মানব জীবনের প্রয়োজনীয় একটি শব্দ শিক্ষা। সক্রেটিসের ভাষায় ‘শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।’ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ ভালো-খারাপের পার্থক্য বুঝতে পারে। হতে পারে মানুষের মতো মানুষ। ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। হেরা গুহায় রাসূল সা.-এর উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয়, ‘পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড থেকে।’-সূরা আলাক : ১-২।
শিক্ষাদানে শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু অনেকে শাসনের নামে অতি মাত্রায় প্রহার করে, বেত্রাঘাত করে, মানসিক শারীরিক নির্যাতন করে। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার কখনো জ্ঞানার্জন থেকে ছিটকে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। সার্বজনীন ধর্ম ইসলাম এ বিষয়টি সামনে রেখে সুন্দর নির্দেশনা দিয়েছে আমাদের। শিশুদের পড়াশোনায় তাদের সঙ্গে শিক্ষকের আচরণ কেমন হওয়া চাই! এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সাথে কথা বলেছেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুর মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি তাউহিদুল ইসলাম ও জামিয়াতুল মানহাল উত্তরা ঢাকার মুহাদ্দিস, বায়তুল করীম জামে মসজিদ সাভার ঢাকার খতিব মাওলানা আদনান মাসউদ। কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের মফস্বল সম্পাদক আবদুল্লাহ আফফান।
মুফতি তাউহিদুল ইসলাম বলেন, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে কোন কিছু আদায় করার চেয়ে উৎসাহ-উদ্দিপনার মাধ্যমে আদায় করা কল্যাণকর। তাই উৎসাহের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের থেকে পড়া আদায় করতে হবে। পড়ানোর পদ্ধতিও এমন করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা পড়ার প্রতি মনোযোগী হয়। এবং তারা আনন্দের সাথে পড়ে।
সাধারণত শিক্ষার্থীরা যখন দুষ্টমি করে বা নিয়ম ভঙ্গ করে তখন তাদের শাস্তি দেয়া হয়। শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের উপর সার্বক্ষনিক নেগরানী করে তখন শিক্ষার্থীরা দুষ্টামি বা নিয়ম ভঙ্গ করতে পারে না। নেগরানী মানে শাসন না। যেমন: বাচ্চারা বিকেলে খেলাধুলা করে। তখন একজন শিক্ষক তাদের সাথে খেলা। তখন তারা কোন অকারেন্স বা অন্যায় করবে না। অযাচিত দুর্ঘটনা থেকেও বেঁচে থাকা যাবে।
একজন উস্তাদ যদি ছাত্রদের স্নেহ, আদর এবং সঙ্গ দেয় তাহলে তাদের থেকে পড়া আদায় করা যাবে। পুরস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগীতার মনোভাব সৃষ্টি করা। পড়াকে ভীতির বিষয় না করা। কোন ছাত্র যদি পূর্ণ পড়া না পারে। সে যতটুকু পেরেছে তার জন্য বাহবা দেয়া। এবং পূর্ণ পড়া শিখতে উৎসাহ দেয়া।
তিনি বলেন, প্রথমেই কাউকে শাস্তি না দেয়া। আগে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। এভাবে না হলে পরবর্তিতে তার কাজের জন্য শিক্ষক তার উপর নারাজ এটা বুঝানো। এ পদ্ধিতিগুলোর মাধ্যমে তাদের অন্যায় থেকে ফিরানোর চেষ্টা করবে। তারপরও যদি সে ঠিক না হয় তাহলে ফুকাহায়ে কেরাম যতটুকু শাস্তির কথা বলেছেন আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য ততটুকুই শাস্তি দেয়া।
মুফতি তাউহিদুল ইসলাম বলেন, আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য যে শাস্তি দেয়া হয় সে ব্যাপারে শরিয়তে নিয়ম-নীতি বলে দেয়া হয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম তা স্পস্ট করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. এমনভাবে মারা, তার শরীরে যেন দাগ না পরে। ২. এতো বড় বেত ব্যবহার করবে না; যেগুলো আস্তে মারলেও জোরে লাগে। ছোট বেত ব্যবহার করবে। ৩. শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে বেত্রাঘাত করবে না। স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর মধ্যে রয়েছে- চেহারা, লজ্জস্থান, হাড়ের জোড়া। ৪. এমনভাবেও মারা যাবে না যার কারণে তার স্থায়ী ক্ষতি হয় বা লম্বা সময়ের জন্য তার কষ্ট হয়।
জামিয়াতুল মানহাল উত্তরা ঢাকার মুহাদ্দিস, বায়তুল করীম জামে মসজিদ সাভার ঢাকার খতিব মাওলানা আদনান মাসউদ বলেন, অস্বাভাবিক বেত্রাঘাত না করে পড়াশোনার আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি করতে শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকের সম্মিলিত ভূমিকা একান্ত প্রয়োজন। একজন আদর্শ শিক্ষক খুব সহজেই ছাত্রদের মাঝে জাগিয়ে তুলতে পারেন পড়াশোনার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আদর্শ পাঠদান ও নিবিড় পরিচর্যা পেলে পড়াশোনা ছাত্রের নেশায় পরিণত হয়। এক্ষেত্রে ছাত্রের সাথে শিক্ষকের সম্পর্কের ধরনটাও গুরুত্বপূর্ণ। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভয়–এ তিন উপকরণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে আদর্শ ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক।
পড়াশোনা আনন্দদায়ক হওয়ার জন্য উপযোগী ও প্রাণবন্ত পরিবেশ একান্ত অপরিহার্য। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের মুখ্য ভূমিকা রাখতে হয়। শিক্ষার্থীরা যেন সুস্থ প্রতিযোগিতার আনন্দের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে পরিচালকদের। পাশাপাশি অভিভাবকদের ভূমিকাটুকুও গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান যেন পড়াশোনায় প্রাণবন্ত হয়, সেজন্য অভিভাবকদের দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল হওয়া চাই। সন্তানের মধ্যে স্বপ্ন জাগিয়ে তোলার কাজটি মা-বাবার মতো সফলভাবে আর কে করতে পারবেন!
বেত্রাঘাত ছাড়া ভিন্ন উপায়ে শিক্ষার্থীদের থেকে পড়া আদায় করতে কয়েকটি করণীয় রয়েছে। ১. পড়াশোনাকে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসায় পরিণত করা। এতে করে এক প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে। ২. পাঠদানের পদ্ধতি হতে হবে আদর্শ ও সহজবোধ্য। ৩. ছাত্রদের পারস্পরিক সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা।
৪. বিভিন্ন স্তরে সাফল্যের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে পুরষ্কৃত করা। ৫. শ্রেণী শিক্ষক এবং দারুল ইকামাহ বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা নিশ্চিত করা। ৬. সর্বোপরি ছাত্রদের মাঝে শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের প্রভাব তৈরি হওয়া। বেতের শাসনের চেয়ে ব্যক্তিত্বশীল শিক্ষকের সামান্য ধমক অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
৭. ছোট শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে শিক্ষকের নিয়মতান্ত্রিক উপস্থিতি খুবই জরুরী। এতে করে অনেক সমস্যা রোধ করা সহজ হয়ে যায়। ৮. ছাত্রদের মেধার তারতম্য বিচার করে সে অনুযায়ী তাদেরকে সময় দেয়া। তুলনামূলক কম মেধাবীদের প্রতি বিশেষ যত্নশীল হওয়া। ৯. শাসনের প্রয়োজন হলে বেতের ব্যবহার না করে শরীয়তের সীমায় থেকে অন্যান্য উপায় অবলম্বন করা।
১০. উপরোক্ত পদ্ধতিসমূহে সংশোধন না হলে প্রয়োজনে বিভাগীয় প্রধান, মাদরাসার দায়িত্বশীলবৃন্দ এবং অভিভাবকদের শরণাপন্ন হওয়া যায়। এভাবে অনেক সময় ভালো পরিবর্তন পাওয়া যায়। ১১. এরপরেও সংশোধন না হলে অভিভাবককে মাদরাসা পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়া। ১২. সর্বোপরি এ বিষয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কঠোর ভূমিকাও নেয়া দরকার, যেন শিক্ষকরা এ জাতীয় বেত্রাঘাতের শাস্তিপ্রদান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে।
৩। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের অস্বাভাবিকভাবে বেত্রাঘাত বিষয়ে ইসলাম কী বলে?
অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সাধারণ মাত্রার স্বাভাবিক বেত্রাঘাতেরই কোনরূপ বৈধতা নেই। কারও ক্ষেত্রে একান্তই অন্যকোন উপায়ে শাসন ফলপ্রসূ না হলে শুধু হাত দ্বারা তিনবার প্রহার করা যাবে। এবং সেটি অবশ্যই মাথা ও চেহারা ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গে সহনীয় মাত্রায় হতে হবে। রাগের মাথায় এ জাতীয় শাসনের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে শাসনকারীর একমাত্র উদ্দেশ্য থাকবে– ছাত্রের সংশোধন। রাগ, ক্ষোভ, বিরক্তি বা এ জাতীয় চিন্তা থেকে অবশ্যই সম্পূর্ণ মুক্ত থেকেই শাসন করতে হবে।
অন্যথায় হাশরে চূড়ান্ত বিচারে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। অস্বাভাবিক বেত্রাঘাতের কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে তো জরিমানা বা দণ্ডের কথাও ফিকহের কিতাবগুলোতে এসেছে। এ বিষয়ে আরবী ও উর্দু ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবসমূহে 'হুদুদ' ও 'তা'যীর' অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা এসেছে। ফাতাওয়ায়ে শামীসহ উর্দূ ভাষায় রচিত 'ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া' ও 'ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম যাকারিয়া'য় সুবিন্যস্ত আলোচনা রয়েছে।
সর্বশেষ কথা– হিফয ও নূরানী বিভাগের কোমলমতি শিশুদের বেত্রাঘাতের যে চিত্রগুলো আলোচনায় ওঠে আসছে, এটি শুধু কওমী মাদরাসার জন্য নয়, সমগ্র ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য মারাত্মক শংকার বিষয়। আগামী প্রজন্ম এতে করে কুরআন থেকে, কুরআনী শিক্ষা থেকে ব্যাপকভাবে বিমুখ হয়ে উঠতে পারে।
এজন্য সকল বিভাগের, বিশেষ করে হিফয ও নূরানীর উস্তাযদের তাদরীব বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ একান্ত অপরিহার্য। এসকল তাদরীবে ছাত্র শাসনের পদ্ধতি বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দরকার।
-এটি