শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সুদ আর মুনাফা এক নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সুহাইল আবদুল কাইয়ূম।।

ইসলামপূর্ব যুগে নির্ধারিত মেয়াদে ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে ক্রেতা বিক্রেতাকে সময় বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করতো এবং অতিরিক্ত সময় দেওয়ার বিনিময়ে তাকে সুদ প্রদানের প্রস্তাব করতো। এতে বিক্রিতা সম্মত হতো। এভাবে পাওনা পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়াকে ইসলাম যখন সুদরূপে চিহিৃত করে একে হারাম ঘোষণা করলো তখন ইয়াহুদীরা আপত্তি করলো, ‘বেচা-কেনার শুরুতে মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত লাভ নেওয়া আর মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সময়ানুপাতে অতিরিক্ত লাভ নেওয়া একই কথা। তখন পবিত্র কুরআনে এ মন্তব্যের কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে।

ঘোষনা করা হয়েছে ‘যারা সুদ খায় তারা তার মতো, যার উপর শয়তান ভর করেছে। এটা এ কারণে যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় (বেচাকেনা) তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। -সূরা আলেইমরান : ২৭৫। তাফসীরে ইবনে আবী হাতিম : ২/৪৫৪।
অনেকে মনে করেন, বিশেষ করে যারা সুদের সাথে জড়িত তারা মনে করেন, সুদ আর মুনাফা একই জিনিস। এতদুভয়ের মাঝে উলে­খযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। উনিশ আর বিশ। সুদ সরাসরি খাওয়া হয় আর মুনাফা একটু ঘুরিয়ে খাওয়া হয়। তাদের ধারণা সঠিক নয়। মূলত এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে বিরাট পার্থক্য।

সুদ শরিয়তে হারাম। আল্লাহ তাআলা সুদের ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন ‘তোমরা যদি সুদ পরিত্যাগ না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। -সূরা বাকারা : ২৭৯। লানত ও অভিসম্পাত করেছেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) সুদের কারবারে সাথে সম্পৃক্ত সকলের প্রতি।

হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীস রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সুদের মধ্যে সত্তরটি পাপ রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বনিম্ন পাপ হচ্ছে, নিজের মায়ের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হওয়া।- ইবনে মাজাহ : হাদীস নং-২২৭৪। পক্ষান্তরে শরিয়ত সমর্থিত পন্থায় অর্জিত অর্থ তথা মুনাফা হালাল। এর উপার্জনকারী সাওয়াবের অধিকারী। তাঁর প্রতি থাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর রহমতের দৃষ্টি।

অনেক ক্ষেত্রে সুদ আর মুনাফা বিষয় দুটিকে এক মনে হলেও এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে মৌলিক ও পদ্ধতিগত পার্থক্য। গভীরভাবে চিন্তা না করলে এ পার্থক্য অনেক সময় বুঝা যায় না। বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমে দীন আল্লামা ড. ইউসুফ কারযাবী।
এক ব্যক্তি জনসম্মুখে এক ব্যক্তিকে যদি বলে, ‘আপনি আপনার মেয়েটিকে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য আমার কাছে সমর্পণ করুন।

এর বিনিময়ে আমি তাকে এক লাখ টাকা দিবো।’ লোকটি এবং তার মেয়ে যদি এ প্রস্তাবে রাজি হন তাহলে তারা যে কাজটি করবেন তা হবে একটি জঘন্য অপরাধ। পক্ষান্তরে লোকটি যদি অন্যভাবে বলেন, ‘আপনি আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিন। তাকে মোহরানাস্বরূপ এক লাখ টাকা আমি দিবো।’ লোকটি এবং তার মেয়ে যদি এ প্রস্তাব গ্রহণ করে তাহলে তাদের সম্পাদিত কাজটি হবে মহৎ কাজ। শরয়ী পরিভাষায় এ মহৎ কাজটিকে বলা হয় বিয়ে। কারো কাছে মনে হতে পারে, এ দুটির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু, একটিতে বিয়ে ও মোহরানা শব্দ দুটি নেই, অপরটিতে আছে।

হ্যাঁ, এ সামান্য পার্থক্যের কারণেই একটি হালাল আরেকটি হারাম। একটি সাওয়াবের কাজ অপরটি গুনাহের কাজ। যে ব্যক্তি শরিয়ত মানে সে কখনো বিয়ে ও ব্যভিচারকে এক বলতে পারে না। একটি সম্পাদন হয়েছে শরয়ী পন্থায় অপরটিতে শরিয়ত মানা হয়নি। দুনিয়াবী অনেক লেনদেনও এ ধরনের সামান্য পার্থক্যের কারণেই একটি হারাম হয়, অপরটি হালাল হয়। একটি শরিয়তে প্রবল কাম্য হয়, অপরটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হয়। বাহ্যিকভাবে বর্ণিত প্রস্তাব দুটিতে কোনো পার্থক্য দৃষ্টিগোচর না হলেও কার্যত দুটির মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। সামান্য চিন্তা করলে জ্ঞানী মাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন, যে প্রস্তাবটিতে বিয়ের কথা উলে­খ নেই, সেখানে নারী-পুরুষটির মধ্যে কোনো দায়-দায়িত্বের সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে যে প্রস্তাবটিতে বিয়ের কথা রয়েছে, সেখানে প্রস্তাব কবুল করার সাথে সাথে উভয়ের উপর অনেক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে।

তদ্রƒপ অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যত এক মনে হলেও সুদ আর মুনাফার মধ্যে মৌলিক অনেক পার্থক্য থাকে। যেমন সুদের ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতা ও ঋণদাতা সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না। কিন্তু মুনাফার মধ্যে অর্থদাতা ও অর্থগ্রহীতার মধ্যে অনেক দায়-দায়িত্ব থাকে। ঋণ দিয়ে সুদ নেওয়ার চুক্তির মধ্যে সর্বাবস্থায় তাকে সুদ দিতে হয়। পক্ষান্তরে ইসলামী বিনিয়োগে অর্থগ্রহীতা তার ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে অর্থযোগানদাতা লভ্যাংশ পায় না। বরং ক্ষতির ভার তাকে নিতে হয়।
এ সব দায়িত্ব নেওয়ার কারণেই আয়-উপার্জন সুদ না হয়ে মুনাফা হয়। অতএব সুদ আর মুনাফার মধ্যে যতই মিল খোঁজার চেষ্টা করা হোক না কেন কিংবা যতই সাদৃশ্য পাওয়া যাক না কেন, দুটি কখনো এক নয়। সুদ হারাম আর মুনাফা হালাল।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেকেই এ পার্থক্য বুঝতে চান না। সামান্য ঘুরিয়ে খাইতে চান না। তাঁদেরকে শরয়ী লেনদেনের কথা বললে তাঁরা উড়িয়ে দেন। তারা দীনদার শ্রেণীর কথাকে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারেন। অনেক সময় এমন বাক্য উচ্চারণ করেন, যার কারণে ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরূপ মানসিকতা পরিহার করা আবশ্যক। নিজেকে শরিয়তের কাছে সঁপে দিতে হবে। তাহলে অর্জিত হবে ইহকালীন ও পরকালীন সমূহ কল্যাণ।

লেখক: শিক্ষাসচিব ও সহকারী মুফতী, জামিআ ইসলামিয়া ঢাকা, কাজলা ব্রীজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ