উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।
করোনার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। নিস্তরঙ্গ জীবন৷ চারদিকে মৃত্যুর শঙ্কা। অসচল অবস্থা। ঘরবন্দি মানুষ। রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা থেমে গেছে। অর্থনীতির চাকা অচল। কেটে খাওয়া মানুষের চলছে দুর্দিন। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর খেয়ে-দেয়ে বেঁচে থাকাটাই বড়ো দায়। সরকার সাধ্যমতো পাশে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু মাঝপথে চুরি চালানে সব ভেস্তে যাচ্ছে।
সরকারের ত্রাণ সহায়তা থেকে ওয়ার্ড মেম্বার থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা টন টন চাল চুরি করে বস্তার পর বস্তা ভরিয়ে ফেলছেন, এমনকি অনেকের বক্স খাটের নিচেও সরকারি বিপণন সংস্থা 'টিসিবি'র শত শত ভোজ্য তেলের বোতল পাওয়া যাচ্ছে। মিডিয়ায়ও সেই চুরির খবর চাউর হচ্ছে। দরিদ্র জনগণ ঠিকঠাক সরকারি ত্রাণ পাচ্ছে না৷ সংকট হচ্ছে গণীভূত।
এমন দুর্দিনে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানো- নৈতিক, ধর্মীয় দুই দৃষ্টিকোণ থেকেই-দায়িত্ব। এ দুঃসময়ে সেবার নয়া জাগরণ সময়ের দাবি।
ইসলামে সমাজ সেবা: ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। জীবনের প্রতিটি দিকই ইসলাম গুরত্বের সাথে দেখেছে৷। সমাজসেবাও এর বাইরে না৷ সমাজ সেবা ইসলামের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ। ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা.তা শিখিয়েছেন। তার কথা ও কাজ দু'টোতেই সমাজসেবা রয়েছে। নিজে সেবার প্রতি মানুষকে উদবোদ্ধ করেছেন। প্রয়োজনের বাইরের সম্পদ মানুষকে বিলিয়েও দিয়েছেন।
ইসলামের ইতিহাস সমাজসেবার দৃষ্টান্তে ভরপুর। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার পর যে সমাজসেবা হয়েছিল ইতিহাসে তা বিরল। অভিবাসীদেরকে (মক্কা থেকে হিজরতকারী) দাঁড় করাতে রাসূল সা. মক্কার মুহাজির ও মদিনার আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে দেন। পরস্পর তারা ঘনিষ্ঠ ভাই। যেমন, আবু তালহা ও আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা৷ সহিহ মুসলিমের বর্ণণা, আনাস রা বলেন, রাসূল সা আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ ও আবু তালহার মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে দেন।(হাদিস,২৫২৮)
একইভাবে আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা ও ইবনুর রাবীর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হয়। সালমান রা ও আবু দারদা রা দু'জন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন।(সহিহুল বুখারি, কিতাবু মানকিবিল আনসার)
পরস্পর ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ মানুষজন কিভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সমাজসেবায় অপূর্ব অবদান রেখেছেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। নিজের সমুদয় সম্পদের অর্ধেক সম্পদ, দু'জন স্ত্রীর একজনকে অপর ভাইয়ের জন্য অর্পন করেছেন এই দৃষ্টান্তও আছে।
আনাস রা থেকে বর্ণিত, নবি করিম সা আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ও সা'দ ইবনুর রাবীর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। সাদ রা ছিলেন বিত্তশালী। তিনি আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে বলেন, আনসারগণ জানেন, আমি তাদের মাঝে সবচে' সম্পদশালী,তবে এ সম্পদ এখন আমার আর তোমার মাঝে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিতে চাই৷ আমার দু'জর স্ত্রী আছে৷ তাদের যাকে পছন্দ হয়, আমি তালাক দেওয়ার পর তুমি তাকে বিয়ে করে নিতে পার। (সহিহুল বুখারি, ৩৭৮১)
সমাজ সেবার গুরত্ব: কুরআন-সুন্নাহে সমাজসেবার অনেক গুরত্ব ও ফযিলতের কথা এসেছে। মানুষকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে সেবার মত সৎকারের প্রতি৷ তা অর্থ বা যে কোন পন্থায়ই হোক।
রাসূল সা ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো দুগ্ধবতী বকরি দান করে, অথবা কাউকে ঋণস্বরূপ অর্থ প্রদান করে কিংবা কাউকে পথ দেখিয়ে দেয়, সে একটি গোলাম আজাদ করার সওয়াব লাভ করবে।
অন্য হাদিসে, যে ব্যক্তির অতিরিক্ত বাহনজন্তু বা বাহনের খালি জায়গা আছে, সে যেনো বাহনহীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে৷ কোন ব্যক্তির অতিরিক্ত পাথেয় থাকলে তাহলে সে যেনো পাথেয়হীন ব্যক্তিকে তা দিয়ে সাহায্য করে। বর্ণণাকারী বলেন, নবীজি এভাবে আরো অনেক ধন-সম্পদের কথা বললেন৷ তাতে মনে হতে লাগল, প্রয়োজনঅতিরিক্ত সম্পদে বুঝি আমাদের অধিকারই নেই। (মুসলিম,১৭২৮)
মানুষের পার্থিব সংকট দূর করলে নিজের আখেরাতের সংকট সমাধা হয়। প্রিয় নবীজি সা ইরশাদ করেছেন, কেউ যদি কোন মু'মিনের একটি পার্থিব সংকট কাটিয়ে দেয়, তাহলে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি সংকট কাটিয়ে দিবেন। (মুসলিম, ২৬৯৯)
দূর্যোগপূর্ণ মহূতর্তে আপনি আপনার ভাইকে সাহায্য করছেন, ওদিকে আপনি আল্লাহর সাহায্য পাচ্ছেন৷
হাদিসে নববির ইরশাদ, বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় রত থাকে, আল্লাহও ততক্ষণ তাদের সহযোগিতা করতে থাকেন।'(মুসলিম, ২৬৯৯)
সেবা উচ্চবিত্তের নৈতিক দায়িত্ব: করোনা ইস্যুতে চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে মানুষ।
এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দরিদ্র জনগণের পাশে দাঁড়ানো উচ্চবিত্তের নৈতিক দায়িত্ব। এবং ইসলামের দৃষ্টিতেও তা গুরত্বপূর্ণ৷ আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বান্দাকে বলবেন,
হে বনী আদম! আমি পিপাসার্ত ছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি৷ বান্দা তখন বলবে, হে আল্লাহ!,আপনি উভয় জাহানের প্রতিপালক। আপনাকে কিভাবে পানি পান করাবো? আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা পিপাসার্ত হয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাওনি। যদি তাকে পান করাতে তাহলে সেখানে আমাকে পেতে। (আজ তার প্রতিদান পেতে)।
হে বনি আদম! আমি পীড়িত ছিলাম৷ কিন্তু তুমি আমার সেবা করনি৷ তখন বান্দা বলবে, আপনি উভয় জাহানের প্রতিপালক, কিভাবে আমি আপনার সেবা করবো? তখন আল্লাহ তা'য়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, কিন্তু তুমি তার সেবা করনি। যদি তুমি তার সেবা করতে, তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে৷... (ইবনে হিব্বান,২৬৯)
আজকের সামাজিক সংকটে সহায়তার কাজটা তাদের জন্য সহজ। দরকার যা তা হলো, বিলাসী জীবনের পরিধি কিছুটা কমিয়ে আনা। অথচ এ বিষয়ে তারা উদাসীন৷ বর্তমান বাংলাদেশে পুঁজিপতি শ্রেণির সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে৷ তাদের কাছে দেশের মোট সম্পত্তির অর্ধেকেরও বেশি। তারা বিলাসী জীবন-যাপন করছেন৷ ওদিকে (করোনা ইস্যু ছাড়াই) লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা, সহায়-সম্বলহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের এদিকে খেয়াল করার ফুরসত কোথায়? পুঁজিবাদের সওয়াব কামাতে তারা প্রতিযোগিতা করবেন নাকি দারিদ্র প্রশ্নের প্রতি তাকাবেন?
সম্পদের মূল মালিক মানুষ না। আল্লাহ তায়ালা মানুষের সকল সম্পদের প্রকৃত মালিক। মানুষকে তিনি দান করেছেন৷ তাই তার এঁকে দেওয়া নির্ধারিত চকের আলোকেই সম্পদ খরচ করতে হবে। মানুষের সম্পত্তিতে ধর্মীয়, সামাজিক ইত্যাদি হক (অধিকার) রয়েছে। যাকাত, ফিতরা, নফল অনুদান ইত্যাদি।
যাকাত এটা ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিষয়ের একটি। সামর্থবানদের যাকাত আদায় করা ফরজ। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ এবং এটাই সত্য পুঁজিপতিরা যথাযথ যাকাত আদায় করছেন না। ধর্মীয় সঠিক জ্ঞান ও মূল্যবোধের অভাবে বা পুঁজিবাদের উন্মত্ত প্রতিযোগিতার ঘোরে ইসলামের বিধি পালনে শিথিলতার কারণে। কেউ পালন করছে বটে, তবে তা পূর্ণাঙ্গ না৷
কুরআন সুন্নাহে অনৈতিকভাবে সম্পদ পুঞ্জিভূত, যাকাত ইত্যাদি আদায় না করার ব্যাপারে কঠোর ধমকি এসেছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি মেলবার তাদের সুযোগ নেই যেনো। যাকাতসহ ইসলামের দ্বীনি ও সামাজিক অধিকার যথাযথ আদায় হলে সমাজের বৈষম্য অনেক কমে যেতো। কিন্তু পশ্চিমা পুঁজিবাতের উদ্দাম প্রতিযোগিতা এই সত্যকে ঢেকে রেখেছে।
জাতির এই দূর্যোগপূর্ণ মহূর্তে যদি যাকাতসহ আর্থিকক্ষেত্রে ইসলামে মানুষের সামাজিক অধিকার বিধানটির প্রতি সবিশেষ গুরত্বারোপ করা হয়, তাহলে যাকাতের উপযুক্ত দরিদ্র জনগণের জন্য তা বিরাট কল্যাণ বয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস।
দুর্দিনে কিছু মহৎ মানুষ: আজকের করোনার দূর্যোগপূর্ণ মহূর্তে সচেতনতা বা বাধ্য যে করেই হোক সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে৷ করোনা সন্দেহে কলিজার টুকরো মাকে সন্তানদের জঙ্গলে ফেলে আসা, বন ছেড়ে ভয়ে মা পালিয়ে ফিরে আসার খবরও মিডিয়ার বেরিয়েছে। যার অর্থ দাঁড়ায়, করোনার গযবে শুধু মানুষ মরছে না, মানবিক সম্পর্কেও এক ধরনের ফাটল ধরছে। এসবের ভিতরেও কিছু মানুষ উল্টোস্রোতে চলছেন৷ এই উল্টোস্রোত ভালো অর্থে। তারা জীবনের ঝুঁকি হাতে নিয়ে নিরলস কাজ করছেন। সমাজসেবায় দূর্লভের মতো সাক্ষর রাখছেন। আমরা এখানে সবিশেষ দু'শ্রেণীর মহৎ মানুষের কথা বলবো৷ এক. কওমি তরুণ সমাজ। দুই. মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত ডাক্তার সমাজ।
কওমি তরুণ সমাজ: ভয়-আতঙ্ক ইত্যাদি কারণে যখন কেউ পাশে আসতে চায় না, রাস্তায় নিথর পড়ে থাকে লাশ, মৃত্যুর পর কাফন-দাফনে সর্বচ্চো দূরে থাকার চেষ্টাকরে মানুষ, এমনকি পরিবারের মানুষজনও, তখন কওমী তরুণরা এগিয়ে এসেছে মিডিয়ায় এরকম প্রমাণ গত ক'দিন ধরে দেখা গেছে৷
আল মারকাজুল ইসলামিসহ বিভিন্ন সেবা সংগঠন কাফন- দাফনের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। জেলাভিত্তিক টিম গঠন করে, থানাভিত্তক কাজও চলছে৷ ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামছে। যারা কোন বাছ-বিচার ছাড়া আস্তে করে 'কওমি' শব্দটাকে সমাজসেবা ছেঁটে ফেলেন, তাদের অন্তত করোনা ইস্যুতে ভাবার আছে৷
ডাক্তার সমাজ: করোনা সেবায় নিয়োজিত ডাক্তারদের কথা চিরদিন আমরা ভুলতে পারবো না৷ জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে তারা মাঠে কাজ করছেন৷ এতে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক। ডা. মঈন তো চলেই গেলেন। এছাড়া গতকালের গণমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে,....' করোনায় দেশে এ পর্যন্ত ৯০ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে কোয়ারেন্টাইনে আছেন প্রায় ৩০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী।
এরমধ্যে নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন একজন। এছাড়াও মৃত্যু হয়েছে ডা. মো. মঈন উদ্দিন নামে এক চিকিৎসকের। এরমধ্যে তিনজন সুস্থ হয়ে ছুটি পেয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫৩ জন। বাকিরা বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন।'
উদ্দেশ্যেই যাই হোক, অন্তত এই সময়টাতে তাদের কাজগুলোকে সমাজসেবাই বলতে হবে৷ কারণ, জীবন সায়াহ্নে তারা মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে কল্যাণ সাধন করছেন৷ জনকল্যাণমূলক যে কোন কাজই সাধারণভাবে সেবা।
এরা সবাই কৃতজ্ঞতা পাবার যোগ্য। তাদের এই কাজগুলোকে স্বাগত না জানাতে পারলে আমাদের বড়োই অকৃতজ্ঞতা হবে৷
من لم يشكر الناس لم يشكر الله যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করলো না, সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারে না।
রাসূল সা বলেছেন, কাউকে কোন ভালো কাজ করে দেওয়ার পর সে যখন (অনুগ্রহকারী ব্যাক্তিকে) "জাযাকাল্লাহ" বলে, তখন সে তার পূর্ণ প্রশংসা করল'। (তিরমীযি২০৩৫)।
লেখক: অধ্যায়নরত, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া।
-এটি