সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মুহাররম মাস: পালনীয়-বর্জনীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাওসার আইয়ুব।।

হিজরি সনের প্রথম মাস মুহাররম। চন্দ্র মাসের সূচনাটাও মুহাররম দিয়ে শুরু হয়। মুহাররম মানে একটি নতুন বর্ষ। জীবনের আরেকটি নতুন অধ্যায়। মুসলিম উম্মাহর কাছে এই মাস নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। শরিয়ত ও ইতিহাস, উভয় বিবেচনায় মাসটির তাৎপর্য রয়েছে অনেক। এর সাথে মিশে আছে ইতিহাসের বহু আক্খান ও নানা ঘটনা। উম্মতে মুহাম্মদিসহ পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবী রসুলের স্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এই মাসে।

মুহাররম মাসের ফজিলত রয়েছ অনেক। মুহাররম অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে এ মাসকে ঘিরে, সঙ্গে সঙ্গে এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল, এসব কারণেই এ মাসটি মর্যাদাপূর্ণ। তাই এ মাসের নামকরণ করা হয়েছে মহররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস।

মুহাররম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২, যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। ’ –সূরা তওবা: ৩৬

অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে আল্লাহ তায়ালা ১২টি মাস নির্ধারণ করে দেন। তন্মধ্যে চারটি মাস বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।

ওই চারটি মাস কী কী? এর বিস্তারিত বর্ণনা হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিকভাবে (অর্থাৎ জিলকদ, জিলহজ ও মহররম) এবং চতুর্থ মাস মুজর গোত্রের রজব মাস। -সহিহ বোখারি: ৪৬৬২ ও মুসলিম: ১৬৭৯

এই মাসকে কেন্দ্র করে কিছু কুসংস্কার, ভুল বিশ্বাস ও ভিত্তিহীন কাজের চর্চা রয়েছে মুসলিম সমাজে; তবে ভিত্তি নির্ভর কিছু আমলও রয়েছে।

এ মাসে পালনীয় তিনটি আমল: ১.রোজা রাখা। এ আমল সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আশুরা উপলক্ষে দুই দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। দশে মহররমের আগে পরে এক দিন বাড়িয়ে রোজা রাখার কথা হাদিস শরিফে এসেছে। ইসলামে আশুরার রোজার বিশেষ গুরুত্ব আছে। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল।

এর ফজিলত সম্পর্কে রাসুল সা:বলেছেন, ‘আমি আশা করি, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ পূর্ববর্তী বছরের কাফফারা করবেন’ (মুসলিম-৮১৮)।

জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) আমাদের (রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে) আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। আর এ বিষয়ে তিনি নিয়মিত আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না, নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না।’ (মুসলিম, হাদিস : ১১২৮)

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে রাসুল (সা.)-কে সেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতে দেখিনি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০০৬, মুসলিম, হাদিস : ১১৩২)। তাই এর পূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ। এ ছাড়া অসংখ্য হাদিসে আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

আশুরার রোজার পদ্ধতি: মুসলিম শরিফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, 'তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। -সহিহ মুসলিম: ১১৩৪

২.পরিবারের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করা।

আরেকটি আমল বর্ণনা সূত্রে দুর্বল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আর তা হলো, আশুরার দিনে যথাসাধ্য খাবারে প্রশস্ততা প্রদর্শন করা। যথাসম্ভব ভালো খাবার খাওয়া। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারে প্রশস্ততা প্রদর্শন করবে, সে সারা বছর প্রশস্ততায় থাকবে।’ (তাবরানি, মুজামে কবির, হাদিস : ১০০০৭; বায়হাকি, হাদিস : ৩৭৯৫)

এ হাদিসের বর্ণনা সূত্রে দুর্বলতা আছে। তবে ইবনে হিব্বানের মতে, এটি ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের হাদিস। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর দাবি, রিজিকে প্রশস্ততার ব্যাপারে কোনো হাদিস নেই। এটি ধারণাপ্রসূত। ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন, এটি বিশুদ্ধ হাদিস নয়। তবে এ বিষয়ে একাধিক বর্ণনা থাকার কারণে ‘হাসান’ হওয়া অস্বীকার করা যাবে না। আর ‘হাসান লিগাইরিহি’ পর্যায়ের হাদিস দ্বারা আমল করা যায়। (আস-সওয়াইকুল মুহরিকা আলা আহলির রফজি ওয়াদ দালাল ওয়াজ জানদিকা : ২/৫৩৬)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহপাক পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন। -তাবরানি: ৯৩০৩

উল্লিখিত হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওযিসহ অনেক মুহাদ্দিস আপত্তিজনক মন্তব্য করলেও বিভিন্ন সাহাবি থেকে ওই হাদিসটি বর্ণিত হওয়ায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতিসহ অনেক মুহাক্কিক আলেম হাদিসটিকে গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। -জামিউস সগির: ১০১৯

অতএব যদি কেউ উপরোক্ত হাদিসের ওপর আমল করার উদ্দেশ্যে ওই দিন উন্নত খানাপিনার ব্যবস্থা করে, তাহলে শরিয়তে নিষেধ নেই। তবে স্মরণ রাখতে হবে, কোনোক্রমেই যেন তা বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনের স্তরে না পৌঁছে।

৩. নবীর পরিবারের জন্য দোয়া পাঠ করা

আরেকটি আমল যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত। আর তা হলো, আহলে বাইত তথা নবীর পরিবারের সদস্যরা শাহাদাতের কারণে তাঁদের জন্য দোয়া করা, দরুদ পড়া এবং তাঁদের কাছ থেকে সত্যের ওপর অটল থাকার শিক্ষা গ্রহণ করা। এই তিনটি কাজ ছাড়া আশুরায় অন্য কোনো আমল নেই।

কিছু গর্হিত ও বর্জনীয় কাজ: শিয়াদের অনুসরণে কিছু মুসলমানও অগ্ঞতাবশত ১০ মুহররমে গর্হিত ও শিরকি কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা শাহাদতকে কেন্দ্র করে ইসলামি আদর্শ, নবজীর সুন্নাত ও আহলে বাইতের শিক্ষা পরিহার করে শিয়ারা মাতম ও জুলুস করে। বিভিন্ন হারাম কাজে লিপ্ত হয়। এবং তাজিয়ার মতো শিরকি কাজ করে থাকে । এগুলো আহলে বাইতের মহব্বতে করে। অথচ শিয়াদের কিতাবাদিতেও এগুলো আহলে বাইতের শিক্ষার পরিপন্থী বলা হয়েছে। (নির্বাচিত প্রবন্ধ, আ.মলেক)

আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে এ সকল গর্হিত কাজ থেকে হেফাজত করেন। এবং সঠিক বুঝ দান করেন। আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ