মাওলানা সুফিয়ান ফারাবী।।
বাইতুল্লাহ থেকে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনায় এলাম। মক্কা থেকে সকাল ছ'টায় গাড়িতে চড়ি। আসতে সময় লেগেছে প্রায় দশঘন্টা।
রাস্তায় একটি উট গাড়িচাপায় মারা যায়। এ কারণে রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিল। এজন্য আসতে দু‘ঘন্টা বেশি লেগেছে। সাধারণত মক্কা থেকে মদীনায় আসতে সাত থেকে আটঘন্টা লাগে।
দীর্ঘ সফরের কারণে শরীর খুব ক্লান্ত । গায়ে প্রচুর ধুলো। গোসল ছাড়া উপায় নেই। আমি আমাদের কাফেলার আমির সাহেবের কাছে গিয়ে বললাম, আমির সাহেব! আমার গোসল করা প্রয়োজন। শরীরে প্রচণ্ড ময়লা।
তিনি বললেন, দাঁড়ান। এখনি মাশওয়ারা (পরামর্শ) হবে। মুফতি সাহেব কাফেলার সবাইকে ডেকে পাঠালেন। সবাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত হলেন। সম্ভবত তারা মাশওয়ারার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
মুফতি সাহেব সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন বাজে বিকেল চারটা। আসরের নামাজের বাকি মাত্র ত্রিশ মিনিট। আর ইফতারির বাকি এখনো আড়াই ঘন্টা। এখন কি আপনারা গোসল করে বেলাল মসজিদে নামাজ আদায় করে মসজিদে নববিতে যাবেন। নাকি এখনি মসজিদে নববীতে যাবেন?
আমাদের কাফেলায় আমি ছাড়া সবাই এর আগে হজ্ব বা উমরায় এসেছেন। আমাদের সফরসঙ্গী মাওলানা বিন ইয়ামিন এ নিয়ে চারবার উমরা করছেন।
তিনি বললেন, মুফতি সাহেব! আমার মনে হয় গোসল নামাজ সেরে একসাথে মসজিদে নববিতে যাওয়াই উত্তম হবে। কারণ তখন আমরা ইফতারি, তারাবি ও কিয়ামুল লাইল শেষ করে হোটেলে ফিরতে পারবো। আর তা না হলে ইফতারি করে আমাদের আবার হোটেলে আসতে হবে গোসলের জন্য।
সবাই তার কথার সাথে একমত হলেন। ফয়সালা হলো- আমরা বেলাল মসজিদে নামাজ পড়ে তারপর মসজিদে নববিতে যাবো।
আমরা সবাই গোসল করে নামাজ আদায় করলাম। তারপর ছুটলাম মসজিদে নববির দিকে। এখান থেকে রাসূল সা.-এর রওজা প্রায় এক কিলোমিটার।
রমজান মাসে মসজিদের আশেপাশের হোটেলগুলো খালি পাওয়া যায় না। কিছু খালি থাকলেও সেগুলোর প্রতিরাতের ভাড়া পাঁচ হাজার রিয়াল। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় এক লাখ টাকা।
ধনীরা এসব হোটেলে থাকেন।সুযোগ সুবিধায় একদম ফাইভস্টার। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মসজিদে নববীর কাছে চলে আসলাম। ওই তো! মসজিদে নববীর উঁচু মিনারগুলো দেখা যাচ্ছে। আমার মনে সঙ্গে সঙ্গেই উদয় হলো- এক অন্যরকম আবেশ।
মনের অজান্তেই কখন যে বলে ফেললাম, আস সালাতু ওয়াস সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ্। আস সালাতু ওয়াস সালামু……..।
আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। তখনো বুঝতে পারিনি যে, আমি কাঁদছি। চোখের পানি যখন গাল গড়িয়ে ঠোটের কাছে এসে জমলো তখন টের পেলাম।
কিছুক্ষণ কান্নার পর চোখ মুছলাম। মনে মনে ভাবছি, জীবনের এই দু‘ফোটা অশ্রু বৃথা যায়নি। এ দু‘ফোটা অশ্রু বির্সজন দিয়েছি রাসুলের প্রেমে। এ দু‘ফোটা অশ্রু সার্থক।
কথাগুলো ভেবে ভেবে চোখ মুছতে মুছতে একদম রওজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আবারো সালাম দিয়ে জিয়ারতের কিছু দোয়া দুরুদ পাঠ করলাম।
সে যে কী অনুভূতি! কী আত্মতৃপ্তি! বলে বুঝানো যাবে না। ভাষায় প্রকাশ করলে যথাযথ হবে না। কাগজে লিখলে ফুটে উঠবে না। এটা মনের আবেগ, মনের ভালোবাসা। তাই মনেই থাকুক।
জিয়ারত শেষে আমরা ইফতারিতে বসলাম। প্রতিদিন প্রায় দশহাজার রোজাদার এখানে একসাথে ইফতারি করেন। আরবের শেখ, কোটিপতি ও দরিদ্র-অসহায় মানুষ এক দস্তরখানায় বসে। এটাই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে ধনী-গরীবের মধ্যে কোনো র্পাথক্য নেই। এমনকি র্পাথক্য হয় না জাতীয়তারও। এখানে বাঙালি, সৌদিয়ান, তুর্কি, রোহিঙ্গা সবাই সমান।
ইফতারির সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি রোজাদারদের দিকে তাকিয়ে আছি নিবিড় চোখে। তারা নিবিষ্ট চিত্তে দোয়া করছেন। সবার চেহারা মলিন। অসহায় অসহায় ভাব। সবাই নিজ নিজ পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। যেন তারা সর্বহারা।
আমার পাশে বসেছেন এক সৌদি ধনকুবের। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হবে। সাধারণত এ বয়সী টগবগে যুবকদের কাঁদতে দেখা যায় না। কিন্তু তিনি কাঁদছেন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। অঝরে অশ্রু ঝরছে তাঁর চোখ দিয়ে। আহ, কী দামী তার রোদন! কী দামী তার অশ্রু! কী দামী এই মানুষটি!
মুয়াজ্জিন আজান দিয়েছেন। আমরা জান্নাতি পরিবেশে ইফতারি শুরু করলাম আজওয়া খেজুর দিয়ে।
লেখক: মুদাররিস, ইসলামিক আইন, জামিয়া মাহমুদিয়া সাভার, ঢাকা।
-এটি