সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘দরসে নেজামি ওহি নয়; পরিবর্তন করা যাবে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ।।
পরিচালক: শায়েখ যাকারিয়্যা ইসলামি রিসার্চ সেন্টার

কওমি মাদরাসায় প্রচলিত দরসে নেজামি মোল্লা নেজামুদ্দিন সেহালভী রহ. এর দেয়া একটি নেসাব বা সিলেবাস। এ সিলেবাসের প্রণেতা মোল্লা নেজামুদ্দিনের ইন্তেকাল ১১৬১ হিজরিতে। পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে বলা যায় তার  আসল সম্পর্ক আফগানিস্তানের সাথে। তিনি ইউপির সেহালি নামক এক জায়গায় অবস্থান করতেন। বাদশাহ আকবর তাকে সেহালে অনেক বড় জায়গা দিয়েছিলেন ইলম শেখানোর জন্য।

তার কাছে আগত ছাত্রদের তিনি দশটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শিক্ষা দিতেন। পরবর্তিতে সেগুলোর নাম হয় দরসে নেজামি। মোল্লা নেজামুদ্দিন রহ. শাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর যুগেরই একজন বড় মুহাক্কিক আলেম ছিলেন। পরে বাদশাহ আলমগীর রহ. এর পারিবারিক একটি বড় গোলযোগের পর তাদের নিকটাভাজন নেজামুদ্দিন নামের একজন বড় বুযর্গ আলেমকে হত্যা করা হলে বাদশা আলমগীর মোল্লা নেজামুদ্দিনকে ফেরাঙ্গী মহল তৈরি করে দেন। ইলম শেখানোর মারকাজ হিসেবে এ ফেরাঙ্গী মহল উপমহাদেশে পরিচিতি অর্জন করে। সেখান থেকে তৈরি হয়েছে আবদুল হাকিম ফেরাঙ্গী, আবদুল হক ফেরাঙ্গীর মত বড় বড় আলেম।

পরবর্তিতে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মাহদ্দিসে দেহলভী রহ. যখন মদিনা থেকে হাদিসের কিতাব পড়ে আসলেন তখনও দেওবন্দ সৃষ্টি হয়নি। দেওবন্দের আকাবিরগণ মোল্লা নেজামুদ্দিনের তৈরি সিলেবাসের উপর ভিত্তি করে পাঠদান শুরু করেন। তার সিলেবাসে নাহু, সরফ বালাগাত, রিয়াযিয়াত, হেকমত মান্তেক, ফালসাফাসহ আরো কয়েকটি বিষয় ছিলো। তাফসীর ইলমুল কালাম, উসুলে ফিকহও অন্তর্ভূক্ত ছিলো মোল্লা নেজামুদ্দিন রহ. এর সিলেবাসে।

মোল্লা নেজামুদ্দিন রহ. এর তৈরি সিলেবাসের উপর ভিত্তি করেই আমাদের আকাবির শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. সিলেবাস তৈরি করেন। পরিবর্তন পরিবর্ধন করে সিলেবাসকে ঢেলে সাজান। হাদিসের কিতাব সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করেন।

হাদিসের কিতাব ছিলো মিশকাত। পরে মোল্লা নেজামুদ্দিনের নেসাবের উপর ভিত্তি করে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর চিন্তা চেতনার উপর নির্ভর করে তৈরি হয় দরসে নেজামি। যখন দারুল উলুম দেওবন্দ তৈরি হয়, দেওবন্দ এ নেসাবই গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে পরিবর্তন করে। বিভিন্ন সময় তারা এ নেসাবের মধ্যে পরিবর্তন আনেন।

এ নেসাবের মূল বিষয় যেহেতু মোল্লা নেজামুদ্দিন রহ. এর। তাই এর নামও দরসে নেজামি রাখা হয়। আমরা বর্তমানে এ নেসাব কেই মোল্লা নেজামুদ্দিনের নেসাব, তালিমে নেজামি বা দরসে নেজামি বলে থাকি। তবে ইতিহাসে দেখা যায়, নানান সময়ে এ নেসাবের মধ্যে আমাদের আকাবিরগণ পরিবর্তন এনেছেন।

এদিকে তৎকালীন সময়ের বড় আলেম আল্লামা নজির হোসাইন রহ. তিনি আহলে হাদিসের একজন মুখপাত্র ছিলেন। আর আমাদের মাজহাব মতবাদের বড় আলেম ছিলেন আল্লামা আবদুল গণী। তাদের দুইজনের ভিন্ন দুটি দরস গাহ ছিলো। তারা বহু তালিবে ইলমকে দরস দিতেন।

হাদিস পড়াতে গিয়ে আল্লামা নজির হোসাইন হাদিসকে ফিকহে হানাফির বিপরিতে দাঁড় করাতেন। এভাবে আলোচনা করতে করতে ভারত উপমহাদেশে হাদিসকে ফিকহে হানাফির বিপরিতে প্রসার হয়ে পড়ে। আল্লামা ইসহাক দেহলভী রহ. যখন হেজাজে হিজরত করে চলে গেছেন তখন এ সমস্যাটা দেখা দেয়। তখন শাহ আবদুল গণি মুজাদ্দিদি রহ. দেখান যে হাদিসের মধ্যে ফেকহের আলোচনা হবে। হাদিস আর ফেকহে হানাফি ভিন্ন কোনো বিষয় নয়। তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন আমাদের আকাবির আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, কাসেম নানুতভী রহ.।

এরপর এ সিলেবাস ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হয়ে দেওবন্দের নেসাবে তালিমে যুক্ত করা হয়। সিয়াহ সিত্তার হাদিসগুলোকে নেসাবভুক্ত করা হয়। এরও আরো পরে শরহে জামি পরিবর্তন করে শরহে ইবনে আকিল ঢুকানো হয়েছে।

আমি সামান্য এ উদাহরণ এজন্য টানলাম, যে অনেকে মনে করেন ‘দরসে নেজামি কাল ওয়াহয়ি’ ওয়াহির মত। এটাকে পরিবর্তন করা যাবে না। কথাটা যারা মনে করেন তারা সঠিক মনে করেন না। এ পর্যন্ত যুগের চাহিদা অনুযায়ী অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে এ নেসাব। স্বয়ং দেওবন্দের আলেমগণ যুগের চাহিদা অনুযায়ী এ পরিবর্তন করেন।

এ বিংশ শদাব্দিতে এসে আমাদের ছাত্রদের যুগউপযুগী আলেম হিসেবে তৈরি করতে হলে, অবশ্যই দেওবন্দের মূল নেসাবকে সামনে রেখে পারিবর্তন আনতে হবে। নেজামুদ্দিন রহ.সহ আমাদের আকাবিরগণ যেভাবে যুগের চাহিদা মত নেসাবকে ঢেলে সাজিয়েছেন আমাদেরও সেভাবে চিন্তা করে নেসাবকে ঢেলে সাজাতে হবে।

আপনারা শুনে খুশি হবেন বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষাবোর্ড বেফাক এ বিষয়গুলো চিন্তা করেই সিলেবাস ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেজন্য বিজ্ঞ আলেমদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ এ কমিটিতে আমার মত একজন অনবিজ্ঞকেও রাখা হয়েছে। সে নেসাব নিয়ে আমরা বেফাকের অফিসে অন্তত পাঁচটি মিটিং করেছি। দীর্ঘ এ মিটিংগুলোতে আমরা অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ নেসাবের মধ্যে মর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আমরা নেয়ার চেষ্টা করেছি। যেমন ইতিহাস ও ফিরাকে বাতেলা। তারিখে ইসলামি জানা না থাকলে আমাদের ভবিষ্যত অন্তকার। আরবি সাহিত্যের দুর্বলতাও আমরা অনুভব করেছি। আরেকটি বিষয় আছে ইসলামি রাজনীতি।

আমাদের বিজ্ঞ আলেমদের কমিটির মধ্যে সুন্দর একটি সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মজলিসে আমেলার মাধ্যমে এটি ফাইনাল করার কথা ছিলো। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে এটি পিছিয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ বেফাকের অবস্থা ভালো হলে বাংলাদেশের মাদরাসাগুলো অসাধারণ একটি নেসাব পাবে বলে আমরা মনে করি।

শ্রুতি লিখন-মুফতি আবদুল্লাহ তামিম

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ