মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।
দুনিয়ার জীবনে সবাই সফলতার মুখ দেখতে চায়। পরাজয়ের গ্লানি কেউ বহন করতে রাজী নয়। এটা সৃষ্টজীবনের স্বভাবজাত অভ্যাস। এটা মানুষের মধ্যে থাকবেই। একজন মুমিন হিসেবে সবাই চায় সফল মুমিন হতে তাই আমাদের সফল হতে মাত্র ৭টি গুণ অর্জন করতে হবে। আল্লাহ পাক সূরা মুমিনুনের প্রথম ৯ আয়াতে সেই গুণগুলোর আলোচনা করেছেন এবং ১০ ও ১১ নং আয়াতে তাদের পুরস্কারের কথা আলোচনা করেছেন। আয়াতগুলোর আলোকে নি¤েœ সেই সাত গুণের আলোচনা করা হলো।
প্রথম গুণ: নামাজ খুশু-খুযু তথা মনোযোগী হয়ে আদায় করা।
আল্লাহ পাক বলেন, যারা নিজেদের নামাজে বিন¤্র্র।’ অর্থাৎ সফল মুমিনের প্রথম গুণ হলো যারা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল যাবতীয় নামাজ মনোযোগী হয়ে আদায় করে। নামাজে ডানে-বামে তাকায় না। সিজদার জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। দেহের কোনো অংশ নিয়ে খেলা করে না। এমনকি নামাজে মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনাকে অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে স্থান দেয় না।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এক ব্যক্তিকে নামাজে দাঁড়িয়ে খেলা করতে দেখে বললেন, এই ব্যক্তির অন্তরে খুশু-খুযু তথা নম্রতা থাকলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও স্থির থাকতো। (তাফসিরে মাজহারি)
দ্বিতীয় গুণ: অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহ পাক বলেন, যারা অনর্থক কাজ হতে বিরত থাকে। অর্থাৎ সফল মুমিনের দ্বিতীয় গুণ হলো, তারা কথা ও কাজে অনর্থক বিষয়াদি হতে বিরত থাকে। হোটেলে, চার ষ্টলে বসে অপ্রয়োজনীয় গল্প-গোজব করে না। অনর্থক আড্ড দেয় না।
সূরা ফুরকানে সফল মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারা যখন অনর্থক ক্রিয়াকলাপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তখন তারা তাতে ভ্রæক্ষেপ না করে ভদ্রভাবে চলে যায়।’
রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ত্যাগ করে, মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তার ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস ২৩১৮:)
তৃতীয় গুণ: জাকাত আদায় ও আত্মশুদ্ধি করা।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেন, যারা জাকাতদানে সক্রিয়।’ আয়াতে জাকাত দ্বারা আত্মশুদ্ধি উদ্দেশ্য, যেমনটি বলেছেন বহু মুফাসরিগণ। অর্থাৎ সফল মুমিনের তৃতীয় গুণ হলো যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করে। শিরক, রিয়া (লোক দেখানো), অহঙ্কার, হিংসা, শত্রæতা, লোভ-লালসা, কৃপনতা ইত্যাদি থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। কারণ এগুলো সব কবিরা গোনাহ। আত্মাকে এগুলো থেকে পবিত্র করা ফরজ।
সূরা আ‘লাতে এসেছে, যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করছে, নিজের রবের নাম স্মরণ করেছে এবং নামাজ আদায় করেছে, সে-ই সফলকাম হয়েছে।
৪র্থ গুণ: যৌনাঙ্গকে হারাম থেকে সংযত রাখা।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে; তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরষ্কৃত হবে না। অতঃপর কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্গনকারী হবে না।’ অর্থাৎ সফল মুমিনের চতুর্থ গুণ হলো, যারা তাদের যৌনাঙ্গকে অবৈধ কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা থেকে সংযত রাখে। অন্য কারও সাথে অবৈধ সম্পর্ক রাখে না।
তবে তাদের স্ত্রী ও শরিয়তসম্মত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত রাখে না। কেননা এ ব্যাপারে তারা তিরষ্কৃত হবে না। তবে যারা এদেরকে ছেড়ে অন্যত্র কামনাপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে ইচ্ছুক হবে, তারা শরিয়তের সীমালঙ্গনকারী হবে না। এমনিভাবে স্ত্রী ও দাসীদের পিরিয়ড ও সন্তান প্রসব পরবর্তীতে সহবাস করা, কোনো পুরুষ বা কোনো জন্তুর সাথে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা এবং হস্তুমৈথুন করা থেকে বিরত থাকে।
রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দু’টি জিনিসের দায়িত্ব নিবে, এর অপব্যবহার করবে না তার জন্য আমি জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছি। দুটির একটি হলো জবানের হেফাজত। অপরটি হলো লজ্জাস্থানের হেফাজত।
ব্যাভিচারের শাস্তি সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনের সূরা নূরে বর্ণিত হয়েছে। সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলেন, তোমরা ব্যাভিচারের নিকট যেও না। এটা অত্যন্ত নোংরা ও জঘন্য কাজ এবং নিকৃষ্ট পন্থা। হাদিসে ব্যভিচারকে শিরকের পরবর্তী পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুমিন অবস্থায় কেউ ব্যভিচার করতে পারে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৭৫)
পঞ্চম গুণ: আমানত প্রত্যর্পন করা।
আল্লাহ পাক বলেন, যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে।’ অর্থাৎ সফল মুমিনের ৫ম গুণ হলো যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে সতর্ক থাকে। আমানত আত্মসাৎ করে না। আমানতের হেফাজত ও তার হক আদায় করার বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর প্রসারী অর্থবহ। অর্থাৎ আল্লাহর ও বান্দার যত রকম হক আছে তা আদায় করা।
আমানত আত্মসাৎ করাকে হাদিসে মুনাফিকের আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০৬)
৬ষ্ঠ গুণ: অঙ্গীকার পূর্ণ করা।
অর্থাৎ সফল মুমিনের ৬ষ্ঠ গুণ হলো তারা অঙ্গীকার পূর্ণ করে। কাউকে কোনো কিছু দেওয়ার অথবা অন্যজনের কোনো কাজ করে দেওয়ার ওয়াদা করলে তা পালন করে। এমনিভাবে কারও সাথে কোনো ব্যাপারে দ্বীপাক্ষিক চুক্তিবদ্ধ হলে এরূপ চুক্তি পূর্ণ করে। বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন, যার আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান নেই। আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার দ্বীন নেই।’ (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৪০৪৫)
সপ্তম গুণ: নামাজে যতœবান হওয়া।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, যারা নিজেদের নামাজসমূহে যত্নবান থাকে।’ অর্থাৎ সফল মুমিনের ৭ম গুণ হলো, তারা পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের খুব পাবন্দি করে। মুস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করে। দুনিয়ার অন্যান্য কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে অপর ওয়াক্তের নামাজের জন্য অপেক্ষায় থাকে এবং নামাজের যথাযথ পবিত্রতা অবলম্বন করে নামাজের কেরাত ও রুকনগুলো পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করে। নামাজ হচ্ছে ইসলামের সর্বোত্তম আমল। রাসূলের হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত এক ওয়াক্ত নামাজ ত্যাগ করলো, সে কুফরি করলো।’ (আলমুজামুল আওসাত, হাদিস : ৩৩৪৮)
উপরোক্ত সাত গুণে যারা গুণান্বিত হবে এবং তাতে অটল থাকবে, তারা সফল ও কামেল মুমিন বলে গণ্য হবে।
এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হচ্ছে, আয়াতটিতে সফল মুমিনের সাত গুণের শুরুও হয়েছে নামাজ দ্বারা। আবার শেষও হয়েছে নামাজ দ্বারা। এতে বুঝা যায় নামাজকে নামাজের মতো পাবন্দি ও নিয়ম-নীতি সহকারে আদায় করলে অবশিষ্ট গুণগুলো আপনা-আপনি নামাজির মধ্যে সৃষ্টি হবে।
সফল মুমিনের পুরস্কার:
যারা উপরোক্ত সাত গুণে গুণান্বিত তারা সফল। তারা সফল মুমিন। তাদের জন্য রয়েছে মহা মূল্যবান পুরস্কার। আর তা হচ্ছে তারা জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা তাতে চিরকাল থাকবে। মৃত ব্যক্তির ধন-সম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকারীর মালিকানায় আসা অমোঘ ও অনিবার্য। তেমনি এসব ব্যক্তিদের গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিদের জান্নাত প্রবেশও সুনিশ্চিত।
উপরোক্ত গুণগুলো অর্জন করে সত্যিকার অর্থে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত ৪৩ নবাব সলিমুল্লাহ রোড, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম