উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।
শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ বাংলাদেশের একটি পরিচিত নাম। 'শায়খুল হাদিস' এ উপাধিতে-ই তিনি বেশ খ্যাত। তিনি সুপরিচিত রাজনৈতিক ইসলামি ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান গঠনের আগে ও পরে যারা বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম।
তিনি ছিলেন ইসলামি ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের প্রধান।
হাদিস শাস্ত্রে তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল, যার প্রমাণ বহন করে চলছে তার সুপরিচিত উপাধিটি ('শায়খুল হাদিস')। একই সঙ্গে তিনি বিভিন্ন মাদরাসার শায়খুল হাদিস পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বপ্রথম যিনি বুখারি শরিফের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদের খেদমত আঞ্জাম দেন, তিনি শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ।
শায়খুল হাদিস রহ ছিলেন বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের (বেফাক)অন্যতম প্রতিষ্ঠতা এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ও বুখারি শরিফের অধ্যাপক।
এছাড়াও তিনি ছিলেন জাতীয় ঈদগাহের বহু বছরের ইমাম ও বিভিন্ন মসজিদের খতিব। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও শায়খুল হাদিস।
জন্ম ও শিক্ষা:
এই মহান মনীষী ১৯১৯ সালের মুন্সিগঞ্জ জেলার ভিরিচ খাঁ-এ জন্ম নেন। ছোট্ট বয়সে (৪/৫) আম্মাজানকে হারান৷ এরপর, তার প্রতিপালনের দায়িত্ব পড়ে নানীর হাতে। একই জেলার কলমা অঞ্চলে নানার বাড়ী থাকাকালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। তার পিতা এরশাদ আলী বিবাড়িয়ায় ব্যবসা করতেন। ৭/৮ বছর বয়সে শিক্ষা লাভের জন্য তিনি আব্বুর কাছে চলে আসেন। সেই সময়ের বড় বড় আলেমের (ফরিদপুরি, হাফেজ্জি
হুজুর, পীরজি হুজুর) সাথে তার আব্বাজানের ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে তাদের ছায়ায় তার ব্যক্তিত্ব বেড়ে উঠে। ফরিদপুরি রহ তখন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইউনুসিয়ায় শিক্ষকতা করতেন। তার তত্ত্বাবধানে তিনি সেখানে ভর্তি হন। এবং এখানেই তার আরবি শিক্ষার হাতেখড়ি।
কিছুদিন পর তার শায়খ ও মুরব্বি ফরিদপুরী রহ তার দুই সহকর্মী (হাফেজ্জি, পীরজি)- কে নিয়ে ঢাকার বড় কাটায় যেয়ে আশরাফুল উলূম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলে তিনি সেখানে চলে যান। একটানা দাওরাসে হাদিস পর্যন্ত তার একাডেমিক পড়াশোনা এখানেই শেষ হয়৷
সে সময় জাফর আহমদ উসমানি একইসঙ্গে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদিসের অধ্যাপকের পদসহ বড় কাটারা মাদরাসার শায়খুল হাদিস ও সদরুল মুদাররিসীন ছিলেন। সে সুবাদে আজিজুল হক রহ ১৯৪০-৪১এ সময়ে তার কাছে তাফসিরে বায়যাবি, জামে তিরমিযি ও বুখারি শরিফের দরস নেন৷ এছাড়াও এই মাদরাসায় রফিক আহমদ কাশ্মিরির সোহবত লাভ করেন।
'কুতুববীনি' (কিতাব মুতালাআ)তে তার খুব আগ্রহ ছিল। এবং এতে তিনি বেশ আরামবোধও করতেন। বড় কাটারা মাদরাসায় অধ্যায়নকালে তিনি প্রচুর মুতালাআ করেছেন৷ দাওরার বছর শায়খুল হাদিস রহ মুসলিম শরিফের বিখ্যাত শরাহ (ব্যাখাগ্রন্থ) 'ফাতহুল মুলহিম'- এর সাথে বিশেষভাবে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। বেশ আগ্রহভরে তা মুতালাআ করতেন তিনি। শরাহটির অধ্যায়নে এতই তার তৃপ্তিবোধ ছিল যে, কিতাবের মুসান্নিফের (লেখক) কাছে সরাসরি বুখারি শরিফ পড়ার উচ্চাভিলাষ তার ভেতরে জেগে উঠে।
এই স্বপ্ন থেকে তিনি জামেয়া ইসলামি ডাভেলে ছুটে যান৷ সেখানে তিনি তার স্বপ্নের পুরুষ শাব্বির আহমদ উসমানির কাছে বুখারি শরিফ দ্বিতীয় বারের মতো পড়েন৷ শায়েখের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। সবগুলো তাকরির লিখে সংরক্ষণ করতে ভুলতেন না তিনি৷ তার এই অসামান্য কাজটিতে মুগ্ধ হয়ে পড়াশোনা শেষ হবার পরও উসমানি রহ তাকে এক বছরের জন্য সেখানে রেখে দেন৷ এই সময়টাতে তার বিশেষ কাজ ছিল সংরক্ষিত তাকরিরগুলোর পরিমার্জনসহ তথ্যসূত্রে তা সমৃদ্ধ করা। তিনি অবস্থানের সুবিধার্থে দারুল উলূমের তাফসির বিভাগে ভর্তি হন৷ এবং স্বনামধন্য বিশিষ্ট আলেম ইদরিস কান্ধলভির কাছে বিশেষভাবে তাফসির শাস্ত্রে পাঠ গ্রহণ করেন।
এছাড়া তিনি মাযাহেরুল উলূমে কিছুদিন অবস্থানকালে খলিফায়ে থানবি আসাদুল্লাহ রামপুরির বিশেষ সোহবত লাভে ধন্য হন।
কর্মজীবন:
ডাভেল থাকালে সেখানেই তার খেদমতের ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু ফরিদপুরির নির্দেশে তিনি ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসায় চলে আসেন। এখানে এসে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দেন। এরপর, ১৯৫৩ -৮৫ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরি ও হাফেজ্জি হুজুরের যৌথ প্রতিষ্ঠিত লালবাগ মাদরাসায় শায়খুল হাদিস পদে খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
এছাড়াও এসময় তিনি ইসলামি আইন, হাদিস, তাফসির ইত্যাদি বিষয়ে পাঠ দান করেন৷ অবশ্য মাঝে দু'বছর (৭১- সাল থেকে) বরিশালের জামিয়া মাহমুদিয়ায় অধ্যাপনার কাজে ছিলেন। তিনি লালবাগ থাকাকালে তার সর্বপ্রথম বুখারির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ হয়৷
১৯৭৮সালের ৩ এপ্রিল তিনি বেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭৯ থেকে তিন বছর সময় ঢাকা ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিশেবে বুখারি শরিফের অধ্যাপনা করেন।
কয়েক বছর বাইতুল মোকাররমের জাতীয় ঈদগাহের ইমমতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদ, মালিবাগ শাহি জামে মসজিদ, আজিমপুর স্টেট জামে মসজিদের খতিব হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল।
১৯৮৮ সালে তিনি মোঘল আমলের ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন সাতমসজিদ মুহাম্মদপুরের পাশে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।
রাজনৈতিক জীবন:
পাকিস্তান গঠনে তিনি তার মুরশিদ ফরিদপুরির সাথে আন্দোলনে অংশ নেন। পাকিস্তান গঠন হয়ে যাবার পর আতহার আলী রহ সহ দেশের শীর্ষ কয়েকজন আলেম কুরআন- সুন্নাহর বিধি বাস্তবায়নে 'নেজামে ইসলাম পার্টি' নামে একটি ইসলামি দল প্রতিষ্ঠা করেন। শাইখুল হাদিস রহ সে দলের নির্বাহি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি সফর করে বেড়ান।
পাকিস্তানের স্বৈরাচারি শাসক আইয়ূব খান কুরআন সুন্নাহ সাংঘর্ষিক 'মুসলিম পারিবারিক আইন' প্রণয়ন করলে গোটা পাকিস্তান ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এসময় তিনি তার শায়েখ ফরিদপুরির সাথে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন।
৭১- এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক উলামায়ে কেরাম 'জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ' নামে একটি ইসলামি দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই দলের সভাপতির পদে ছিলেন। এরপর তার উস্তাদ হাফেজ্জী হুজুর রহ ১৯৮১ সালে খেলফত আলা মিনহাজিন নুবুওওয়াহের ধাঁচে শাসনতন্ত্র কায়েম করার লক্ষ্যে 'তাহরিকে খেলাফত বাংলাদেশ 'নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলে শায়খুল হাদিস রহ তার মুখপাত্র হিশেবে দায়িত্ব পালন করে যান।
১৯৮২ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলাকালে তিনি দু'দেশের সমঝোতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেখানে গিয়ে সাদ্দাম হোসেন ও আয়াতুল্লাহ খোমেনির সাথে আলোচনার টেবিলে বসেন। অবশ্য (অনেকের কাছে) এটা তার রাজনৈতিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর,ভারতের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও মুসললিম হত্যার প্রতিবাদে অযোধ্যা অভিমুখে এক ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন। ২জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক লংমার্চটি ঢাকা থেকে রওয়ানা দেয়, যাতে এক লক্ষের মতো মুসলামান অংশ নেয়। অবশ্য, লংমার্চটা সফলতার মুখ দেখেনি৷ খুলনা দিয়ে সীমান্তে পৌঁছলে লংমার্চকারীদের উপর গুলি শুরু হয়। এতে দু'জন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন।
এছাড়া ২০০৯ সালে আল্লাম আহমদ শফিসহ শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একটি জামাত নিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস বিরোধী নিন্দাবিষয়ক একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন।
এক নজরে তার পদবি ও দায়িত্ব: শায়খুল হাদীস: জামিআ কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ ঢাকা, জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া মুহাম্মদপুর ঢাকা, জামিআ শরইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা, জামেউল উলূম মিরপুর-১৪ ঢাকা। এছাড়াও আরো কয়েকটি মাদরাসা।
মুহতামিম ও সভাপতি: জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া ঢাকা, জামিআ শরইয়্যাহ মালিবাগ ঢাকা, জামিআতুল আজিজ মুহাম্মদপুর ঢাকা।
খতীব: জাতীয় ঈদগাহ, ঢাকা; লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদ, ঢাকা ও আজিমপুর জামে মসজিদ, ঢাকা। কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য: নেজামে ইসলাম পার্টি পাকিস্তান।
সহ-সভাপতি: তাহরীকে খেলাফত বাংলাদেশ। সভাপতি ও চেয়ারম্যান: জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস বাংলাদেশ ও বেফাকুল জামাআ-তিল ইসলামিয়াহ বাংলাদেশ।
রচনাবলী: তার রচনাবলীর সবচে' চমক ছিল বুখারি শরিফের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। অনুবাদটি দশ খন্ডে প্রকাশিত হয়। অনুবাদের কাজটি ১৮৫২ সালে তার হজের সফরে শুরু হয়ে ১৬ বছর সময়ে তা শেষ হয়। এছাড়া তিনি তার ছাত্রজীবনেই উর্দূ ভাষায় বুখারি শরিফের শরাহ' ফজলুল বারি ফি শারহি সহিহিল বুখারি'।লিখেছিলেন৷ ১৮০০পৃষ্ঠার এ দীর্ঘ শরাহটি প্রথমে পাকিস্তান থেকে দুই খন্ডে ছাপা হয়৷ পরে, বাংলাদেমে থেকে তিন ভলিউমে
পুরো শরাহ ছাপার অক্ষরে বেরোয়। 'মুসলিম শরিফ ও অন্যান্য হাদিসের ছয় কিতাব' নামে তর্জমাসহ বিষয়ভিত্তিক একটা সংকলন লিখেন। এসব ছাড়াও তার আরো কিছু কাজ রয়েছে:
রুমির মসনবীর বাংলানুবাদ। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও ইসলাম;(বই)। কাদিয়ানি মতবাদের খণ্ডন;(বই) মুনাজাতে মাকবূল (অনুবাদ)। সত্যের পথে সংগ্রাম (বয়ান সংকলন)
মৃত্যু:
এই মহান মনীষী ২০১২ সালের ৮ আগষ্ট (১৯ রমযান, ১৪৩৩ হিজরি) আজিমপুরে তার নিজের বাসভবনে স্ত্রী, আট ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। পরেরদিন, বাইতুল মোকাররমে তার ছেলে বর্তমান বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ইসলামি ব্যক্তিত্ব মাওলানা মাহফুজুল হকের ইমামতিতে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাকে কেরাণীগঞ্জ আটিবাজার সংলগ্ন ঘটারচরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুর সময় এ কিংবদন্তির বয়স ছিল ৯০ বছর।
লেখক: শিক্ষার্থী
-এটি