শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


করোনাভাইরাস: সতর্কতার জন্য মসজিদে জামাত সীমিত করা কি জায়েজ? জমহুর আলেমদের চূড়ান্ত মতামত কী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ
মহা পরিচালক- জামিয়া শায়েখ যাকারিয়া ইসলামিক রিচার্স সেন্টার>

সম্প্রতি মিডিয়াতে দুটি বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্ক পরিলক্ষিত হচ্ছে। ১)সরকারী সিদ্ধান্ত তথা জামাত ও জুমা'র নামাজে ৫জন ১০জন মুসল্লীর সংখ্যা নির্ধারণ। ২)মসজিদগুলো খুলে দেয়ার দাবী জানিয়ে বিশিষ্ট আলেমদের বিবৃতি।

এ নিয়ে আমার বক্তব্য নিম্নে প্রদান করছি।

(১) বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট মহামারী সকলের কাছে স্পষ্ট। আমাদের দেশও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের অনেক জেলায় লকডাউন চলছে। সরকার ও জনগণ চরম উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকার ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত দিকনির্দেশনাসমূহ মেনে চলা হাদীসেরই নির্দেশ। এ জাতীয় সতর্কতা অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থী কিছু নয়, বরং নবীজির সা. সুন্নাত ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ। উল্লেখ্য, মুসলমানদের আকীদা হচ্ছে রোগ, বালাই, মহামারী সবই আল্লাহর হুকুমে আসে, এবং তাঁর হুকুমেই নিরাময় হয়।

আল্লাহ্ তায়ালা কিছু রোগ বালাইয়ের মধ্যে সংক্রমণের শক্তি দিয়েছেন। যখন যখন আল্লাহর হুকুম হবে তখনই তা সংক্রমণিত হবে, অন্যথায় নয়। তবে কোনো রোগ নিজস্ব ক্ষমতাবলে সংক্রমণ করতে পারে না। এটাই হচ্ছে নবীজির হাদীস তথা لا عدوي ولا هامة ولا صفر ও فمن أعدي الأول ও فر من المجذوم كما تفر من الأسد এবং لا يورد ممرض علي مصح এসব বিরোধপূর্ণ হাদীসের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা ও আকীদা। করোনা ভাইরাস চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমনই এক সংক্রমণিত মহামারী রোগ।

(২) করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সতর্কতা অবলম্বনের অন্যতম একটি বিষয় হলো সব ধরণের জনসমাগম এড়িয়ে চলা। এখান থেকে আমাদের এজতেমায়ী ইবাদত তথা মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমা' , তারাবী ও ঈদের জামাত ইত্যাদির মধ্যে জমায়েতের বিষয়টি উঠে আসে। এ বিষয়টি নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেশের শীর্ষ আলেমদের সমন্বয়ে প্রথম বৈঠকটি করেন ২৪ই মার্চ ২০২০ইং। সেখানে উলামায়ে কেরাম কুরআন সুন্নাহর আলোকে মসজিদে মুসল্লীদের জমায়েতের ক্ষেত্রে সীমিতকরণের সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।

(৩) ২৪ই মার্চের সিদ্ধান্তে সীমিতকরণ শব্দটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা না থাকায় জনগণের মাঝে এ নিয়ে একরকম সংশয় ও সন্দেহের সৃষ্টি হয় । সে কারণে সীমিতকরণের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও বিশ্লষণের জন্য ২৯ই মার্চে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে দ্বিতীয় ও শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । সেই বৈঠকে উলামায়ে কেরাম জুমা' ও জামাতে অংশগ্রহণ সীমিতকরণের ব্যাপারে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। যার সারনির্যাস নিম্নরূপ:- মসজিদে নিয়মিত আজান,ইকামত, জামাত ও জুমা' সবই অব্যাহত থাকবে । তবে জুমা ও জামাতে নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করবে না।

[ক] যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। [খ] যাদের সর্দি, জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট আছে। [গ] যারা করোনায় আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চল থেকে ফিরে এসেছেন। [ঘ] যারা অনুরূপ মানুষের সংস্পর্শে গিয়েছেন। [ঙ] যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। [চ] যারা বয়োবৃদ্ধ, দুর্বল, মহিলা ও শিশু। [ছ] যারা অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ।
[জ] যারা মসজিদে গেলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কাবোধ করেন তাদেরও মসজিদে না আসার অবকাশ রয়েছে।

(৪) উপরোক্ত আট শ্রেণীর লোক ছাড়া সকলের জন্য মসজিদে গিয়ে জামাত ও জুমা'য় অংশগ্রহণ করা জরুরী । তবে তাদের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অবলম্বন করা অপরিহার্য

[ক] বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনা ভাইরাস থেকে পরিত্রাণের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বনের যে পরামর্শ দিয়েছেন তা অবশ্যই অবলম্বন করবে। [খ] নিজ নিজ ঘরে অযু করবে, সুন্নাত পড়বে। শুধু খুতবা ও জামাতের সময় মসজিদে যাবে। [গ] ফরজ নামাজ ও দোয়ার শেষে দ্রুত ঘরে ফিরে আসবে। বাকী সুন্নাত, নফল ঘরে আদায় করবে।
[ঘ] মসজিদে প্রবেশের পূর্বে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলে ধুয়ে নেবে। মাস্ক পড়ে মসজিদে আসবে। হঠাৎ হাঁচি কাশি আসলে টিস্যু বা বাহুতে মুখ ঢাকবে।

[ঙ]মুসল্লীরা কাতারের মাঝে কিছুটা ফাঁক রেখে দাঁড়াবে। উল্লেখ্য, কাতারের মাঝে ফাঁক রাখা স্বাভাবিক অবস্থায় মাকরুহ হলেও পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে কাতারের মাঝে ফাঁক রাখার অবকাশ আছে বলে বিজ্ঞ মুফতিয়ানে কেরাম ফতোয়া দিয়েছেন। [চ] ইমাম ও খতীবদের জন্য উচিত জামাত, জুমার বয়ান, খুৎবা, দোয়া সংক্ষিপ্ত করা।

[ছ] মসজিদ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা। কার্পেট কাপড় সরিয়ে ফেলা। সম্ভব হলে মসজিদের প্রবেশদ্বারে মুসল্লীদের জন্য সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা।

এই ছিলো বিগত ২৯ই মার্চ ইফার বৈঠকের সিদ্ধান্তের সারকথা ।

(৫) ২৯ই মার্চের উপরিউক্ত সিদ্ধান্তবলী শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী হাফি., আল্লামা আব্দুল হালিম বুখারী সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের মতামতের ভিত্তিতে ও দেশের শীর্ষ ১২জন আলেমের স্বাক্ষরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জারী হয়।

উল্লেখ্য, বিরাজমান পরিস্থিতিতে মসজিদে জামাত জুমা' ইত্যাদি সম্পর্কে এটিই ছিলো দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত সর্বশেষ সিদ্ধান্ত বা ফতোয়া। এর পর অদ্যাবধি নতুন কোনো ফতোয়া দেয়া হয়নি, এবং এজন্য কোনো বৈঠকও ডাকা হয়নি। বিশেষ করে মসজিদে মুসল্লীদের সংখ্যা নির্ধারণের কোনো ফতোয়া আমার জানামতে কোন মুফতি প্রদান করেননি।

যদি কেউ মনে করেন ৫জন ১০জন দিয়ে জামাত,জুমা আদায়ের সরকারী সিদ্ধান্ত উলামায়ে কেরামের ফতোয়ার ভিত্তিতে করা হয়েছে তবে তাদের সে ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। কারণ আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু বুঝে আসে তাতে জামাত ও জুমাতে মুসল্লীদের নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া শরীয়া ও ফতোয়ার কোন নীতিমালায় পড়ে না। তবে কোন মুসলিম সরকার যদি নিজস্ব ক্ষমতাবলে জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে কোনো জরুরী অবস্থায় এমন সংখ্যা নির্ধারণ করে থাকে সেটি ভিন্ন ব্যাপার।

(৬) বিগত ৬ই এপ্রিল ২০২০ তারিখে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের স্বাক্ষরে "জরুরী বিজ্ঞপ্তি" শিরোনামে সরকারী সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হলো যে দেশে করোনা ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করায় এবং পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হওয়ায় সব ধরণের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হলো, এবং সবাইকে ঘরে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হলো। উক্ত সরকারী সিদ্ধান্তে ওয়াক্তিয়া নামাজে ৫জন , জুমা'র জামাতে ১০জন মুসল্লী দ্বারা মসজিদগুলোতে নামাজ চালু রেখে বাকী মুসল্লীদের নিজ নিজ ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেয়া হলো।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে উলামায়ে কেরাম সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি, বরং তা মেনে চলাকে বৈধতা দিয়েছেন। শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী হাফি. লিখিত আকারে সরকারী সিদ্ধান্তের সমর্থন জানিয়েছেন। যা অনেক মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। ৬ই এপ্রিল আমি নিজেও মিডিয়াতে এ সিদ্ধান্তের সমর্থনে একটি ভিডিওবার্তা দিয়েছি। কিন্তু এপ্রিলের ৮তারিখ সরকারী সিদ্ধান্তের বিপক্ষে দেশের শীর্ষ সন্মানিত ১৫জন আলেমের বিবৃতি মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়। তাঁরা মসজিদগুলোতে মুসল্লীদের সীমিতকরণের বিরোধিতা করে সকলের জন্য মসজিদগুলো উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবী জানান।

তাদের এই দাবীর পক্ষে যুক্তি প্রমাণ অবশ্যই আছে। তারা এ দাবী করার অধিকারও রাখেন। আমরা তাদের এই দাবীকে প্রত্যাখান করিনি, তবে তারা যদি শুধু সংখ্যা নির্ধারণের বিরোধিতা করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২৯ই মার্চের উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়নের দাবী জানাতেন তাহলে আমার দৃষ্টিতে তা অনেক ভালো ছিলো। কারণ, ঐ সিদ্ধান্তে সীমিতকরণের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা ছিলো কুরআন সুন্নাহর আলোকে। এবং সেটি ছিলো উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত ফতোয়া ।

(৭) গত শুক্রবার ১০ই এপ্রিল দেখা গেল মুসল্লীদের সংখ্যা নির্ধারণের সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মসজিদগুলোর গেইটে/দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে , যা ফতোয়ার আলোকে জুমা'র নামাজ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে একটি সংশয়-সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মসজিদে ৫জন১০জনের অধিক মুসল্লী হওয়ায় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের অপদস্থ করা হয়েছে।

জুমার দিনে বহু লোক মসজিদে ঢুকতে না পেরে গেইটের বাহিরে যুহর আদায় করেছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে ১০জন নিয়ে জুমা' হয়েছে ; অথচ সেখানে ২০জনের অধিক সাংবাদিক মুসল্লীদের ছবি নেয়ার জন্য মসজিদের ভেতরেই সমবেত হয়েছে। যা ইসলাম, দ্বীন,নামাজ,ইবাদত নিয়ে প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। এসব ঘটনায় মনে হচ্ছে সরকারী এ সিদ্ধান্তটি ইসলামের বিপক্ষে নাস্তিক,বেঈমানদের পক্ষে বিরাট ভূমিকা রাখছে।

তাই উল্লেখযোগ্য মনে করছি
[ক] আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, দেশের কোনো জায়গায় শতভাগ লকডাউন বাস্তবায়ন হতে দেখা যাচ্ছে না, রাস্তাঘাট, বাজারঘাট, ব্যাংকসমূহে শত শত মানুষ প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে জমায়েত হচ্ছে । সেখানে সরকারী আইন বাস্তবায়ন করতে কোনো কড়াকড়ি দেখা যাচ্ছে না, তাহলে মসজিদগুলোর জামাতে সংখ্যা নির্ধারণের ব্যাপারে এত কড়াকড়ি কেন?!? এতে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে এর দ্বারায় কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হচ্ছে?

[খ] সরকার মানুষের জৈবিক চাহিদার পূরণ করণার্থে যদি সকাল থেকে দুপুর ১২টা বা ২টা পর্যন্ত দোকানপাট, বাজারঘাট খোলা রাখতে পারে তাহলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য ১০মিনিট করে দিনে মাত্র ৫০মিনিট এবং জুমার জন্য মাত্র ১৫/২০মিনিট সময়ের জন্য মুসলমানদের আত্মিক চাহিদা পূরণ করণার্থে মসজিদগুলোকে খোলা রাখতে পারবে না কেন?

[গ] সারা দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আমাদের প্রবল ধারণা, মজসিদে মুসল্লীদের সংখ্যা নির্ধারণের সরকারী সিদ্ধান্ত এবং তা প্রয়োগের যে ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে তা মোটেই ফলপ্রসূ ও গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
[ঘ] যেসব যুক্তিযুক্ত কারণে সরকারী সিদ্ধান্তটি উলামায়ে কেরাম মেনে নিয়েছিলেন আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে সেই যুক্তিযুক্ত কারণগুলো বর্তমানে বিদ্যমান নেই।

(৮) উপরিউক্ত কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সরকার কর্তৃক সরকারী সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ৫জন ১০জন দিয়ে মুসল্লী সীমিতকরণ, মসজিদগুলোতে তালা লাগানো, গেইট বন্ধ করে বাইরের লোকগুলোকে মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধাজ্ঞা জারী করা, দুই চারজন মুসল্লী বেশী হয়ে গেলে ইমাম ও খতীবদেরকে তার জন্য হেস্তনেস্ত করা অথচ রাস্তাঘাট, বাজারঘাটে সে রকম কড়া ব্যবস্থা না নেয়া এ বিষয়গুলো ভারসাম্যহীন হওয়ার কারণে তা শরীয়া পরিপন্থী হওয়ায় এখনই তা বন্ধ করা জরুরী।

(৯) বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সরকার কর্তৃক সংখ্যা নির্ধারণের সিদ্ধান্তকে রহিত করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ২৯ই মার্চের বৈঠকে শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তের দিকে সরকারের ফিরে আসা অতীব জরুরী ।

(১০) আগত রমজান মাসে মসজিদে তারাবীর জামাত বন্ধ করা যাবে না। মসজিদে মুসল্লীদের সংখ্যা নির্ধারণ নয়, বরং শরিয়তের আলোকে জুমা'ও জামাতে মুসল্লীদের অংশগ্রহণ সীমিতকরণের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতঃ সকল মসজিদের দরজা খুলে দেয়া দরকার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত, জুমা' ও আগত রমজান মাসের তারাবী ইত্যাদির জন্য ২৯ই মার্চের উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা অবলম্বনের শর্তে মসজিদগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। এ কারণেই ১৪ই এপ্রিল আমার ফেইসবুক আইডি থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর মসজিদগুলোর গেইট খুলে দেয়ার এবং যাদের জন্য মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করা জরুরী তাদের জন্য মসজিদগুলো উন্মুক্ত করার দাবী ও আহ্বান জানিয়েছিলাম।

(১১) দেশের সম্মানিত কিছু উলামায়ে কেরাম ইতিমধ্যে সর্বসাধারণের জন্য মসজিদগুলোকে উন্মুক্ত করার যে দাবী তুলেছেন (তাদের যথাযথ মাকাম, শ্রদ্ধা ও সন্মান ধারণ করে বিনীত ভাবে বলছি) আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের দাবীর সাথে আংশিক একমত হলেও পরিপূর্ণ একমত হতে পারছি না । কারণ শীর্ষ উলামায়ে কেরামের ২৪ ও ২৯ ই মার্চের বৈঠকে মসজিদে মুসল্লীদের অংশগ্রহণ সীমিতকরণের বিষয়টি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। হযরত শাইখুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী হাফি. লিখিত আকারে সীমিতকরণের বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন। তাই এর বাইরে যাওয়ার শরয়ীভাবে কোনো মজবুত দলীল আমার কাছে নেই ।

বি.দ্র.উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে বর্তমানে বিরাজমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমার ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করলাম । আগামীকাল ১৬ই এপ্রিল সকাল ১০টায় পীরজঙ্গী মাজার মাদরাসায় হাইয়াতুল উলয়া কর্তৃক জাতীয় মুফতি বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ । এতে আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী হাফি. হযরত মাও. আতাউল্লাহ হাফেজ্জী হাফি. সহ ঢাকার শীর্ষস্থানীয় আলেম ও মুফতিগণ অংশগ্রহণ করবেন।

সেখানে এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ মুফতিয়ানে কেরামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করছি।

সম্পূরক বক্তব্য
সারাদেশের উলামা মহল থেকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুফতি আব্দুস সালাম হাফি. এর সাম্প্রতিক কয়েকটি ফতোয়ার উপর আমার কাছে মতামত জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে আমার সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্য পর্যালোচনা:

[ক] সর্বশ্রদ্ধেয় বিজ্ঞ একজন মুফতি সাহেবের ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে যে, মুসল্লীদের সংখ্যা নির্ধারণপূর্বক সরকারী সিদ্ধান্তটি শরীয়ত বিরোধী, জুলুম বা অন্যায়। কুরআনের আয়াত و من أظلم ممن منع مساجد الله أن يذكر فيها اسمه و سعي في خرابها এর দ্বারা তিনি দলীলও পেশ করেছেন।

হযরত মুফতি সাহেবের যথার্থ সম্মান মাথায় রেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিনয়ের সহিত তার ফতোয়ার সাথে ভিন্নমত পোষণ করছি। কারণ সরকারী সিদ্ধান্তে মসজিদগুলোতে জুমা' ও জামাত চালু রাখার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। পরিপূর্ণভাবে মসজিদ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আসেনি, যেমন আরব দেশগুলোতে করা হয়েছে। হ্যাঁ, যাদেরকে মসজিদে জমায়েত হতে বারণ করা হচ্ছে তা নিছক মসজিদ ও জামাত থেকে বারণ করা নয়, মূলত ভাইরাস সংক্রমণ রোধে জনস্বার্থের কারণে এই গণজমায়েত থেকে বারণ করা হচ্ছে। সুতরাং এ সিদ্ধান্তটিকে উপরিউক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত করে জুলুম বা হারাম সাব্যস্ত করার বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়।

ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে (১/১৫৮দারুল ফিকর) উল্লেখ আছে,

الإمام إذا منع أهل المصر أن يجمعوا لم يجمعوا. قال الفقيه أبو جعفر رحمه الله ، هذا إذا نهاهم مجتهدا بسبب من الأسباب و أراد أن يخرج ذلك الموضع من أن يكون مصرا، فأما إذا نهاهم متعنتا أو ضرارا بهم فلهم أن يجتمعوا علي رجل يصلي بهم الجمعة ، كذا في الظهيرية.
ইমাম সারাখসীর মাবসূত কিতাবে আছে(২/৩৩ دار المعرفة)

(قال) و إذا فزع الناس فذهبوا بعد ما خطب الإمام لم يصل الجمعة إلا أن يبقي معه ثلاثة رجال سواء لان الجماعة من شرائط افتتاح الجمعة. و قد بيّنّا اختلافهم في مقدارها و إن بقي ثلاثة من العبيد أو المسافرين يصلي بهم الجمعة لأنهم يصلحون للإمامة فيها بخلاف ما إذا بقي ثلاثة من النساء أو الصبيان و إن كان صلي بالناس ركعة ثم ذهبوا أتم صلاته جمعة عندنا.
আরো দেখুন, বিনায়া শরহুল হিদায়া (৩/৭৮ دار الكتب العلمية)

[খ] উলামায়ে কেরামের ২৯ই মার্চের বৈঠকে কাতারের মাঝে মুসল্লীদের কিছুটা ফাঁক ফাঁক করে দাঁড়ানোর অবকাশ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এদিকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুফতি সাহেব এটাকে সুন্নাহ বিরোধী ও গোমরাহী বলে আখ্যা দিয়েছেন । হযরত মুফতি সাহেবের এ ফতোয়ার সাথে আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মতভিন্নতা পোষণ করছি।

কারণ কাতারের মাঝে ফাঁক রাখার ব্যাপারে হাদীসে নিষেধ করা হলেও এবং ফতোয়ার আলোকে তা মাকরুহ হলেও সেটি হলো স্বাভাবিক অবস্থার কথা। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন, প্রবল সম্ভাব্য রোগ সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার স্বার্থে কিছুটা ফাঁক ফাঁক হয়ে দাঁড়ানো মোটেও অবৈধ নয়। হাদীস ও ফতোয়ার কিতাবে এর প্রমাণ বিদ্যমান আছে।
যেমন ফতোয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে (১/৫৬৮)

و إن وجد في الصف فرجة سدها و إلا انتظر حتي يجيء آخر فيقفان خلفه..... و لو لم يجد عالما يقف خلف الصف بحذاء الإمام للضرورة و لو وقف منفردا بغير عذر تصح صلاته عندنا خلافا لأحمد (باب الإمامة و كذا فيه أيضا ١/٦٤٧ و كذا في البحر الرائق ١/٦١٧)

[গ] বর্তমান পরিস্থিতিতে যে শ্রেণীর মানুষের জন্য মসজিদে গমন উচিত নয় তাদের জন্য জুমার দিনে ঘরে ঘরে বিকল্প জুমা কায়েম করা আমি ব্যক্তিগতভাবে সহীহ মনে করি না। বরং তাঁরা নিজ নিজ ঘরে যুহরের নামাজ একাকী বা জামাতের সাথে আদায় করে নেবে। তবে পাঞ্জেগানা মসজিদগুলোতে বা বড় কোন আবাসিক বিল্ডিংয়ে খোলা জায়গায় সকলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে জুমা আদায় করা যেতে পারে।

উল্লেখ্য, এই মাসআলাটিতে যে কোন বিজ্ঞ মুফতি সাহেবের দ্বিমত পোষণের অবকাশ আছে। এ ধরণের কোনো মুফতি সাহেব যদি ঘড়বাড়িতে জুমা পড়ার ফতোয়া দেন সে ফতোয়ার ভিত্তিতে যারা জুমা ' আদায় করবেন তাদের জুমা'ও আদায় হয়ে যাবে।

বি.দ্র. উপরিউক্ত ফিকহী বিষয়গুলো সম্পূর্ণ ইজতেহাদী ও গবেষণালব্ধ। এগুলোর মধ্যে বিজ্ঞ মুফতি সাহেবদের মতের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলে তা নিয়ে সমালোচনা করা, হৈহুল্লা করা মোটেই সমীচীন নয়।

ফিকাহ ফতোয়ার অধিকাংশ কিতাবে নিম্নোক্ত এবারতটি উদৃত আছে

و كذا أهل مصر فاتتهم الجمعة يصلون الظهر بغير أذان ولا إقامة و لا جماعة

ইমদাদুল আহকাম কিতাবে (১/৭৮৩) ظهيرية ও خلاصة এর উদৃতিতে বলা আছে
جماعة فاتتهم الجمعة في مصر فإنهم يصلون الظهر الخ আদদুররুল মুখতারে আছে (৩/৩২-৩৩)

و كره تحريما لمعذور و مسجون و مسافر أداء ظهر بجماعة في مصر قبل الجمعة و بعدها لتقليل الجماعة و صورة المعارضة
তাহতাবী আলাল মারাকী কিতাবে আছে (পৃ.৫২২)

و وجه الكراهة أنها تفضي إلي تقليل جماعة الجمعة لأنه ربما تطرق غير المعذور للإقتداء بالمعذور. و لأن فيه صورة المعارضة بإقامة غيرها.
[১]এসব দলীলে যা দেখা যায়, যারা জুমা'র নামাজ পড়তে পারবে না তারা ঘরে যুহর আদায় করবে।

[২] তবে যুহরের নামাজ তিন কারণে জামাতে নয় একাকী আদায় করবে, যেমন তাহতাবীতে উল্লেখ হয়েছে। উপরোক্ত তিনটি কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যমান না থাকায় জামাতের সহিত জুমা পড়া বৈধ হবে। সাধারণ অবস্থায় এমদাদুল আহকামে আল্লামা শামীর বরাতে জামাতে যুহর পড়াকে যদিও মাকরুহে তানযীহি বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে উক্ত কারণগুলো বিদ্যমান না থাকায় (ইল্লত মাফকূদ হওয়ায় ) মাকরুহে তাহযীহিও আর থাকবে না।

ফতোয়াটি দিয়েছেন বিশ্ববরেণ্য মুফতি শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানি, শাহী মুরাদাবাদের মুফতি শাব্বির আহমদ কাসেমীপ্রমুখ।

উল্লেখ্য , উপরিউক্ত ফতোয়াটি অমুসলিম দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং শুধু মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । আমি নিজেও এ ফতোয়ার সাথে একাত্মতা পোষণ করি।

[ঘ] বিগত ১০ই এপ্রিল মসজিদগুলোতে সীমিত সংখ্যক লোক দিয়ে, মসজিদের দরজা বন্ধ করে জুমা' আদায় করা এবং বাকীদেরকে মসজিদে প্রবেশ করতে না দেয়ায় শ্রদ্ধেয় মুফতি সাহেব ফতোয়া দিয়েছেন যে যারা মসজিদে জুমা' পড়েছে তাদের জুমা' হবে না। কারণ এখানে "ইযনে আম" পাওয়া যায়নি।

তিনি ফতোয়ায়ে শামী, আলমগিরি ও আলবাহরুর রায়েক্ব ইত্যাদি গ্রন্থের এবারত উল্লেখ করে দলীল পেশ করেছেন।
আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মুফতি সাহেব সমীপে আরয করতে চাই যে, যেসব ফতোয়ার কিতাবের রেফারেন্স তিনি দিয়েছেন সেখানে পূর্বে ও পরে নিম্নের এবারত উদৃত আছে। যেগুলো পড়লে দেখা যায় এই বিশেষ অবস্থায় "ইযনে আম" বিলুপ্ত হয়নি তাই জুমা'র নামাজও অশুদ্ধ নয় বরং সহীহ হয়েছে। যেমন,
ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে আছে (১/১৫৮দারুল ফিকর)

الإمام إذا منع أهل المصر أن يجمعوا لم يجمعوا. قال الفقيه أبو جعفر رحمه الله ، هذا إذا نهاهم مجتهدا بسبب من الأسباب و أراد أن يخرج ذلك الموضع من أن يكون مصرا، فأما إذا نهاهم متعنتا أو ضرارا بهم فلهم أن يجتمعوا علي رجل يصلي بهم الجمعة ، كذا في الظهيرية.
ফতোয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে ( ২/১৫২)

و كذا السلطان إذا أراد أن يصلي بحشمة في داره..... و إن لم يفتح أبواب الدار و أغلق الابواب..... لم تجز.... قلت و ينبغي أن يكون محل النزاع ما إذا كانت لا تقام إلا في محل واحد أما لو تعددت فلا. لأنه لا يتحقق التفويت كما أفاده التعليل فتأمل.
আল্লামা হাসকাফী রহ. লেখেন (২/১৫২আদদুররুল মুখতার)

فلا يضر(الغلق) علي باب القلعة لعدو أو لعادة قديمة. لأن الإذن العام مقدر لأهله. و غلقه لمنع العدو لا المصلي. نعم، لو لم يغلق لكان أحسن كما في مجمع الأنهر.

মাজমাউল আনহুর গ্রন্থে বলা হয়েছে (১/২৪৬)
و ما يقع في بعض القلع من غلق أبوابه خوفا من الأعداء أو كانت له عادة قديمة عند حضور الوقت فلا بأس به. لأن الإذن العام مقدر لأهله ولكن لو لم يكن لكان أحسن كما في شرح عيون المذاهب.....

$আল্লামা শুরুম্বুলালী উল্লেখ করেন
قلت، اطلعت علي رسالة للعلامة ابن شحنة. و قد قال فيها بعدم صحة الجمعة في قلعة القاهرة. لأنها تقفل وقت صلاة الجمعة.... و أقول في المنع نظر ظاهر. لأن وجه القول بعدم صحة صلاة الإمام بقفله قصره اختصاصه بها دون العامة و العلة مفقودة في هذه القضية.....
(مراقي اللفلاح مع الطحطاوي ص٢٧٨)

সারকথা
উপরিউক্ত দলীলগুলোর দ্বারা যা বুঝে আসে তা হলো, মসজিদের মধ্যে সীমিত সংখ্যক মুসল্লী দ্বারা দরজা বন্ধ করে জুমা' আদায় করা হলে, অন্যদের মসজিদে প্রবেশ নিষেধের কারণ যদি হয় দুশমনদের ভয়ভীতি অথবা প্রাচীন কালের রীতিনীতি অনুসরণে নামাজের পূর্বে গেইট বন্ধ করা তাহলে তা জুমা' শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধক হয় না। সুতরাং সরকার কর্তৃক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দরজা বন্ধ করে অন্যদেরকে প্রবেশ করতে না দিলে মসজিদে জুমা' আদায়কারীদের জুমা' সহীহ হবে না কেন?

বিষয়টি নিতান্তই গবেষণালব্ধ। এখানে মতভিন্নতা হতেই পারে। এটি আমার ব্যক্তিগত মতামত। শ্রদ্ধেয় মুফতি সাহেবের নিকট এসব দলীলের বিপক্ষে অন্য দলীলও থাকতে পারে; যে কারণে তিনি জুমা' সহীহ না হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন ।

هذا إن كان الصواب فمن الرحمن و إن كان الخطأ فمني و من الشيطان. و الله تعالي أعلم بالصواب

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ