মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এ ঈদের অন্যতম অনুসঙ্গ হলো একান্তভাবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু কোরবানি করা। কোরবানির বহু বিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো পশুর চামড়ার বিধান। এটাকে কোথায় কি করা করতে হবে, কি করা উত্তম-এটা অনেকেই জানেন না।
এ ব্যাপারে ইসলামী আইন বিশারদদের বক্তব্য হলো, কোরবানির পশুর চামড়ার মালিক কোরবানিদাতা, সে ইচ্ছা করলে যেকোনোভাবে তা দিয়ে উপকৃত হতে পারে। কাউকে হাদিয়াও দিতে পারে। অবশ্য পারিশ্রমিক ও বিনিময় হিসেবে দেওয়া যাবে না। যেমন জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া বা কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসাবে দেওয়া জায়েয হবে না।
চামড়া যদি দান করে দিতে চায়, তবে বিক্রি না করে আস্ত দান করাই উত্তম। চামড়া বিক্রি করা হলে, মূল্য সদকা করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করা যায়। সদকার নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়েয ও গোনাহ। নিয়ত যা-ই হোক বিক্রিলব্ধ অর্থ পুরোটাই সদকা করে দেওয়া জরুরি। সদকার ক্ষেত্রে হকদার হলো ফকির, মিসকিন তথা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত লোকজন। যদি এদের মধ্যে বাছাইয়ের প্রশ্ন আসে তবে তাদের মধ্যে আত্মীয়-স্বজন ও দ্বীনদাররা প্রাধান্য পাবে।
এতিমখানা সংবলিত দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের গরিব-অসহায় ছাত্রদের জন্য দেওয়াও খুবই ভালো। চামড়া বিক্রির অর্থ দিয়ে এতিম ও গরিব শিক্ষার্থীদের সারা বছরের পড়াশুনা, খাওয়া ও অন্যান্য খরচ চলে। এতে সওয়াব ইনশাআল্লাহ বেশি আশা করা যায়। তবে যেসকল দরিদ্র ব্যক্তি টাকা নিয়ে গোনাহের কাজে লাগাতে পারে বলে প্রবল আশংকা থাকে তাদেরকে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
পশু জবাইয়ের বিনিময় কিংবা বানানোর পারিশ্রমিক চামড়া বিক্রির পয়সা বা গোশত দিয়ে দেওয়া যাবে না। মসজিদ নির্মাণ, মেরামত কিংবা অন্য কোনো নেক কাজে এই অর্থ দান করা যাবে না। (রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৮)
জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরুহ। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩)
কোরবানির চামড়া আমাদের দেশের সম্পদ। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। সে হিসেবে চামড়া শিল্পের আরো উন্নয়ন করা দরকার। দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ আসে ঈদুল আজহায়। কোরবানিতে ভালো ও সুস্থ পশু জবাই হয় বলে এই চামড়ার মানও ভালো থাকে। ব্যবসায়ীদেরও এই চামড়া সংগ্রহে আগ্রহ থাকে। বিগত কয়েক বছর থেকেই চামড়ার দাম হতাশাজনক। আর এ বছর তো চামড়া বিক্রি করতে হবে পানির দামে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত চামড়ার যে মূল্য নির্ধারণ হয়েছে এতে মানুষ আশাহত হয়েছে। এখন এটাকে উপলক্ষ করে আমরা যদি চামড়াগুলো যত্রতত্র ফেলে দিই, তাহলে পরিবেশ দূষিত হবে। গরিব-অসহায় মানুষের যাও উপকার হতো তাও হবে না। ঠকবে দেশ, ঠকবে দেশের মানুষ।
এজন্য চামড়া ছাড়ানোর কাজে দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে হবে যাতে সুন্দরমতো তারা কাজটি সমাধা করতে পারে। চামড়ার সাথে যাতে গোশত লেগে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এতে করে চামড়া দ্রুত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর চামড়া ছাড়ানোর পর এটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এতে চামড়াও ভালো থাকবে, এর থেকে জীবানুও ছড়াবে না। আর জবাইয়ের পূর্বে পশুকে ভালোমতো গোসল করিয়ে নিতে হবে। এতে করে চামড়ার মান ভালো থাকবে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে- ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে পশু কোরবানি করা যেমন একটি ইবাদত, চামড়াসহ পশুর যাবতীয় উচ্ছিষ্টাংশগুলোকে সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার স্বার্থে ঐগুলোকে সুব্যবস্থাপনা করাও একটি ইবাদত। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ তাই আমাদের ঈমানি দায়িত্ব হলো সঠিকভাবে কোরবানির পশু জবাই করা এবং সব কাজ শেষে পশুর বর্জের সুব্যবস্থাপনা করা।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ