তৈয়ব উল্লাহ নাসিম।।
সৌদি আরব থেকে>
বিপদ ও বিপর্যয়কালীন সময়ে শুধু বন্ধুর পরিচয় হয় এমন নয়, বরং স্বজনদেরও পরিচয় হয়, নিজের প্রতিবেশী ও সমাজেরও আসল পরিচয় মেলে ঠিক এমন সময়ে। কে স্বার্থপরতার মুখোশ পরে থাকা আপনজন আর কে আন্তরিক ও মানবিক বন্ধু এবং প্রতিবেশী, এমন সময়ে ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যায়। সারা বিশ্ব আজ একটি অজানা অচেনা নতুন ভাইরাস কোভিড ১৯ এর প্রভাবে বিপর্যস্ত।
একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে এসে এর থাবা পড়েছে। কারণ পুরো বিশ্বটাই আজ প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে গ্লোবাল ভিলেজ এর আওতায় এসে ছোট্ট এক ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক এই পরিবর্তনে পৃথিবীর এক প্রান্তে কিছু ঘটলে বা আক্রান্ত হলে তার শেষ প্রান্তেও কিছু না কিছু প্রভাব পড়েই।
আমাদের দেশটাকে বর্তমানে মধ্য আয়ের এর দেশ দাবি করা হলেও আদতে কিন্তু একটা গরিব দেশই। সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলো সাধারণত দিন এনে দিন খায়। তারা একদিন যদি কাজে না যেতে পারে ঐদিন তাদের এক রকম না খেয়েই থাকতে হয়। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে যখন করোনার মহামারী থেকে বাঁচতে লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তখন এই খেটে খাওয়া শ্রেণীর কাজকর্ম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেলো। কাজ বন্ধ মানে তাদের কামাই বন্ধ, কার কামাই বন্ধ মানে তাদের খাবারের ব্যবস্থা নেই।
সরকার শুরু থেকেই কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা করেছে ঠিক, কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও এক শ্রেণীর মানুষের লুটপাট বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই নিত্যসঙ্গী। এমন অবস্থায় কেউ ত্রাণ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না। কেউ কয়েকবার পাচ্ছে দলীয় পরিচয়ে অথবা নেতাগোছের কারো সাথে জানাশোনার কারণে, আবার কেউ একেবারে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঠিক এমন এক কঠিন মুহূর্তে এসব গরিব অসহায় মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জাতির দুঃসময়ের বন্ধু, কওমির সূর্য সন্তানরা। কওমি মাদ্রাসার সাথে যারা যুক্ত তারা যে খুব বড়লোক কিংবা পয়সাওয়ালা এমন কিন্তু না। যারা কওমিতে শিক্ষকতা করেন বা চাকুরি করেন তাদের বেতন সাধারণত পাঁচ থেকে খুব বেশি আট দশ হাজারের মধ্যে। এবং এ বেতন ও বেশ কয়েক মাস বাকি থেকে যায়।তা সত্ত্বেও এদের রয়েছে বড় একটা মন ও বিশাল এক হৃদয়। এরা নিজেদের এই সীমিত আয় থেকে সবাই মিলে সংগঠিত হয়ে কালেকশন করে, সাথে সমাজের অন্যান্য শ্রেণিকেও যুক্ত করে দেশের সর্বত্র সব এলাকায় নেমে পড়েছে গরীব অসহায় মানুষদের ত্রাণ সাহায্য দিতে, তাদের পাশে দাঁড়াতে।
এযেন ঠিক অভাবগ্রস্ত থেকেও নিজে না খেয়ে নিজের আহারে অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার মতো।
আল্লাহ তাআলা ঠিক এমন মানুষগুলোর কথাই কুরআনে কারীমে উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রশংসা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, "মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।" (সূরা হাশর-৯)
প্রত্যেকটি থানা ইউনিয়ন ওয়ার্ড গ্রামে কওমির এই সূর্য সন্তানেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নেমে পড়েছে অসহায় গরীব মানুষগুলোর সহযোগিতায়। পথের পর পথ তারা পাড়ি দিচ্ছে কোন ক্লান্তি ছাড়া। চাল-ডালের বস্তা নিজেদের মাথায় নিয়ে পৌছে দিচ্ছে মুখাপেক্ষীদের ঘরে ঘরে। অতি সম্মানের সাথে ত্রাণ তুলে দিচ্ছে অভাবগ্রস্তদের হাতে। খুব খেয়াল রাখছে যাতে ত্রাণ গ্রহীতার কোন রকমের অসম্মান কিংবা সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন না হয়।
অথচ ভিন্ন দিকে যারা সরকারি বা রাজনৈতিক ত্রাণ দিচ্ছেন, একরকম তামাশায় পরিণত হচ্ছে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম। কারণ এক পট চাল দিতে গিয়ে দশ-পনেরোটা দাতার হাত আর একজন অসহায় মানুষকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে ওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া হচ্ছে। এমনো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, ছবি তোলা শেষে ত্রাণের থলেটা কেড়ে নেয়া হচ্ছে অসহায় গ্রহীতার কাছ থেকে! অথচ কওমির স্বেচ্ছাসেবক ভাইয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন ধরনের ছবি কিংবা ভিডিও করছেন না। কিছু কিছু অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য, বা বাম পাড়ার যাদের চোখে কওমির ভালো কিছু কখনো ধরা পড়ে না তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য নেয়া হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মুখাপেক্ষীদের অজান্তেই তাদের বাসার সামনে রেখে আসা হচ্ছে ত্রাণ।
একটা ব্যাপার আমাকে খুব হতাশ করেছে, তা হল অল্প সামান্য বেতন থেকেও কওমী সন্তানেরা যেই উদারতা দেখিয়েছে সেই তুলনায় আলিয়া বা সরকারি মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্ত ভাইদের সেরকম কোন তৎপরতা একেবারেই চোখে পড়ছে না। কাউকে ছোট করার জন্য আমি একথা বলছি না। এসব মুহূর্তে সর্বস্তরের সবার এগিয়ে আসা উচিত অসহায়দের সহযোগিতায়।
সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে করোনা আক্রান্ত রোগীর জানাজা ও কাফন দাফনের বেলায়। কারণ রোগীর স্বজনরা ভয়ে অনেকে কাফন দাফন দূরে থাক কাছে আসতে চাইছে না। কেউ কেউ লাশ গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। যদিও সরকার রোগতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পরামর্শে প্রত্যেক লাশের সাথে তিনজনের একটি টিম পাঠিয়ে লাশ দাফনের ব্যবস্থার কথা বলেছে। কিন্তু কাগজে কলমে সেটাও সার্বিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কোথাও এ টিমের সদস্যরা যাচ্ছে আবার কোথাও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন এক কঠিন মুহূর্তে জাতির সূর্যসন্তান কওমি যুবারা এগিয়ে এসেছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত লাশগুলো কাফন দাফন দেয়ার জন্য। গত পাঁচই এপ্রিল দাউদকান্দিতে এমনই এক করোনা রোগীর লাশ দাফন হয়েছে কওমি যুবাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। সারা দেশে এই ঘটনা প্রশংসিত হয়েছে এবং বেশ সাড়া জাগিয়েছে। দেশের সব জায়গায় কওমি যুবাদের লাশ কাফন দাফন দেয়ার জন্য কমিটি গঠন হচ্ছে, অনেক জায়গায় হয়েও গেছে।
কওমি সন্তানদের একটাই কথা, তারা কোনো লাশের অসন্মান হতে দেবে না। স্বজনরা এগিয়ে আসুক কিংবা না আসুক, কওমি যুবারা সসম্মানে এইসকল লাশকে জানাজা এবং কাফন দাফনের ব্যবস্থা করবে। স্যালুট হে কওমির সূর্য সন্তানেরা, স্যালুট তোমাদের হে কওমির বীর যুবারা। জাতি তোমাদের এই অবদান ভুলতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে কবুল করুন, এই মহামারী থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করুন।
-এটি