তোফায়েল গাজালি
গবেষক আলেম ও চিন্তক
শিক্ষার সঙ্গে শাসনের গভীর সর্ম্পক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শাসন মানে বেধড়ক মারপিট, কথায় কথায় ধমক আর অকথ্য গালাগালি নয়। শাসন মানে কাঙ্ক্ষিত কাজের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী করে তোলার বিশেষ কৌশল অবলম্বন। কেউ খুব ভালো করে কোন কিছু শিখেছে অথচ তাকে বিন্দুমাত্র শাসনের মুখোমুখি হতে হয়নি সেটি বিরল।
কোলের শিশু রাতে বার বার জেগে উঠলে মা বলে, ‘ঘুমাও! না হয় ভূত আসবে।’ এটা এক প্রকার শাসন। ক্লাস টিচার পড়াতে যেয়ে কতক্ষণ পরপর বলেন, পড়! পড়! এটাও শাসন।
খেলার মাঠে অধিনায়ক বলেন, তোমাকে দিয়ে হবে না। এটাও শাসন। বাসের ড্রাইভার হেলপারকে বলেন, আগামী কাল থেকে তোর কাজে আসতে হবে না। এটাও শাসন।
শিক্ষার্থীকে কাজের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী করে তুলতে সব কাজেই রয়েছে নির্ধারিত শাসননীতি। তবে শাসনের কাজটি খুবই জটিল ও কঠিন। এর জন্য গভীর বিচার-বিবেচনা দরকার। স্থান-কাল-পাত্র-মাত্রা ইত্যাদির দিকে লক্ষ রাখা দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রাখা হয় না। ফলে সন্তান অনুগত হয় না। ছাত্রের জীবন ধ্বংস হয়। খেলোয়াড় আর হেলপারের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়।
সেভাবে এ কাজ আমার নয়। আমাকে দিয়ে এ হবে না। কেবল মাত্রাতিরিক্ত শাস্তির কারণে কত শিক্ষার্থী অকালে ঝরে পড়ে তার হিসাব হয়তো কেউ কোন দিন করেনি।
আমরা অনেকে জানি না যে, স্নেহ-মমতা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা কর্মীকে কাজে উদ্দীপ্ত করে। শিক্ষার্থীকে করে আপন কাজে যত্নশীল ও দায়িত্ববান।
কাজেই প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে যথাসম্ভব শিক্ষার্থীদের আনন্দের মধ্যে রাখতে হবে। শিক্ষার্থী থেকেই তো ভুল হবে। তাকে বোঝাতে হবে নরম কোমল ভাষায়। দরদী মন নিয়ে তাকে শাসন করতে হবে।
নবি করিম সা. শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে কত চমৎকার আচরণ করেছেন তা সীরাত ও হাদিসের কিতাবে কত সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে।
একজন বেদুইন মসজিদে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে থাকলে উপস্থিত লোকজন তাকে বাধা দিতে চাইল। রাসূল সা. তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, তার কাজ সারতে দাও।
তারপর তিনি পানি এনে নিজেই তাতে ঢেলে দিলেন এবং বেদুইনকে ডেকে নম্র ভাষায় নসিহত করে বললেন, এটা মসজিদ। এখানে পেশাব করা বা ময়লা ফেলা যায় না, বরং এটা আল্লাহর জিকির, সালাত আদায় এবং কোরআন তেলাওয়াতের জায়গা (মুসলিম)। তিনি তাকে একটি ধমক পর্যন্ত দিলেন না। এই ছিল আমাদের আদর্শ, মহানবীর (সা.) শিক্ষা দানের পদ্ধতি।
আনাস (রা.) বলেন, ‘দশ বছর রাসুলের খেদমত করলাম, কখনও উহ্ শব্দ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেননি। এ কাজটি কেন করেছ বা কেন করনি, এমন প্রশ্ন কখনও করেননি’ (শামায়েল)।
এ সব হাদিস থেকে আমরা কতটুকু শিক্ষা গ্রহণ করেছি? বড় জোর দু-চারটি মাসয়ালা খুঁজে বের করেছি। এটুকুই। এর ভেতর যে চারিত্রিক নির্দেশনা ও শিক্ষাদানের নীতি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে তা বরাবরই এড়িয়ে চলি আমরা।
শিক্ষাদানের কালজয়ী এ পদ্ধতি আজ উন্নত বিশ্বের শিক্ষাঙ্গনে শতভাগ বাস্তবায়ন হয়। কিন্তু আফসোস! আমরা মুসলিম হওয়া সত্বেও আমাদের নবির নির্দেশনা অনুসরণ করছি না। আমাদের দেশের স্কুল-মাদরাসাগুলো আজ পর্যন্ত এ আদর্শ পরিপুর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।
মনে রাখতে হবে সংশোধনের জন্য একটু বোঝানো সোজানো বা একটি চোখ-রাঙানিই যথেষ্ট হতে পারে। তাও কাজ না হলে একটু তিরস্কার করা যেতে পারে।
নবি করিম সা. কখনও কখনও এটা করেছেন। তবে এমন কোনও পরিবেশে তিরস্কার করা ঠিক নয়, যা শিক্ষার্থীর জন্য অপমানকর। এ কারণে কানে ধরানোর শাস্তিও ঠিক নয়। এটা মারাত্মক অপমানকর।
শিক্ষার্থীকে মনোযোগী করার জন্য একটা উত্তম ব্যবস্থা হল সাময়িক কথা বন্ধ করে দেওয়া। ‘তুমি পড়া দাওনি? দুষ্টুমি কর! যাও তোমার সঙ্গে কথা নেই’।
নবীজিও সা. তাবুকের যুদ্ধ যোগদানের ব্যাপারে যে তিন সাহাবীর গড়িমসি করেছেন, তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলা বন্ধ করে দিয়ে ছিলেন। তবে এসব প্রয়োগের আগে ভেবে দেখতে হবে, কেবলই নিজের কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় রাগ হয়ে এসব করছেন না তো!
এসবের উদ্দেশ্য মহৎ ও শিক্ষার্থীর জন্য কল্যাণকর হতে হবে। তাহলেই আমাদের শিক্ষাঙ্গণ পরিণত হবে আলোর ভুবনে। আলোকিত মানুষ হবে আমাদের প্রজন্ম।
লেখক: পরিচালক, আল কোরআন ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
এমডব্লিউ/