়তে ভাস্কর্য সংক্রান্ত বিধানের পার্থক্য কার্যকারণসহ বিবৃত হয়ে আছে ‘হজরত ইবনে আব্বাস রা. পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ওয়াদ্দ, সুয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর সম্পর্কে বলেছেন, এরা সবাই নূহ জাতির নেককার বান্দা ছিলেন।
যখন তাদের মৃত্যু হলো তখন শয়তান কুমন্ত্রণা দিয়ে তারা যে সমস্ত স্থানে বসত সেখানে তাদের মূর্তি বানিয়ে রাখে। আর ঐ মূর্তিগুলোকে তাদের নামেই নামকরণ করে। তখনও তাদের ইবাদত শুরু হয়নি। এর পর যখন ঐ জমানার লোকরাও মারা গেল, তাদের পরের লোকেরা ভুলে গলে যে, কেন এই মূর্তিগুলো তৈরি করা হয়েছিল। আর এভাবেই তাদের পূজা শুরু হয়ে গেল। [বুখারি ; হাদিস ৪৯২০]
পূর্ববর্তী অনেক শরিয়তে মূর্তির বৈধতা ছিল। আরও অনেক কিছুরই বৈধতা ছিল। কিন্তু আমাদের শরিয়তে মুহাম্মাদিয়াতে মূর্তির অবৈধতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। রহিত বিধানের ঘটনা দিয়ে প্রমাণ পেশ করা অজ্ঞতার পরিচায়কই বটে। পবিত্র কুরআনে এমন আরও অনেক ঘটনার বিবরণ আছে, যেগুলো বর্তমান শরিয়তে বলবৎ নেই। মূর্তির বিষয়টিও তেমন।
থাকল মুসলিম খলিফাদের যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে মূর্তি থাকার ঘটনা। এ বিষয়ে খলিফা হজরত আলী রা. এর একটি ঘটনার বিবরণ পড়ে দেখি আবুল হাইয়াজ আসাদি বলেন, আলী ইবনে আবি তালেব রা. আমাকে বলেছেন, আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে নবী সা. আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সকল প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সমাধি সৌধ মাটির সাথে মিশিয়ে দিবে এবং সকল ছবি মুছে ফেলবে। [মুসলিম : হাদিস ৯৬৯]
এটাই হলো ইসলামি উম্মাহর প্রকৃত চিত্র। বাকি সংখ্যালঘু অমুসলিমদের উপসানালয়সমূহে সংরক্ষিত মূর্তি সেগুলো ইসলাম কোনো কালেই ভাঙতে বলেনি, আজও ইসলামবেত্তাগণ বলেন না। মূর্তিপন্থীরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বিভ্রান্তি তৈরির মতো কছিু উপাদান পেয়েছেন, সেগুলোই মানুষকে গেলানোর চেষ্টা করছেন। অথচ তারা যদি সত্যসন্ধানী হতেন তাহলে আরও সহজেই অনেক বিবরণ পেতেন যা ইসলামের সঠিক ও অকাট্য বিধান প্রমাণ করে। পাঠকের সুবিধার্থে এমন কিছু বিবরণ তুলে ধরা হলো।
কুরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে প্রতিমা ও ভাস্কর্য দুটোকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদের স্পষ্ট নির্দেশ ‘তোমরা পরিহার কর অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার কর মিথ্যাকথন।’ [সুরা হজ্জ : ৩০] এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে সবধরনের মূর্তি পরিত্যাগ করার এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সকল কর্মকা বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
হাদিস শরিফেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে পরিষ্কার বিধান দান করেছেন।
হজরত আমর ইবনে আবাসা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরিক না করার বিধান দিয়ে। [সহিহ মুসলিম : ৮৩২]
আলী ইবনে আবি তালেব রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদিনায় যাবে এবং যেখানে যে কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে, যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দিবে? আলী রা. এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘যে কেউ পুনরায় উপরোক্ত কোনো কিছু তৈরি করতে প্রবৃত্ত হবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি নাজিলকৃত দ্বীনকে অস্বীকারকারী।’ [মুসনাদে আহমাদ : ৬৫৭]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রতিকৃতি তৈরিকারী শ্রেণি হলো ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত-দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।’ [সহিহ বুখারি : ৫৯৫০]।
আবু হুরায়রা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শষ্য কিংবা একটি যব! [সহিহ বুখারি : ৫৯৫৩]।
‘উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন -এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের কিয়ামত-দিবসে আজাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা ‘সৃষ্টি’ করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার কর!’ [সহিহ বুখারি : ৭৫৫৭ ও ৭৫৫৮]
‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করে কিয়ামত-দিবসে তাকে আদেশ করা হবে সে যেন তাতে প্রাণসঞ্চার করে অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।’ [সহিহ বুখারি : ৫৯৬৩]।
আওন ইবনে আবু জুহাইফা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারী, উল্কি অঙ্কনকারী ও উল্কি গ্রহণকারী এবং প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীদের উপর লানত করেছেন। [সহিহ বুখারি ৫৯৬২]
এই হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন কবিরা গুনাহ। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুফরিরও পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
মূর্তি ও ভাস্কর্যের বেচাকেনাও হাদিস শরিফে সম্পূর্ণ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে ‘হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় থাকা অবস্থায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ ও তার রাসুল মদ ও মূর্তি এবং শুকর ও মৃত প্রাণী বিক্রি করা হারাম করেছেন।’ [সহিহ বুখারি : ২২৩৬]।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবিবা ইতোপূর্বে হাবশায় গিয়েছিলেন। তারা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন, ওই জাতির কোনো পুণ্যবান লোক যখন মারা যেত তখন তারা তার কবরের উপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।’ (সহিহ বুখারি : ১৩৪১)
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘(ফতহে মক্কার সময়) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বায়তুল্লায় বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখলেন তখন তা মুছে ফেলার আদেশ দিলেন। প্রতিকৃতিগুলো মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত তিনি তাতে প্রবেশ করেননি।’ (সহিহ বুখারি)
-সূত্র: মাওলানা মামুনুল হকের অফিসিয়াল পেইজ
-এটি