শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বিস্ময়কর হাফেজ শিশুর সঙ্গে শায়খ আহমাদুল্লাহ মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন ১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত

মনীষীরা যেভাবে রমজান কাটাতেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী।।

রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। পরকালের সম্বল ও পাথেয় সংগ্রহের মৌসুম। এ মাসে অল্প মেহনতেও অধিক ফল লাভ করা যায়। পবিত্র মাহে রমজান হলো আখেরাতের সম্বল সংগ্রহের সেই বিশেষ মৌসুম। এ মাসের সিয়াম সাধনা মানবজীবনকে করে তুলে পুতঃপবিত্র। হাদিস শরিফ অধ্যয়নে এ কথা পরিষ্কার বুঝে আসে যে, আসলেই রমজান মাস একটি আহরণের মাস। অর্জনের মাস। কুড়ানোর মাস।’ অসংখ্য কল্যাণ অর্র্জনে ধন্য হওয়া যায় এ মাসে।

মনীষীগণ আমাদের আদর্শ। আমাদরে প্রেরণা। আমাদের চালিকাশক্তি। তাদের আমল দেখে আমরা কুরআন-হাদিসের নির্যাস সংগ্রহ করতে পারি। তাদের অনুসরণ করতে বলেছেন মহান আল্লাহ। কুরআনের ভাষ্যে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এরা এমন ছিল, যাদের আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছিলেন। অতএব, তুমিও তাদের পথ অনুসরণ করো।’ (সূরা আনআম, আয়াত : ৯০)

রমজানে মনীষীদের কুরআন তিলাওয়াত:

রমজানের সঙ্গে কুরআনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কুরআন নাজিলের মাস রমজান। আমাদের নবীজি (সা.) নামাজে কুরআন বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। এর অনুসরণ করেছেন মহান মনীষীগণ। দেখা যায়, পুণ্যবান মনীষীগণ রমজান এলে তাদের দরস বা পাঠদান বন্ধ করে দিতেন। নিজের ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতেন। কুরআন নিয়ে মশগুল থাকতেন। তাদের আমল ও কর্ম আমাদের জন্য অনুসরণীয়। কোনো কোনো মহামনীষীদের কুরআন তিলাওয়াতের পরিধি এত অধিক যে রীতিমতো আশ্চর্য হতে হয়।

ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি রমজান মাসে ৬১ খতম তিলাওয়াত করতেন।
হাদিসের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বুখারি গ্রন্থকার ইমাম বুখারি (রহ.) রমজানে সাথীদেরকে একত্রিত করতেন। তিনি সবার ইমামতি করতেন। প্রত্যেক রাকাতে বিশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এভাবে সমগ্র কুরআন খতম করতেন। প্রত্যেক দিন সেহরি পর্যন্ত কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতেন। এভাবে তিন রাতে কুরআন খতম করতেন। রমজানের প্রতি দিনে একবার কুরআন খতম করতেন। কুরআনের এই খতম শেষ হতো ইফতারের সময়। প্রত্যেক খতম শেষে দোয়া-মুনাজাতের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। (ফাতহুল বারি ১/৪৮১)

কুতুবে আলম হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) বাদ মাগরিব আওয়াবিনে দু’পারা ও তাহাজ্জুদসহ দৈনিক অর্ধ খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন।

আল্লামা কাসেম নাতুতুবী (রহ.) ১২৭৭ হিজরিতে মক্কা-মদিনা সফরকালে রমজান মাসে কুরআন পাক মুখস্ত করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। একবার তিনি এক রাকাতে সাতাশ পারা তিলাওয়াত করেছিলেন।

রমজানে তাদের নামাজ:

রমজানে পূর্বউত্তসূরী ওলামায়ে কেরামের নফল নামাজের পরিমাণ অনেক বেড়ে যেতো। তারাবিহ ছাড়াও তারা অনেক নামাজ পড়তেন। হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) মৌসুমভেদে সুবহে সাদিকের প্রায় ২/৩ ঘণ্টা পূর্বে ঘুম থেকে জাগতেন। এবং সুবহে সাদিকের প্রায় আধ ঘণ্টা পূর্ব পর্যন্ত ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকতেন। তারপর সেহরি খেতেন।
হজরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) এর সিয়াম সাধনার অবস্থা এমন ছিল যে, যারা তা দেখতো তাদের বড় দয়া হতো। হজরতের বয়স সত্তর পার হয়ে গিয়েছিল।

এ বৃদ্ধ বয়সেও এ পরিমাণ অধিক ইবাদত বন্দেগি করতেন যে, সারা দিন রোজা রেখে মাগরিবের পর ছয় রাকাতের স্থলে বিশ রাকাত আউয়াবিন নামাজ পড়তেন। অধিকন্তু এতো দীর্ঘক্ষণ রুকু-সেজদা করতেন যে, দর্শকেরা সন্দেহে পড়ে যেতো। ইশা এবং তারাবিহ থেকে ফারেগ হওয়ার পর দশ-এগারটার সময় আরাম করতেন। এবং দুইটা-আড়াইটার দিকে ওঠে যেতেন। অনেক সময় খাদেমগণ একটার সময়ও অজু করতে দেখতেন।

হজরত শাহ আব্দুর রহিম রায়পুরী (রহ.) রাত দুইটা আড়াইটা পর্যন্ত তারাবিতে কুরআন মাজিদ পাঠ করতেন। দিবারাত্রির চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সম্ভবত এক ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না।

শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (রহ.) তো দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় বরং গোটা রাতই কুরআন মাজিদ শুনে শুনে কাটিয়ে দিতেন। দীর্ঘ নামাজ পড়ার কারণে তার পা ফুলে যেতো।

হজরত মাওলানা মুজাফফর হুসাইন (রহ.) তিনি তো রমজান মাসে এক মুহূর্তের জন্যেও না ঘুমিয়ে সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন। আখেরাতের ভয়ে সারাক্ষণ তার দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতো।

রমজানের ইবাদতে মেয়েরাও নয় পিছিয়ে:

ইবাদত-বন্দেগিতে পুন্যবান পুরুষ মনীষীদের তুলনায় মেয়েরাও নয় পিছিয়ে কোনো অংশে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত শাইখুল হাদিস হজরত জাকারিয়া (রহ.) বলেন, আমার পরিবারের মধ্যে আমার মেয়েরা খাবার দাবার এবং সন্তানদের লালন-পালনের ব্যস্ততা সত্তে¡ও রমজানের রাতগুলোকে বিভিন্ন হাফেজদের পিছনে কুরআন শুনে কাটাতো এবং দিনের বেলায় দৈনিক কমপক্ষে ১৪/১৫ পারা তেলাওয়াত করতো। তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা চলতো, কে কত বেশি পারা তিলাওয়াত করেছে।

হজরত শায়েখ আরও বলেন, আমার দাদীও হাফেজা ছিলেন। তাই দৈনিক এক মঞ্জিল করে তিলাওয়াত করতেন। রমজানে দৈনিক চল্লিশ পারা তিলাওয়াত করতেন। এ ছাড়াও নিয়মিত শত শত বার বিভিন্ন তাসবিহ পাঠের আমল ছিল। যার পরিমাণ সতের হাজারের মতো হবে।

বড়দের সেহরি ও ইফতারি:

সারাদিন রোজা রেখে আমরা কেমন যে ক্লান্ত হয়ে যাই। আসরের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ইফতার বানানোর প্রস্তুতি। অথচ দোয়া-মুনাজাতের জন্য এই সময়টাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আকাবিরদের জীন্দেগিতে আমরা দেখতে পাই সেহরি ও ইফতারের প্রতি খুব গুরুত্ব দেয়া হতো না। অতি সাধারণ সেহরি ও ইফতার খেয়েই তারা রোজা পালন করতেন। গুরুত্ব দিতেন ইবাদত-বন্দেগিতে।

হজরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.)-কে কখনও কোনো খাদেম পাঁচটার সময় সাহরি নিয়ে গিয়েও হজরতকে নামাজে রত পেতেন। এত মেহনত-কষ্ট করা সত্তে¡ও খাবারের অবস্থা ছিল, পূর্ণ রমজানের সকল খাবার হিসাব করলে গম বা চাউলের পরিমাণ পাঁচ সেরও হবে না।

শাহ আব্দুর রহিম রায়পুরী (রহ.) ইফতার এবং সেহরি উভয় সময়ের খাবারে বড়জোর দুই পেয়ালা চা এবং এক-আধটুকু পাতালা রুটি খেতেন।

বিশ্ব দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইলিয়াস (রহ.) ইফতারের সময় বললেন, ভাই ইফতারের জন্য কিছু আছে কি? লোকেরা বললেন, সেই গোলার (এক প্রকার ডুমুর) আছে। তিনি বললেন, নিয়ে এসো। এগুলোই ইফতারি এবং মাগরিবের পরে খানাও ছিল এগুলোই। আবার সেহরির সময় খাদেমদের জিজ্ঞেস করলেন, ভাই খাবারের কিছু আছে? খাদেমরা উত্তর দিলেন, সেই গোলারই আছে। তখন ৪/৫টি গোলার খেয়ে সেহরি সেরে নিলেন।

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত ৪৩ নবাব সলিমুল্লাহ রোড, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ