শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আঞ্জুমানে তা’লিমুল কুরআনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খে ভানুগাছী রহ. একটি ইতিহাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাইখুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক শাইখে ভানুগাছী রহ. একটি সংগ্রাম, একটি ইতিহাস। কুরআনের সহিহ তা’লিমের জন্য সারাজীবন ধরে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি মরেও অমর। বৃহত্তর সিলেট থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে শুদ্ধ কুরআন শিক্ষা দানের এক মহান শিক্ষক ও উদ্যোক্তা। কুরআন নাযিলের মাস পবিত্র রমজানে তার প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে তা’লিমুল কুরআন পরিচালিত সহস্রাধিক কেন্দ্রে সহিহ কুরআন শিক্ষা প্রদান করা হয়।

তার প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে তা’লিমুল কুরআন বাংলাদেশ গতবছর রমজানে দেশ-বিদেশে প্রায় ষোলশত শাখা কেন্দ্রের মাধ্যমে তিন লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী এবং প্রায় বিশহাজার বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদেরকে সহীহ কুরআন শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়। গেছে রমজানে আঞ্জুমান হতে প্রায় দুই হাজার (পুরুষ ও মহিলা) ইলমুল ক্বিরাআতের সনদ লাভ করে। তার এ খেদমত সকল মহলে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে। একই কারণে তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত। অন্যদিকে তিনি একজন হক্কানী পীর, আলিম, ওয়ায়েজ ও গ্রন্থপ্রণেতা হিসেবে খুব পরিচিত।

শাইখে কুররা ভানুগাছী রাহ.কে নিয়ে স্মৃতি চারণমূলক সাক্ষাৎকারের কাজ দীর্ঘদিন যাবৎ করছি। হজরতের ঘনিষ্ঠজন, সহকর্মী, ছাত্র ও পরিবারের প্রায় কয়েকজনের স্মৃতিকথা সংগ্রহ করেছি, সর্বশেষ শাইখে ভানুগাছীর বড় সাহেবজাদা মাওলানা কারী ইমদাদুল হক কথায় তুলে ধরলেন শাইখে কুররা ভানুগাছী রহ. এর জীবন সৌন্দর্য। উঠে এলো শিক্ষণীয় অনেক কথা। পাঠকের জন্য থাকলো আলোচনার চুম্বক অংশ। সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও গ্রন্থনা আওয়ার ইসলামের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রফিকুল ইসলাম জসিম


আওয়ার ইসলাম: শাইখুল কুররা রহ. এর জীবনের সূচনাকালের কথা জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

মাওলানা কারী ইমদাদুল হক:  জন্ম: শাইখুল কুররা রহ. ১৯৪৬ সালের ৫ জুন চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ থানার অন্তর্গত বাখরপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে পিতা-মাতা মৌলভীবাজার জেলাধীন কমলগঞ্জ থানার ভানুগাছ সরইবাড়ি গ্রামে হিজরত করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

শিক্ষা: তিনি তার জন্মস্থানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে সরইবাড়ি মক্তবে আরবি ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৬০ সালে বিবাড়ীয়া জেলার কসবা থানার ধজনগর গ্রামের ইসলামিয়া মাদরাসা থেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করেন।

১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হবিগঞ্জ জেলার মিরপুর জামিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসায় অত্যন্ত সুনামরে সাথে আলিয়া চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৬৯ সালে ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুর সিলেটে ভর্তি হয়ে ১৯৭১ সালে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস [মাস্টার্স] পাশ করেন।

তিনি কয়েকজন বিখ্যাত কারী সাহেবগণের নিকট ইলমুল ক্বিরাআতের উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ ও সনদ লাভ করেন। তন্মধ্যে ১৯৬৪ সালে দেশের স্বনামধন্য কারী হযরত মাওলানা ইব্রাহীম রাহ. চাঁদপুরীর নিকট পূর্ণাঙ্গ ‘ক্বিরাআতে হাফস’ এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে দারুল উলুম দেওবন্দের ক্বিরাআত বিভাগীয় প্রধান আল্লামা আবুল হাসান আযমীর কাছ থেকে ক্বিরাআতে ‘সাবআ আশারার’ বিশেষ সনদ লাভ করেন।

আওয়ার ইসলাম: শায়খুল কুররা ভানুগাছী রহ. জীবনের শেষ পর্যন্ত কুরআনের খেদমত করেছেন, তার উল্লেখযোগ্য কিছু খেদমতের কথা বলেন, যেগুলো বাংলাদেশের মানুষ এখনো গ্রহণ করছে...

মাওলানা কারী ইমদাদুল হক: শায়খুল কুররা বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনার কাজ অত্যন্ত দক্ষতার
সাথে আঞ্জাম দিয়ে যান। তন্মধ্যে উলে­খযোগ্য কয়েকটি হলো: প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সভাপতি : আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশ। মহাপরিচালক: আদর্শ ফুরক্বানিয়া মক্তব এসোসিয়েশন বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম : জামিয়া তা’লীমুল কুরআন গোটাটিকর সিলেট। প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম: সরইবাড়ি ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার। প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম: জামিয়া তাজবীদুল কুরআন, ভানুগাছ, মৌলভীবাজার।

মুহতামিম: হাফিজিয়া মাদরাসা, টেবলাইবাজার, দোয়ারা, সুনামগঞ্জ। প্রধান উপদেষ্ঠা: আঞ্জুমানে জাকেরীন বাংলাদেশ। [আধ্যাত্মিক সংগঠন]। সাবেক সভাপতি : আশরাফুল মাদারিস, ফেনিবিল, সুনামগঞ্জ। সাবেক পরীক্ষক [ইলমুল ক্বিরাআত] : বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ। সদস্য, শুরা ও আমেলা: তানযীমুল মাদারিস মৌলভীবাজার। সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগাঠনিক সম্পাদক : হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সাবেক সভাপত : জাতীয় ইমাম সমিতি কমলগঞ্জ থানা শাখা, মৌলভীবাজার।

আওয়ার ইসলাম: শায়খুল কুবরা শায়খে ভানুগাছী রহ. প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশ সৃষ্টির নেপথ্যে কাহিনি জানতে চাই?

মাওলানা কারী ইমদাদুল হক: আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা: শাইখে ভানুগাছী রাহ. ছাত্র অবস্থায়ই ইলমুল ক্বিরাআতের প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। মুসলিম উম্মাহ’র অশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত দেখে তাঁর মনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। মানুষকে কিভাবে সহিহ কুরআনের তা’লীম দেয়া যায় সেই ফিকিরে তিনি রাত দিন ব্যস্ত হয়ে পরেন। একদিন বালাগঞ্জ জামে মসজিদে তাঁর উস্তাদ আল্লামা নূর উদ্দীন আহমদ গহরপুরী রাহ.’র নিকট গিয়ে অশ্রু সজল নয়নে অত্যন্ত মিনতির সুরে বললেন, হুজুর! আপনারা দুনিয়ায় থাকতে আমরা মাহরুম হতে চলছি।

প্রয়োজন কেবল আপনার ইজাযত আর দু‘আ। আমি আগামী রমজান থেকে আল্লাহর এই জমিনে কেউ স্থান না দিলে প্রয়োজনে যে কোনো গাছ তলায় কুরআনের সহিহ তা’লীম শুরু করতে চাই। হুজুর বললেন, যাও! কাজ শুরু কর। (সুবহানাল্লাহ) তিনি (আলী আকবর) অনেক আগে থেকেই কিছু একটা করবেন তা তাঁর মনের মাঝে পোষে রাখেন। দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে একটি সুন্দর পথ খুঁজছিলেন।

আর সে সুবাধে একটি কাগজে লিখে রেখেছিলেন ‘আঞ্জুমানে তা’লীমুল কুরআন বাংলাদেশ’। আজ তা বাস্তবায়িত হয়েছে। গহরপুরী হুজুরকে বললেন- হুজুর! কাজ শুরু করবো ঠিকই তবে আপনাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চাই। আবদারের সাথে সাথে গহরপুরী হুজুরের দিকে বাড়িয়ে দিলেন কাগজ-কলম। হুজুর আনন্দচিত্তে তাতে স্বাক্ষর করে নিলেন। গহরপুরী হুজুরের ইজাযত পেয়ে সেদিন থেকে শুরু হয় আঞ্জুমানের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। সেদিন ছিলো ১৪০২ হিজরির ৫ জুমাদাল উলা, ২৬ ফাল্গুন ১৩৮৮ বাংলা, ১০ মার্চ ১৯৮২ ইংরেজি। একে একে দেশ বরেণ্য উলামা, মাশাইখ ও সুধী মহলের সুপরামর্শে হাটি হাটি পা পা করে আঞ্জুমান আজ সফলতার এ প্রান্তে। শাইখে ভানুাগছীর স্বপ্ন ছিলো আঞ্জুমানের মূল ভবনের দু’তলা পর্যন্ত দেখে ইন্তেকাল করা। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তাঁর মকবুল স্বপ্নকে কবুলও করেছেন।

আওয়ার ইসলাম: শায়খুল কুররা ভানুগাছী রহ.-এর কর্মজীবন কথা ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

মাওলানা কারী ইমদাদুল হক: কর্মজীবন: পড়াশুনার পর নিজ এলাকায় কমলগঞ্জে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সরইবাড়ী ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা। পরবর্তিতে মৌলভীবাজার সদর থানার ভাদগাঁও ইমদাদুল উলুম মাদরাসার শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বালাগঞ্জ ফিরোজাবাগ মাদরাসার শিক্ষা সচিব ও জামে মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। মৌলভীবাজার সদর থানার দামিয়া বাজার জামে মসজিদেও কিছুদিন ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তার প্রতিষ্ঠিত সিলেট নগরীর গোটাটিকরস্থ জামিয়া তা’লিমুল কুরআন মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব অত্যন্ত দতা ও নিষ্টার সাথে পালন করছেন।

বৈবাহিক জীবন: ১৯৭৫ সালে হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার অন্তর্গত যশমঙ্গল (মুন্সিবাড়ী) নিবাসী মরহুম ওয়াছিল আলী চৌধূরীর ৪র্থ কন্যা শামসুন নাহার চৌঁধূরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি চার ছেলে ও চার মেয়ে রেখে মৃত্যুবরণ করেন ।

আওয়ার ইসলাম: শুনা যায়, শায়খুল কুবরা ভানুগাছী রহ. তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ ও বিভিন্ন দেশভ্রমণ করছেন? এ বিষয়ে কিছু বলুন।

মাওলানা কারী ইমদাদুল হক: লেখালেখি: ইলমুল ক্বিরাআত বিষয়ের উপর ‘তা’লীমুস সিবইয়ান’, ‘তা’লীমুল ক্বিরাআত’, ‘তাজবীদুল কুরআন’সহ বিভিন্ন কিতাব রচনা করেন। এছাড়াও তাঁর সম্পাদিত ‘জামালুল কুরআন’, ‘হাদইয়াতুল ওয়াহিদ’, ‘ফাওয়াইদে মাক্কিয়্যাহ’ এবং ইলমে তাসাউফের উপর প্রণীত ‘মুনাজাতে মাকবুল’ (একটি শাজারাহ) নামীয় পুস্তক প্রকাশ হয়। এছাড়াও বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও দারস বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একসময়ে তরুণ সাংবাদিক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি মাসিক হেফাজতে ইসলামের স্টাফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এবং আঞ্জুমানের মুখপত্র ত্রৈমাসিক দা’ওয়াতুল কুরআন’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন।

দেশভ্রমণ: পবিত্র হজ পালনের লক্ষে তিনি একাধিকবার পবিত্র মক্কা নগরীতে গমণ করেন। ওয়াজ নসিহত ও আঞ্জুমানের সাংগঠনিক কর্মসূচি পালনের নিমিত্তে একাধিকবার ইংল্যান্ড, ভারত এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে দুবাই ও কাতার সফর করেন।

শায়খুল কুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক ভানুগাছী রাহ. ৮ মার্চ ২০১৬, মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ছ’টায় মওলার ডাকে সাড়া দিয়ে এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
সিলেট গোটাটিকর আঞ্জুমান কমপ্লেক্সে সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষের সমাগমে সালাতুল জানাযার ইমামতি করেন শাইখে ভানুগাছীর বড় সাহেবজাদা মাওলানা কারী ইমদাদুল হক।

পরে মরহুমের লাশ তাঁর প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান কমপ্লেক্সে, ষাটঘর, গোটাটিকর (দক্ষিণ সুরমা), সিলেটে নির্ধারিত স্থানে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ কুরআনের এই খাদেমকে তাঁর রহমতের চাদরে ঢেকে রাখুন। জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমীন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ