মহিউদ্দীন খান তানজীম।।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এটি পুরো মানবজাতির জন্য এক মহাবার্তা। তবে প্রস্তুতিপর্ব ও উপযুক্ততার বিচারে ভূপৃষ্ঠের কোন অংশ যেমন অন্যটি থেকে পৃথক হয়,তেমনি এটিও। জমির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন পড়ে পানি এবং দীর্ঘ-অপেক্ষমান একটি সময়। অতপর আসে উপকার-উপভোগের পালা।অথবা তৃপ্তিদায়ক কোন খাবারের কথা ধরুন,এটি পাকস্থলীর এক স্থর থেকে অন্যটিতে স্থানান্তরের সময় ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব সৃষ্টি করে।অনুরূপ মহামান্বিতগ্রন্থ আল- কুরআন।এটি সকলের জন্য বার্তাস্বরূপ।তার অবতরণ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য।
কিন্তু তাকে গ্রহণ করা,তার থেকে উপকারলাভের ক্ষেত্রে মানুষের উপযুক্ততা বিভিন্নরকম। মানবীয় থলি এবং যোগ্যতার বিচারে প্রভাব এবং ফলাফলে যেমন কোনো জিনিষের ভিন্নতা প্রকাশ পায়,ঠিক তেমনই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা প্রভাব ও পরিণামের এই ভিন্নতাকে পবিত্র কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন। তিনি একই জায়গায় বিপরীতমুখী দুটি পরিণামের আলোকপাত করেছেন এভাবেঃ "আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি, যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মু'মিনদের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়(সূরা বনী ইসরাইলঃ ৮২)।
আর যখন সূরা অবতীর্ণ হয়,তখন তাদের কেউ কেউ বলে,এ সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলো? অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে। বস্তুতঃ যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে এটি তাদের কলুষের সাথে আরো কলুষ বৃদ্ধি করেছে এবং তারা কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে।(সূরা তাওবাঃ১২৪-১২৫)।
আল্লাহ তায়ালা কতেক আয়াতে মুমিনদের উপর কুরআনের সুপ্রভাব এবং কতেক আয়াতে কাফেরদের উপর এর বিপরীত অশুভ প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
মু'মিনদের উপর কুরআন মাজীদের সুপ্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন যারা ঈমানদার, তারা এমন যে,যখন আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় কালাম,তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় রবের প্রতি ভরসা পোষণ করে।(সূরা আনফালঃ২)
কাফেরদের উপর এর অশুভ প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হয়,তখন তুমি কাফেরদের চোখে-মুখে অসন্তোষের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করতে পারবে।যারা তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে,তারা তাদের প্রতি মারমুখো হয়ে উঠে। (সূরা হাজ্জঃ৭২)
যখন খাটিভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়,তখন যারা পরকালে বিশ্বাস করেনা,তাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়।" (সূরা যুমারঃ৪৫)।
কিন্তু কুরআনে হাকিম মু'মিন ও কাফেরের ক্ষেত্রে এই প্রভাবটুকু আলোকপাত করে এমন কোনো শ্বাস্বত নীতি উল্লেখ করেনি যে, ঈমান শুধু মু'মিনের জন্যই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মু'মিনই শুধু এই মহাগ্রন্থ থেকে উপকৃত হবে, হেদায়েতের পথে অগ্রসর হবে। আর কাফেররা কেবল হেদায়েত থেকে বিচ্যুতি, পথভ্রষ্টতা আর হঠকারিতা'তেই নিমজ্জিত থাকবে।
বরং মু'মিন ও কাফেরের বিপরীতে এ সকল বৈশিষ্ট্য, বিশ্বাস,ও কর্মকে এজন্য আলোকপাত করা হয়েছে ;যাতে করে তারা উত্তম গুনাবলীকে নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করে, যা দ্বিমুখী প্রভাব ও ফলাফলের সময় উন্মোচিত হয়। আমাদের কর্তব্য হলো, দু'টি সম্প্রদায়ের উল্লেখপূর্বক কুরআন যে সকল গুনাবলীর আলোকপাত করেছে,কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য সে সকল গুনাবলী ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা।
আখলাক,আ'মাল, বোধগম্যতা, আত্নিক অনুশীলন কাকে বলে, যা কুরআনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কুরআনের মর্মউদঘাটন ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক, তা ভালরূপে আয়ত্ব করার পাশাপাশি নির্বুদ্ধিতা, বক্রস্বভাব সম্পর্কেও ভালরূপে অবহিত হওয়া,যা কুরআন ও তার পাঠকের মধ্যে সৃষ্টি করে সুবিশাল অন্তরায়।
কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার প্রতিবন্ধকতাসমূহকুরআন কাফেরদের ওই সকল আচরণ ও বিশ্বাসকে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছে,যার ফলে তারা শিকার হয়েছে দুর্ভাগা ও বঞ্চনার। যা ছিল কুরআনের বিশ্বাস, অধ্যাত্মবাদ, ও সংস্কারমূলক বৈপ্লবিক চেতনার বিপরীত।যখন কাফেরদের ওই সকল আচরণ ও বিশ্বাস মুসলমানদের মধ্যে জন্ম নিবে, তখন কুরআন ও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে সুদৃঢ় প্রাচীর। ফলে তারা কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারবেনা।
কুরআনে বর্ণিত কাফেরদের কতিপয় স্বভাব
অহংকারঃ নববী শিক্ষার সুপ্রভাব,বারাকাত ও উত্তম পরিণাম থেকে কাফেরদের বঞ্চিত হওয়ার সর্বাপেক্ষা বড় কারণ ছিল এটি। কারণ, হংকার সত্যগ্রহন ও তার নিরঙ্কুশ আনুগত্য থেকে বাধা প্রদান করে। সে তার সঙ্গীকে অন্যের কর্তৃত্ব ও প্রভাব থেকে দূরে রাখতে চায়। সে চায় সর্বপ্রকার শৃঙ্খলমুক্ত, প্রবৃত্তিপূজারী মুক্ত-স্বাধীন একটি দেহ।
কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ"প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপাচারীর দুর্ভোগ। সে আল্লাহর আয়াতসমূহ শুনে,অতপর অহংকারী হয়ে জেদ ধরে,যেন সে আয়াত শুনেনি।"(সূরা জাসিয়াঃ৭-৮)
অতপর পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে ও অহংকার করেছে।এরপর বলেছে, এ-তো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু বৈ নয়।" (সূরা মুদ্দাসসিরঃ২৩-২৪)
তর্ক-বিবাদ
কুরআন সম্পর্কে দলিলবিহীন বাদানুবাদ, বাকপটুতা দেখিয়ে বিজয়ী হওয়ার নেশা, বর্ণনায় ধৃষ্টতা, মতামতে দাম্ভিকতা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। এসম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ "নিশ্চয় যারা আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে তাদের কাছে আগত কোন দলীল ব্যতিরেকে, তাদের অন্তরে আছে কেবল আত্নম্ভরিতা,যা অর্জনে তারা সফল হবেনা।"(সূরা মু'মিনঃ৫৬)
যারা নিজেদের কাছে আগত কোন দলীল ছাড়াই আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে,তাদের এ কাজ আল্লাহ ও মু'মিনদের নিকট খুবই অসন্তোষজনক। এমনিভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী-স্বৈরাচারী ব্যক্তির অন্তরে মোহর এটে দেন।"(সূরা মু'মিনঃ৩৫)
পরকালে অবিশ্বাস ও বস্তুকেন্দ্রিক উপাসনা
পরকালে অবিশ্বাসীরা কুরআন থেকে উপকৃত হতে পারেনা। কেননা, কুরআনের উৎসাহ,ভীতি,নাসীহাত-উপদেশ সবকিছুই হয়ে থাকে আখেরাতকেন্দ্রিক। কুরআন পরকালীন সাওয়াবের ক্ষেত্রে উৎসাহ এবং ভয়াবহ শেষপরিণাম সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে। কারণ, পরকালের বিশ্বাস ব্যক্তিকে কখনোই দাম্ভিক,অমুখাপেক্ষী, বেপরোয়া বানায়না। আল্লাহ বলেনঃ"যারা পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে,তারা স্বীয় নামাজের সংরক্ষনকারী।" (সূরা আনআমঃ৯২)অপম
ঈমানদার কিংবা বেঈমান দুনিয়ার প্রতি যাদের প্রবল আসক্তি,বস্তুবাদী চেতনায় যাদের বিশ্বাস, যারা প্রতিটি সমস্যাকে বিবেচনা করেন বস্তুকেন্দ্রিক;কুরআন তাদেরকেও কোন উপকার পৌছায় না। প্রভাব বিস্তার করেনা তাদের হৃদয়সমুদ্রে। ইরশাদ হয়েছেঃ" অতএব যে আমার স্মরণে বিমুখ এবং কেবল পার্থিব জীবনই কামনা করে,তার তরফ থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিন।"(সূরা নাজমঃ২৯)
আল মাদখাল ইলা'দ্দিরা'সা'তিল কুরআনিয়্যাহ' এর অংশবিশেষ। মূলঃসাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.
লেখক: শিক্ষানবিশ, দাওরায়ে হাদীস মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বসুন্ধরা, ঢাকা।ফাজিল,শায়েস্তাগঞ্জ মডেল কামিল মাদ্রাসা,হবিগঞ্জ।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম