আওয়ার ইসলাম: রাজশাহী শহরে লাগাতার ৪০ বছর পত্রিকা বিক্রি করেন খুকি। শহরের একমাত্র নারী পত্রিকা বিক্রেতা তিনি। পত্রিকা বেচেই জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ১১ বছর পূর্বের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার এজেন্ট ও স্থানীয় পত্রিকার সার্কুলেশন থেকে পত্রিকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নগরীতে। খুকির হাতের পত্রিকা পড়ে তারা, খুকির জীবনের গল্প পড়া হয়ে ওঠে না।
খুকির জীবনে মর্মান্তিক এক ঘটনা ঘটে বিয়ের মাত্র ১ মাসের মাথায়। স্বামী মারা যান, বিধবা হন মাস পরেই। উত্তরাঞ্চলের শহরে বিয়ে হলেও সামাজিক রীতি তো আর সামাজিকতা ভেঙে বেরিয়ে পড়েনি। তবুও সেই শহরে খুকি উঠে দাঁড়ালেন। তবে উঠে দাঁড়ানোর গল্পটা সহজ নয়। নিজ পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। এক সময় ঠিকানা হয় পথে। এর মাঝে হয়তো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।
শোনা যায়, বাবা-মা, ভাই-বোনের অবহেলিত সেই নারী ঘরবাড়ি ছাড়া রাস্তায় পড়ে ছিল তবুও ভিক্ষের পথ বেছে নেননি। একদিন রাস্তায় কুঁড়িয়ে পাওয়া মানিব্যাগ উপযুক্ত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেওয়ার সম্মানি হিসেবে ১৫০ টাকা পান। আর এই ১৫০ টাকা দিয়ে শুরু করেন নিজের উঠে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা। শুরু করলেন পত্রিকা বিক্রি।
জানা গেছে, কিশোরী বয়সে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে খুকির বিয়ে হয়েছিল। মাস যেতে না যেতেই স্বামী মারা যান। ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার আত্মীয়-স্বজন তাকে গৃহছাড়া করেন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। এরপর থেকেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।
খবরের কাগজ বিক্রি করে এক সময় প্রতিদিন ৩০০ টাকা আয় করতেন। এই আয় থেকে নিজের জন্য ব্যয় করতেন মাত্র ৪০ টাকা। হজে যাওয়ার তীব্র বাসনায় ১০০ টাকা ব্যাংকে জমা করতেন। আর ১৬০ টাকাই ব্যয় করতেন মানুষের সেবামূলক কাজে। এর মধ্যে ১০০ টাকা দিতেন এতিমখানায়, ৫০ টাকা দিতেন মসজিদে। আর ১০ টাকা দিতেন ফকিরদের।
জানা গেছে, এত দিনে ব্যাংকে জমা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। সেই জমানো অর্থ আর পৈতৃকভাবে পাওয়া কিছু সম্পত্তিই তার জীবনের শেষ সম্বল। যা দিয়ে যেতে চান কোনো স্কুলের নামে। সেই দানের টাকা থেকে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে বৃত্তি। মৃত্যুর পর তার লাশটা যেন জন্ম শহর কুষ্টিয়ায় দাফন করা হয়, সেই ইচ্ছাই তিনি জানিয়েছেন। খুকির সময়টা এখন ভালো কাটছে না। কাটছে নানা দুঃখ-কষ্টে। প্রায় ৪০ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রির সঙ্গে জড়িত খুকি।
প্রতিদিন সকালে তার শিরোইল মহল্লার বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে রাজশাহী মহানগরীর রেলগেট মার্কেটে পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পত্রিকা ক্রয় করেন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাজশাহীর রেলস্টেশন, আরডিএ মার্কেট, সাহেববাজার, সাগরপাড়া, শিরোইল বাস টার্মিনাল, আলুপট্টি ও নিউমার্কেট এলাকায় পত্রিকা বিক্রি করেন।
এসব স্থানে তার কিছু নিয়মিত গ্রাহক আছে। এছাড়াও হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করেন, কারো কাছ থেকে বাড়তি পয়সা পেলেও নেন না। খুকির নানামূখী সমস্যা থাকলেও থাকেন নিজের বাড়িতে। বড়বোনের বাসা খুকির বাড়ির পাশেই। বড় বোনের ছেলে শামস-উর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, খালাকে আমরা পত্রিকা বিক্রি করতে নিষেধ করেছি। তিনি আমাদের কথা শোনেন না। তিনি পত্রিকা বিক্রি করে একা একাই চলতে চান।
খুকি সম্পর্কে প্রতিবেশিরা বলছে তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি একগুঁয়ে স্বভাবের হয়ে ওঠেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া জমিতে বাড়ি তৈরি করে একাই থাকেন। কারও কাছ থেকে কোনো সহায়তা নেন না। পত্রিকা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
অথচ ১১ বছর পূর্বের ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে খুকির শেষদিকের কথাগুলো ছিল, ‘কেউ আমাকে এক পয়সার হেল্প করেনি। কি হবে এই সাক্ষাৎকার নিয়ে। কেউ তো আমাকে সাহায্য করবে না।’
খুকি যাদের কাছে পত্রিকা নেন। তাদেরই একজন লিটন ইসলাম বাবু। তিনি গণমাধ্যমকে জানান খুকি আপা আমার কাছে ১৩ বছর ধরে পত্রিকা নেন। কখনোই টাকা বাকি রাখেন না। টাকা পয়সার বিষয়ে খুকি আপা সচেতন।
শোধ করে তারপরে পত্রিকা নেন। তবে খুকির বর্তমান অবস্থা যে শোচনীয় তা সার্কুলেশন ম্যানেজার বাবুর কথাতেই বোঝা গেল। কেননা আগে ১৫০ কপি পত্রিকা কিনলেও এখন কেনেন ৩০-৪০ কপি। অর্থাৎ খুকির আয়ের উৎস তলানিতে ঠেকেছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীতে খুকির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন একটি সেচ্ছ্বাসেবী সংঠনের কয়েকজন সদস্য। তাঁরা খুকিকে একটি শীতের চাদর দিয়েছেন।
এছাড়াও প্রাথমিক সাপোর্ট ও প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। অরেঞ্জ আর্মি সংগঠনের পক্ষ থেকে খুকিকে হজে পাঠানো হবেও বলে তাদের পেইজে জানানো হয়েছে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, ‘খুকির শারীরিক অবস্থা এখন তেমন একটা ভালো না। আমাদের সদস্যরা গিয়ে দেখে আমাদের জানিয়েছেন। আমরা খুকি খালার সঙ্গে কথা বলেছি, তাকে চিকিৎসা দিয়ে পুরোপুরি সুস্থ করে হজে পাঠালে যাবেন কি না। কেননা তিনি তার সাক্ষাৎকারে হজে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। খুকি খালা রাজি হয়েছেন। দেখি আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’
এমডব্লিউ/