মুহাম্মদ আল আমিন।।
মূল নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আবিল হুকাইক। তাকে সাল্লাম ইবনে আবিল হুকাইক নামেও ডাকা হতো। তার উপনাম ছিলো আবু রাফে’। সে ছিলো হিজাযের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ছিলো। খায়বারের পাশেই হিজাযের একটি সুরক্ষিত দূর্গে সে বসবাস করত। সে ছিলো জাত ইয়াহুদী। উগ্র ও কট্টরপন্থী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি চরম ঘৃণা-বিদ্বেষ তার ইয়াহুদী সত্ত¡ার রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে ছিলো। সে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অভিসম্পাত করতো, তাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতো। ইয়াহুদীদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের কৌশলগত মিত্রতা থাকা সত্তে!
গাতফানসহ আরবের অন্যান্য মুশরিক গোত্রগুলোকে সে আর্থিক সহায়তার মধ্য দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরদ্ধে যুদ্ধে উস্কে দিতো। শান্তি চুক্তিকে উপেক্ষা করে সে খায়বার যুদ্ধে মদীনার ভেতর থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সহযোগিতা করতে থাকে। এভাবে সে নানামুখী চক্রান্তের দ্বারা মুসলমানদের প্রচÐ অতিষ্ঠ করে তোলে। (আসসিরাতুন নাবাউয়্যাহ, ইবনে কাসীর: ৩৬৩/৩, দালাইলুন নাবুউওয়্যাহ, বায়হাকী: ৩৪/৪))
মদীনার আনসারি সাহাবিগণের প্রধানত দুটি গোত্র ছিলো; আউস এবং খাযরাজ। তারা সৎকাজে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা করতো। এক গোত্র কোনো কৃতিত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিলে অন্য গোত্র তার চেয়েও আরোও বড়ো কিছু করে আল্লাহ ও তার রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো। তো আওস গোত্রের সাহাবীগণ যখন কা’ব ইবনে আশরাফকে হত্যার মর্যাদা লাভ করলো, তখন খাযরাজ গোত্রের সাহাবায়ে কেরাম দেখলেন, আউসের সাহাবাগণ এক অভূতপূর্ব কৃতিত্ব লাভ করেছেন।
তাই তারা মনস্থির করলেন, কা’ব বিন আশরাফের মতো আরোও কোনো নবীর দুশমনকে হত্যা করে তারাও এ মর্যাদা লাভ করবেন। পরস্পরে পরামর্শ করলেন- কা’ব বিন আশরাফের মতো আর কে আছে এমন নবীর দুশমন? শেষে দেখলেন, আছে একজন। সে হলো কট্টরপন্থী ইয়াহুদি আবু রাফে’। মনস্থির করলেন, একেই হত্যা করতে হবে। ফাতহুল বারি
নিজেরা পরামর্শের পর খাযরাজের সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আবু রাফে’কে হত্যার অনুমতি চাইলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেন এবং সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক রা. এর নেতৃত্বে ছয়জনের একটি ছোট্ট বাহিনী পাঠালেন আবু রাফে’কে হত্যা করার জন্য। তারা হলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক, আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা, মাসউদ ইবনে সিনান, আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস, আবু কাতাদা, খুযায়ি ইবনে আসউয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন।
সাহাবায়ে কেরাম যখন আবু রাফে’র দূর্গের কাছাকাছি পৌঁছলেন, ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে এবং লোকজন তাদের পশুগুলোকে চারণভূমি থেকে দূর্গে নিয়ে এসেছে। আব্দুল্লাহ রা. তার সঙ্গীদের বললেন, তোমরা এখানেই বসে থাকো। আমি যাই, দারোয়ানের সাথে কোনো কৌশল করে ঢুকতে পারি কি না দেখি।
তিনি দরজার কাছে পৌঁছলেন। পৌঁছে কাপড় মুড়ি দিয়ে এমনভাবে বসে গেলেন, যেন তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করছেন। এতক্ষণে লোকজন দূর্গে ঢুকে গেছে। দারোয়ান আব্দুল্লাহ রা. কে লক্ষ্য করে বলল, ওহে আল্লাহর বান্দা! ঢুকতে চাইলে ঢুকো। আমি দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছি।
আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক রা. বলেন, আমি ঢুকে গেলাম। ঢুকে পশুর আস্তাবলে লুকিয়ে পড়লাম। সবার প্রবেশ করা শেষ হলে দারোয়ান দরজা বন্ধ করে দিল। দেখলাম, চাবিগুলো একটি পেরেকে লটকিয়ে রাখল। তিনি বলেন, আমি চাবিগুলো নিয়ে নিলাম। দরজা খুললাম। আবু রাফের অভ্যাস ছিল, রাতে তার কাছে খোশ-গল্পের আসর বসত।
সে দূর্গের উপরের তলায় থাকত। তার গল্পের সঙ্গীরা যখন চলে গেল, আমি সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায় উঠলাম। আমি যে দরজাই খুলতাম, এই ভেবে ভিতর থেকে লাগিয়ে দিতাম যে; যদি লোকজন আমার ব্যাপারে টের পেয়ে যায়, তাহলে হত্যা করে শেষ করা পর্যন্ত যেন তারা আমার কাছে পৌঁছতে না পারে। একের পর এক সিঁড়ি মাড়িয়ে অবশেষে আমি তার কক্ষে পৌঁছলাম।
আমি গিয়ে আবু রাফে’কে ডাক দিলাম। তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? জওয়াব দিলাম, আমি আবু রাফে’র জন্য কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি। এতে স্ত্রী দরজা খুলে দেয়। আবু রাফে’ অন্ধকার কক্ষে তার পরিবারের লোকদের মাঝখানে শুয়ে ছিলো। বুঝতে পারছিলাম না যে, ঠিক কোথায় সে। ডাক দিলাম, আবু রাফে! সে জওয়াব দিল, এই লোক কে? আমি আওয়াজটা লক্ষ করে তরবারি চালালাম। আমার তখন দিশেহারার মতো অবস্থা। কিন্তু না! কোনো কাজ হলো না। উল্টো সে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। অল্প কিছুক্ষণ পর আবার গেলাম। গলার স্বর পাল্টে, সাহায্য করার ভান করে বললাম, আবু রাফে! আওয়াজ কীসের? সে উত্তর দিলো, তোমার মায়ের সর্বনাশ হোক (অর্থাৎ, তুমি ধ্বংশ হও, এতক্ষণ কোথায় ছিলে!) এই মাত্র কক্ষে এক ব্যক্তি আমাকে তরবারি দিয়ে আঘাত করেছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক বলেন, এবার আওয়াজ লক্ষ্য করে তরবারি দিয়ে আরেকটা আঘাত করলাম । এতে সে মারাত্মক জখম হল। কিন্তু হত্যা করতে পারলাম না। এরপর আমি তরবারির ধারালো দিকটা তার পেটের উপর ধরে সজোরে চাপ দিলাম। একেবারে পিটে গিয়ে ঠেকল। বুঝতে পারলাম, হত্যা করতে পেরেছি।
তারপর একেক করে দরজাগুলো খুলতে খুলতে নিচে চলে আসতে লাগলাম। আসতে আসতে একটা সিঁড়িতে এসে পা রাখলাম। রাতটি ছিলো চাঁদনী রাত। মনে করেছিলাম সব সিঁড়ি শেষ। কিন্তু তখনও একটি সিঁড়ি বাকি ছিল। আমি পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে পায়ের গোছার হাড় ভেঙে গেল। পাগড়ি খুলে পা বেঁধে নিলাম।
সেখান থেকে এসে দূর্গের ফটকের নিকট বসে রইলাম। মনে মনে বললাম, হত্যা করতে পেরেছি কি না জানা পর্যন্ত দূর্গ থেকে বেরুবো না। যখন ভোর হল এবং মোরগ ডাকতে লাগল, তখন ঘোষক প্রাচিরের উপর উঠে ঘোষণা দিল, আমি ঘোষণা দিচ্ছি যে, হিজাযের ব্যবসায়ী আবু রাফে’ মারা গেছে। ঘোষণা শুনে নিশ্চিত হয়ে আমার সঙ্গীদের নিকট চলে এলাম। বললাম, তাড়াতাড়ি পালাও। আল্লাহ তাআলা আবু রাফেকে হত্যা করেছেন। এরপর আমরা দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতাম আর রাতের বেলা পথ চলতাম।
এভাবে খায়বার থেকে মদীনায় উপস্থিত হলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনার বিবরণ শুনালাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পা এদিকে বাড়াও দেখি। পা বাড়িয়ে দিলাম। তিনি পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাত পা এমনভাবে ভালো হয়ে গেলো যে, যেন কখনও কোনো ব্যথাই পাইনি। (সহীহ বুখারি: ৪০৩৯, ৪০৪০, সুনানে বায়হাকী: ১৮১০০)
সম্প্রতি ফ্রান্সের উগ্র ম্যাগাজিন শার্লি এবদো রহমাতুল্লিল আলামিন বিশ^ নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। আর বিশ^ মানবতার শত্রæ ফ্রান্সের উগ্র প্রেসিডেন্ট এ্যামানুয়াল ম্যাক্রোঁ প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বিশ^ মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের সামর্থ্য অনুপাতে এ যুদ্ধে অংশ নেওয়া ঈমানী দায়িত্ব।
আমরা বিশ্বাস করি, মজবুত প্রাচিরেঘেরা সুরক্ষিত দূর্গের মধ্যে থেকেও যেমনিভাবে নবীর দুশমন আবু রাফে’ নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি বরং নিজের বাসগৃহে নবী প্রেমিক র্শাদূলদের দ্বারা নিহত হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে প্রেসিডেন্ট ভবনের হাই সিকিউরিটি ব্যবস্থাও আবু রাফে’র ভাব শিষ্য ম্যাক্রোঁ কুলাঙ্গারকে রক্ষা করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। বিশ^ মুসলিম আজ সে ভোরটির প্রতিক্ষা করছে, যখন আবু রাফে’র ঘোষকের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে ঘোষণা আসবেÑ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এ্যামানুয়াল ম্যাক্রোঁ আর নেই । আল্লাহুম্মা ওয়াফফিকনা লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা। ফিদাকা আবি ওয়া উম্মি ইয়া রাসূলাল্লাহ!
লেখক: শিক্ষার্থী, ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া।
-এটি