মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
মানব জীবনে দুশ্চিন্তা আসা খুবই স্বাভাবিক। এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এতে হতাশ হলে চলবে না। এমন মানুষ পাওয়া কঠিন, যার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানুষের জীবন। ইহকালীন জীবনে কষ্ট-ক্লেশ মানুষের সঙ্গী। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে।’ (সুরা বালাদ, আয়াত : ৪)
তাই জীবনে চলার পথে কখনো দুঃখ-দুর্দশা আসতেই পারে। হতে পারে মানসিক টেনশন। এতে হতাশ হওয়া যাবে না। বরং আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে প্রতিটি পরিস্থিতিকে জয় করে নিতে হবে। নিম্নে এমন কিছু আমল তুলে ধরা হলো, যার মাধ্যমে দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
১. তাকদিরের ওপর বিশ্বাস: ইসলাম তার অনুসারীদেরকে তাকদিরের ওপর ঈমান রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। যখন একজন মানুষের নিশ্চিত বিশ্বাস থাকে যে, আমার ভাগ্য আল্লাহর হাতে। আমার জন্য যা উত্তম তিনি তা আমার সৃষ্টির পূর্বেই লিখে রেখেছেন। সে অনুসারেই দুনিয়ার জীবনে সুখ-দুঃখের সম্মুখীন হতে হয়। ভালো কি মন্দ সবই তাঁর পক্ষ থেকেই আসে। আসমানের ফয়সালায় যখন কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট হওয়া শেখে। তখন সব রকম পেরেশানি, মানসিক চাপ শেষ হয়ে যায়। তখন প্রতি মুহূর্তে সে ভাবে এটাই আমার ভাগ্যে ছিল। এর মধ্যেই আমার কল্যাণ নিহিত। এই তাকদিরে বিশ্বাস রাখার মাধ্যমে মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটে। টেনশন, পেরেশানির মধ্যেও এমন মানসিক প্রশান্তি অনুভব হয় যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদের ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই...। (সূরা ইউনুস, আয়াত : ১০৭) আর আল্লাহ মুমিনদের আগেই বলে দিয়েছেন, তোমরা তোমাদের দায়িত্ব আদায় কর। তোমাদের যে পেরেশানী আসবে ওটা তো আমি আগেই সিদ্ধান্ত করে রেখেছি। তোমাদের যে দুঃখ-দুর্দশা আসবে, পৃথিবীতে যে ব্যাপক পরিবর্তন হবে এর কারণে চিন্তিত হবে না। আমি তোমাদের আরাম ও শান্তির ব্যবস্থা করব বাকি তোমরা সীমালঙ্গণ করবে না। কোরআনের ভাষায়, ‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় আসে আমি ইহা সংঘটিত করার পূর্বেই ইহা লিপিবদ্ধ থাকে; আল্লাহর পক্ষে ইহা খুবই সহজ।’ (সূরা হাদীদ, আয়াত : ২২)
২. আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ: মানসিক টেনশন কমাতে আল্লাহর ব্যাপারে সু-ধারণা পোষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক, আয়াত : ৩)
রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আমি সেরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে।’ (বোখারি, হাদিস : ৬৯০১)
৩. নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া: যেকোনো বিপদ-মুসিবত, পেরেশানির সময় নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল সা. কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে নামাজ আদায় করতেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৩১৯) সাহাবায়ে কেরামও এ আমলে অভ্যস্ত ছিলেন। ছোট থেকে ছোট কোনো বিষয়ের জন্যও তারা নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলেও নামাজের মাধ্যমে সমাধা করতেন।
৪. বেশি বেশি ইস্তেগফার: মানসিক চাপ কমাতে ইস্তেগফারের জুড়ি নেই। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও, তিনি তো মহাক্ষমাশীল। (ফলে) তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে।’ (সূরা নূহ, আয়াত : ৭১)
রাসুল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫২০)
৫. অধিক হারে দুরুদ পড়া: দুরুদ পাঠ আল্লাহ তায়ালার রহমত প্রাপ্তির বিশাল মাধ্যম। আত্মপ্রশান্তি লাভের সহজ উপায়। এটি এমন আমল যা সর্বদা কবুল হয়। কোরআন তিলাওয়াত করলে আল্লাহতায়ালা তা কবুল করতে পারেন আবার কবুল নাও করতে পারেন। কিন্তু দুরুদ শরিফ এমন একটি মাকবুল আমল যা পাঠ করলেই আল্লাহতায়ালা তা কবুল করে নেন।
উবাই ইবনে কা’ব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনার ওপর অনেক বেশি দুরুদ পাঠ করতে চাই। আপনি বলে দেন আমি দুরুদে কতটুকু সময় দেব? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও! আমি বললাম এক চতুর্থাংশ সময়? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও, যদি আরো বাড়াও তোমার জন্যে ভালো। আমি বললাম অর্ধেক সময়? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু সময় পড়তে পার, যদি এর চেয়ে আরো সময় বাড়াও তোমার জন্যে ভালো। আমি বললাম, তাহলে সময়ের দুই তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, তুমি যতটুকু চাও, যদি আরো বাড়াও তোমার জন্যে ভালো। আমি বললাম, সম্পূর্ণ সময় আমি আপনার ওপর দুরুদ পাঠ করায় রত থাকব। তখন তিনি বললেন, তাহলে এখন হতে তোমরা পেরেশানি দূর হওয়ার জন্য দুরুদই যথেষ্ট এবং তোমার পাপের কাফফারার জন্য দুরুদই যথেষ্ট।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৭)
৬. ধৈর্য ধারণ: ধৈর্য ধারণ করতে পারলে সব সময় সব হালতে প্রসন্ন থাকা যায়। খুব পেরেশানি ও সঙ্কীর্ণ অবস্থাতেও জীবন থেকে হতাশ হতে হয় না। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের জায়গায় জায়গায় ধৈর্য ও তাওয়াক্কুলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের এক জায়গায় এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৫৩) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যে কেউ আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার কাজ পূরণ করেই থাকেন। (অবশ্য) আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’ (সুরা তালাক, আয়াত : ৩)
৭. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ: ইসলামে পরামর্শের গুরুত্ব অনেক। আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব পরিহার করে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শভিত্তিক কাজ করা ইসলামের শিক্ষা। তবে পরামর্শের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-পরামর্শ যথার্থ এবং বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন নির্ভরযোগ্য মানুষের সঙ্গে করা। পরামর্শের কারণে অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীলদের চিন্তাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর অভিজ্ঞদের চিন্তার প্রভাবে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাও গভীর হয়, সমৃদ্ধ হয়। পেরেশানি, মানসিক টেনশন তো বহু দূরে পালায়।। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি পরামর্শ কামনা করে সে অকৃতকার্য হয় না।’
৮. দোয়া করা: মানসিক চাপ কমাতে নিয়ম করে দোয়া করা উচিত। কারণ দোয়া হলো ইবাদতের মূল। দোয়া করলে আল্লাহ খুশি হন। না করলে বরং অসন্তুষ্ট হন। তবে দোয়ার ক্ষেত্রে হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। রাসুল সা. বলেন, আমি এমন একটি দোয়া সম্পর্কে অবগত আছি, কোনো বিপদগ্রস্ত লোক তা পাঠ করলে আল্লাহতায়ালা তার সেই বিপদ দূর করে দেন। সেটি হচ্ছে আমার ভাই ইউনুস আ.-এর দোয়া। দোয়াটি হলো-‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বলিমিন।’
অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫০৫)
চিন্তা ও পেরেশানির সময় রাসুল সা. একটি বিশেষ দোয়া পড়তেন। দোয়াটি হলো-‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউযু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউযু বিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার আশ্রয় নিচ্ছি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অপারগতা ও অলসতা থেকে, কৃপনতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকে।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, ৪৩ নবাব সলিমুল্লাহ রোড, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
-এএ