হাফেজ মাওলানা ইউসুফ নূর।।
ছেলেবেলা। আমি তখন মেখল মাদরাসায় পড়ি। যতটুকু মনে পড়ে, ওই সময়টাতে সর্প্রথম যে ম্যাগাজিনটি আমি হাতে নিই তার নাম মাসিক মদীনা। মেখল মাদরাসায় সাধারণত পত্রপত্রিকা পড়ার অনুমতি ছিল না! ব্যতিক্রম ছিল কেবল মাসিক মদীনা! এ পত্রিকা ছাত্র-উসতাদ আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। তখনকার সময়ে এটা একমাত্র ইসলামিক ম্যাগাজিন হিসেবে আমাদের কাছে সমাদৃত ছিল।
মাসিক মদীনার প্রশ্নোত্রর বিভাগটি ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। এ পত্রিকা পড়ে পড়েই বাংলাভাষায় কিছু লেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমাদের ভেতর। পাশাপাশি বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশে যদি ইসলামের দাওয়াতকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হয়, তবে বাংলাভাষায় দক্ষতা অর্জন করা জরুরী। এ কারণে মাওলানা মুহিউদ্দীন খাঁনের প্রতি তখন থেকেই আলাদা একটা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিল আমার।
যতটুকু মনে পড়ে, তাঁকে সর্বপ্রথম আমি দেখি ১৯৮৭ সালে। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজ ময়দানের একটি ইসলামি সম্মেলনে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। দু’ দিন ব্যাপী এ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আল্লামা আল্লামা তকি উসমানির উর্দু বক্তব্যের অনুবাদ ও করেছিলেন মাওলানা খান। তাঁর এ আলোচনায় স্বয়ং মাওলানা তকি ওসমানি সাহেব মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘মুহাব্বাত কি কুই জবান নেহি হোতা’! আমি মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের এ বয়ানের ভাষা না জানলেও বুঝে ফেলেছি যে, তিনি ইমান আফরোজ বয়ান কিয়া- ইমানদ্বীপ্ত একটি বক্তব্য রেখেছেন।‘ সত্যি তাঁর আলোচনা নিজভাষী শ্রোতাকে যেমন আকর্ষণ করত, তেমন মুগ্ধ করত ভিনভাষী শ্রোতাকেও।
লিখনীর ক্ষেত্রে তিনি একজন যুগস্রষ্টা, অন্যভাবে বললে ইসলামী সাহিত্যের জমিদারপুরুষ ছিলেন, আলোচনার ক্ষেত্রেও তাঁর জুড়ি মেলানো ছিল ভার। মেপে মেপে কথা বলতেন। তাঁর আলোচনার ভেতরে প্রেরণাও ছিল, পাশাপাশি কথা বলার আলাদা একটা স্টাইলও ছিল।
মাওলানা খানের বিশেষ অবদানটা অনুবাদ সাহিত্যে। বিশ্বের বড় বড় আলেমদের গ্রন্থাবলির সঙ্গে আমাদের তিনি পরিচয় করিয়ে গেছেন। তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনের অনুবাদটার কারণে গোটা জাতি আজ তাঁর কাছে ঋণী। সাহিত্য ক্ষেত্রে এ অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্থা ‘রাবেতাতুল আদবিল ইসলামি আল-আলমি ‘ তাঁকে তাদের বাংলাদেশ শাখার চেয়ারম্যান বানিয়ে ছিল। পাশাপাশি ‘রাবেতায়ে আলামি আল ইসলামি এর কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদ লাভ করেও তিনি আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলেন।
মাওলানা খাঁন সাহেবকে যে কারণে আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগত, তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে বিভাজনক পছন্দ করতেন না। আলিয়া ও কওমি ধারার মধ্যকার দূরত্বটাকে দূর করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। নিজের গোটা ছাত্রজীবন আলিয়া মাদরাসায় কাটালেও কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্যতা।
১৯৯৫’র শুরুর দিকে আমি উত্তরায় অবস্থিত সৌদি ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা পরিচালিত ইমাম আবু হানিফা ইনস্টিটিউটে স্বল্প মেয়াদী একটা কোর্স করেছিলাম। ওই কোর্স চলাকালীন ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি থেকে ফায়দা উঠিয়ে ‘ইহুদীবাদঃ তথ্য ও তত্বের আলোকে’ নামে একটি বই আমার কাঁচা হাত দিয়ে লিখেছিলাম। বইটির পান্ডুলিপি নিয়ে একদিন ভয়ে ভয়ে মাওলানা মুহিউদ্দীন খাঁনের অফিসে যাই!
আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘কী চাই?’
মূল বিষয়টা প্রথমে না বলে আমি উত্তর দিলাম, আপনার কাছে একটু বসতে চাই।
হুজুর মুচকি হেসে বসতে দিলেন। তারপর নানা বিষয় নিয়ে দিলখোলা আলাপ শুরু করলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি শুনছিলাম তাঁর আলোচনা। এই ফাঁকে সুযোগমতো আমার পাণ্ডলিপির ব্যাপারটা জানালাম তাঁকে। হুজুর পাণ্ডলিপির আদ্যোপান্ত পুরোটা একবার দু’বার তিনবার পড়লেন। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় সংশোধনী এনে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘ইহুদীবাদ সম্পর্কে আমাদের তরুণরা খুব বেশি কিছু জানে না। বইটা তাদের জন্য খুব উপকারী হবে।’
পাণ্ডুলিপি দেখার পর মাওলানা খাঁন তখনই একটা মতামত লিখে দেন। মদীনা ভবন থেকে সেদিন বেরোতে বেরোতে রাত হয়ে যায়। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। আমি ফেরার জন্য বিদায় চাইলে মাওলানা খাঁন বললেন, বাইরে বৃষ্টি তো! কিভাবে যাবে? বৃষ্টি থামুক, তারপর বেরোবে!
আমি তোমাকে সঙ্গ দেবো। এই বলে তাঁর গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন, তুমি খাবার খেয়ে নাও, আমার বেরোতে দেরি হবে।
বৃষ্টি থামাতে থামাতে সেদিন রাত একটা বেজে গিয়েছিল। মাওলানা খান পুরোটা সময় আমার সাথে গল্প করেছেন। বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়েছেন। আমার লেখালেখির হাত ভাল বলে প্রশংসাও করেছেন।
সে রাতে তিনি আমাকে অফারও করেছিলেন তাঁর অধীনে কাজ করার জন্য। কিন্তু আমার পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে আমাকে প্রবাস জীবনে পাড়ি জমাতে হয়েছিল বিধায় মাওলানা খাঁনের সে অফার আমি গ্রহণ করতে পারিনি। আজ আফসোস হয়, সেদিন তার কথা যদি আমি রাখতে পারতাম, তাহলে আজকে আমার জীবনের মোড় হয়তো অন্যদিকে থাকত।
তবু যা হয়েছে, যা পেয়েছি জীবনে আল্লাহ তায়ালার শোকরগোজারি করে শেষ করতে পারবো না। সেদিন মাওলানা খাঁনের উদারতা থেকে যে শিক্ষাটা আমি পেয়েছি, তা আজীবনের জন্য আমার প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছি। মাওলানা খাঁন কারো মধ্যে যোগ্যতা আছে দেখলে, তাঁর যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করে কাজে লাগাতেন। অযথা তাকে ইন্টারভিউ কিংবা পরীক্ষার সম্মুখীন করে হেনস্থা করতেন না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাওলানা খাঁন সফর করেছেন। বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রগুলো, আরব রাষ্ট্রের শাসকদের সাথে তাঁর গভীর সখ্যতা ছিল। কিন্তু তাদের ভোগবিলাসী জীবনযাপন তাঁকে একটু স্পর্শও করতে পারেনি। বেশভুষা চলাফেরা সবকিছুতে অনাড়ম্বরতা অবলম্বন করে গেছেন। এমনকি এত উঁচুমাপের একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্বেও মদীনা ভবনে তিনি যেখানে বসতেন, অফিসটা ছিল একদম সাদামাটা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর ইশক্ব ছিল প্রবাদতুল্য। নবিজিকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তাঁর লেখালিখি, সাহিত্য রচনা এসবের উৎসই ছিল সিরাতে রাসুল সা.।
যতটুকু মনে পড়ে,২০০২সালে পল্টনে মদীনা অফিসে তাঁর সাথে আমার শেষ সাক্ষাত হয়। তখন তিনি ঐতিহাসিক ফতোয়া আন্দোলনে কাতার প্রবাসী আলেমদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে প্রাণভরে দোয়া করেছিলেন। এরপরে একবার আমি তাঁকে কাতার ধর্মমন্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখানে আনার চেষ্টা করেছিলাম। সবকিছু কনফার্ম করে হুজুরকে ফোন দিলাম। কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমি তো এখন পঙ্গু হয়ে গেছি! হুইল চেয়ারে চলাফেরা করি। ডাক্তারের কড়া নিষেধ কোন ধরনের সফরে যেতে।
আমি নিরাশ হয়ে ফোন রেখে দিলাম। হুজুরের ওজরখাহিটাকে মেনে নিতে হলো, যেহেতু তিনি অসুস্থ। এজন্যে আমার একটা আফসোস থেকে গিয়েছে। ওই সময়টাতে হুজুরকে যদি কাতার আনতে পারতাম, তবে বাড়তি কয়টা দিন তাঁর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতাম।
২০১৬সালের ২৫ জুন ,১৯ রমজানে এ ক্ষণজন্মা মহামনীষী পরপারে পাড়ি জমান। মাওলানা খাঁনের মৃত্যু সংবাদ যখন পাই তখন শাহজালাল ইসলমিক সেন্টারের আমন্ত্রণে আমি নিউইয়র্কে অবস্থা করছি। ওখানকার শাহজালাল মসজিদে তারাবির ইমাম হিসেবে গিয়েছিলাম। আলনূর কালচারাল সেন্টার নিউইয়র্ক শাখার উদ্যোগে আলনূর জামে মসজিদে ২৯ রমজান আল কোরআন সন্ধ্যার আয়োজন করে খাঁন সাহেবের ইসালে সওয়াবের জন্যে উৎসর্গ করি।
আজ মাওলানা খাঁন নেই, কিন্ত তাঁর অভাব আমি প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি। তাঁর মতো দরদি একজন মুরব্বি খুঁজে ফিরি প্রতিনিয়ত, যিনি সংস্কৃতির এ লাইনে আমাদের পথ বাতলে দেবেন। অবশ্যি অনেক মুরব্বিই আমাকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মাওলানা খাঁনের মতো এমন প্রাজ্ঞ এবং দরদি কেউ নেই। আল্লাহ তায়ালা মাওলানা খাঁনের কবর জীবনকে সুখ শান্তি দ্বারা ভরপুর করে দিন।
লেখক: হাফেজ মাওলানা ইউসুফ নূর, দায়ী’-খতিব, কাতার ধর্ম মন্ত্রণালয় ও নির্বাহী পরিচালক, আলনূর কালচারাল সেন্টার, কাতার।