অতিবাহিত হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। শুরু হলো সবচেয়ে বরকতপূর্ণ শেষের দশ রজনী। পৃথক ভাবে প্রতিটি রজনীর অনন্য মর্যাদা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান রাতের নাম হাদিসের ভাষায় লাইলাতুল কদর।
লাইলাতুল কদর কী, এ রাতের বিশেষ আমলগুলো কী কী, লাইলাতুল কদর চেনার সহজ উপায়, এবং এ রাতের গুরুত্ব ফজিলত সম্পর্কে কথা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া বলিয়ারপুরের মুহাদ্দিস মুফতি আহসানুল্লাহ’র সঙ্গে। কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট সুফিয়ান ফারাবি।।
আওয়ার ইসলাম: লাইলাতুল কদর অর্থ কি?
মুফতি আহসানুল্লাহ: লাইলাতুল কদর এটি একটি আরবি গুণবাচক যৌগিক শব্দ।
লাইলাতুন অর্থ রজনী। কদর অর্থ মহিমান্বিত একত্রে লাইলাতুলকদর অর্থ মহিমান্বিত রজনী, যাকে ফার্সিতে শবে কদর বলা হয়।
এ রাত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রজনী। এটি একটি দামি রাত এবং এই রাতে ইবাদতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট নিজেকে দামী বা মহিমান্বিত করে নিতে পারে। তাই একে লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী বলা হয়।
আওয়ার ইসলাম: এই রাতে কোন গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে কি?
মুহাদ্দিস মুফতি আহসানুল্লাহ: হযরত আয়েশা রা. বলেন, একদা আমি রাসূল সা. কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল সা. আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে আমি কি করবো?
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এই দোয়া পাঠ করার জন্য বললেন اللهم انك عفوتحب العفو فاعفو عني. আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা'ফু আন্নি (তিরমিযি 351)
অর্থ: হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।
লাইলাতুল কদরে আমরা উল্লেখিত দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করতে পারি। এছাড়া লাইলাতুল কদরে নির্দিষ্ট কোন আমল নেই।
বিশেষায়িত এই রাত ইবাদতের মাধ্যমে কাটানোই মূল উদ্দেশ্য। তাই যে কোন আমল করতে পারি। তন্মধ্যে নফল নামাজ, কাজা নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, কোরআন তেলাওয়াত, আজকার, তাসবিহ, দোয়া-দরুদসহ সকল আমল এই রাত্রিতে করা যেতে পারে।
আওয়ার ইসলাম: কোন রাতটি লাইলাতুল কদর?
মুফতি আহসানুল্লাহ: লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট কোন তারিখ নেই। আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে, ২৭ রমজানই লাইলাতুল কদর। এটি সঠিক নয়, বরং লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করিম সা. বলেন আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে। অতঃপর আমাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতসমূহে লাইলাতুল কদর খোঁজ করো।( সহিহবোখারী ৭০৯)
অন্যত্র ইরশাদ করেন, রমযানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর। (সহিহ মুসলিম ১১৬৯)
অন্য হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তাহলে সে যেন রমজানের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে (সহিহমুসলিম ৮২৩)
তবে কোন কোন সালাফে-সালেহীন ২৭তম রাত লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করেছেন।
সাহাবীগণের মধ্যে ইবনে আব্বাস (রা.), মুআবিয়া (রা.), উবাই ইবনে কা’ব (রা.) এর মতামত থেকে এটাই বুঝা যায়।তাই সাতাশে রাতে লাইলাতুল কদর হওয়াকে সম্ভাবনাময় বলা যেতে পারে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে ২৭ রমজান বলা সম্ভব নয়।
উল্লিখিত হাদীসগুলোর মাধ্যমে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, লাইলাতুল কদর কোন নির্দিষ্ট তারিখের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং কেউ যদি লাইলাতুল কদরের ফজিলত অর্জন করতে চায় তাহলে সে যেন রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
আওয়ার ইসলাম: লাইলাতুল কদর চেনার কোন উপায় আছে কি?
মুফতি আহসানুল্লাহ: কুরআন ও হাদিস বিশ্লেষণ করলে লাইলাতুল কদর চেনার কিছু আলামত পরিলক্ষিত হয়।
১। শান্তিময় রজনী আল্লাহ পাক এরশাদ করেন سلام هي حتى مطلع الفجر. (এই শান্তি বর্ষিত হয় সূর্যোদয় পর্যন্ত)
এই আয়াত অনুযায়ী কদরের রাত হবে নিরব ও প্রশান্তময় রাত। ইবনে খুযায়মার মতও এটিই।
২। চাঁদ হবে অর্ধেক থালার আকৃতি
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, এই রাতের চাঁদ অর্ধেক থালার আকৃতিতে উদিত হবে।
عن أبي هريرة رضي الله عنه، أنه قال: تذاكرنا ليلة القدر عند رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال (أيكم يذكر حين طلع القمر وهو مثل شق جفنة) - رواه مسلم
৩। এই রাতে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, সহীহ বুখারীর সূত্রে একটি হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) একবার লাইলাতুল কদর সম্পর্কে স্বপ্ন দেখছিলেন এবং সেই স্বপ্নে তিনি সেজদায় ছিলেন। তিনি যখন সেজদা থেকে উঠলেন, তখন তার মুখ বৃষ্টির পানি ও কাদায় ভেজা ছিলো।
৪। সকালে সূর্যোদয় হবে হালকা আলোকরশ্মিসহ। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত। انها تطلع يومئذ لا شعاع لها.
(সহিহ ইবনু খুজাইমা ২১৯০) (বোখারি ২০২১)(মুসলিম৭৬২)
আওয়ার ইসলাম: এই রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে একটু বলুন!
মুফতি আহসানুল্লাহ: এই রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে সূরা ক্বমার নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেন।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (1) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (2) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (3) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ(5)
নিশ্চয় আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে (১)আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে আপনি কি জানেন(২) মহিমান্বিত রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম (৩)এই রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ তথা জিব্রাইল (আঃ) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজ নিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনুমতিক্রমে (৪) শান্তিই শান্তি এই রজনীতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত (৫)
এই সূরার তিন নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ আলফুন শব্দ ব্যবহার করেছেন। আরবিতে আলফুন শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে অসংখ্য বোঝানোর ক্ষেত্রে। সুতরাং এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, উক্ত রাত্রি অসংখ্য মাস থেকে উত্তম।
আর যদি আলফুন এর শাব্দিক অর্থ করা হয়, তাহলে অর্থ হয় হাজার মাস থেকে উত্তম।হাজার মাস যদি আমরা হিসাব করি তাহলে প্রায় ৮৩ বছর সমপরিমাণ হয়।
এর মাধ্যমে বোঝা যায় কোন ব্যক্তি যদি শবে-কদরে ইবাদত করে তাহলে সে ব্যক্তি একরাত্রি ইবাদতের মাধ্যমে অন্তত ৮৩ বছর ইবাদত করার সওয়াব পাবে।
মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও, তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের আশায় খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদরে নামাজ বা অন্য কোন ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করে, তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারি, হাদিস নং : ৬৭২)
আওয়ার ইসলাম: শবে কদর ও শবে বরাতের মধ্যে পার্থক্য কী?
মুফতি আহসানুল্লাহ: শবে কদর ও শবে বরাত দুটি ভিন্ন রাত। শবে কদর যা আমরা পূর্বে আলোচনা করলাম।
আর শবে বরাত হলো হাদিসে যাকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বলা হয়েছে। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তম রজনী। এটিকে হাদিসে ক্ষমার রাত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, এটিও একটি ফজিলত ও গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি।
-এটি