মাওলানা খালেদুজ্জামান
বর্তমান দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। গতকাল ও আজকের রিপোর্ট দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে খুব খারাব পরিণতির দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। মহামারীর এই চরম সংকটময় মুহূর্তে মসজিদে জামাতে নামায আদায় করা প্রসঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ মুসলিম স্কলার ও ফুকাহায়ে কেরাম ভিন্ন ও বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
হারামাইন শরিফাইন, কুয়েত-কাতার, ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম বিশেষত আল্লামা মুফতী রফী উসমানী, মুফতি তাকি উসমানী, দেওবন্দ মাদরাসার মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানী, মাওলানা ইলিয়াস ঘুম্মান, আল্লামা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানীসহ প্রমুখ শীর্ষ উলামায়ে কেরাম মসজিদে, চার-পাঁচজন লোক নিয়ে খুব সীমিত পরিসরে জামাত চালু রাখার বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন৷
সাম্প্রতিক কিছুদিন আগে মুফতী তাকি উসমানী দা. বা. এর নেত্বত্বে পাকিস্তানের সকল মতাদর্শের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম সম্মিলিতভাবে এ বিষয়ে একটি অত্যন্ত বাস্তবমুখী কালজয়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আলেমগণের এ পরামর্শ না মানায় ৩৪ জন ইমামকে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
দুঃখজনক হলেও আলেমদের সিদ্ধান্ত না মেনে তাবলীগি এজতেমা করায় মালয়েশিয়ায় প্রথম সেখান থেকেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যায় যা সামাল দিতে দেশটি গলদঘর্ম হচ্ছে। পাকিস্তানে রাইবেন্ড এজতেমা থেকে সমস্যা দেখা দিয়েছে, সিন্ধুতে তাবলীগি জামাতকে গণপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। বর্তমান ভারতের নিজামউদ্দিন মারকাজ পুলিশের নিয়ন্ত্রণে।
বর্তমানে আপদকালীন সময়ে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে কাতার সরকার এ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে যে, কাতারে জামাতে নামাজ পড়লে তিন বছরের জেল দেয়া হবে। পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে হবে। অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করি না হয়ে বিজ্ঞ আলেমদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলাই হবে অধিক নিরাপদ। আজ বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে অগ্রসর হওয়ার কারণে মসজিদে ইমাম সহ সর্বোচ্চ পাঁচজন আর জুমার সময় দশ নিয়ে জামাত করার নির্দেশ জারি করেছে।
শুধু আবেগের বশবর্তী না হয়ে বিবেকের সমন্বয়ে শরীয়তের বিধান মানতে হবে। এই মুহূর্তে মসজিদে বড় জামাত, জুমা, শবেবরাত, তাবলীগী জামাত, দোয়া মাহফিল ও লোকসমাগম এড়িয়ে চলাই ইসলামের নির্দেশ। এ সংক্রান্ত বহু আয়াত ও হাদিস আলেমগণের নির্দেশিকায় উল্লেখ করা আছে। আমরা কেবল ইতিহাস থেকে কিছু বাস্তবতা ও সাহাবায়ে কেরামের কিছু নির্দেশনা পেশ করছি।
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. মহামারি সম্পর্কে তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘বাজলুল মাঊন ফি ফাদ্বলিত তাউন’ এ দুটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। দামেশকে একবার মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ভাইরাস থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য দোয়ার উদ্দেশ্যে হাজারো মানুষ সমবেত হয়েছিল। ফলাফল হলো, আগে প্রতিদিন ৫০ জন করে মারা যেত আর দোয়া মাহফিলের পর হাজার মানুষ মারা যেতে লাগল।
অনুরূপ, কায়রোতে ৮৩৩ হি সনে ব্যাপক মহামারি সৃষ্টি হয়েছিল। সকলে তিন দিন রোযা রেখে মরুভূমিতে গিয়ে দোয়া করল। জমায়েতের ফল হল হিতে বিপরীত। মৃত্যুর সংখ্যা এক লাফে বেড়ে গেল দৈনিক হাজারে। দোয়া মাহফিল নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। কিন্তু মহামারির সময় ঘরে অবস্থান করা ইসলামের নির্দেশ।
এ কারণে ভয়াবহ আমওয়াস মহামারির সময় আমর বিন আস রা. বললেন, হে লোকসকল, এ মহামারি হল আগুনের মত। যখন আসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই তোমরা পাহাড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়। তখন সকলে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে অল্প দিনের মধ্যেই ভালো ফলাফল দেখা যায়। ভাইরাস দূর্বল হয়ে পড়ে। মহামারী শেষ হয়ে যায়। পরিবর্তিতে হযরত উমর রাযি আমর ইবনে আস রাযি. এর এই কৌশল গ্রহণের কথা শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সুতরাং আমাদের প্রত্যেককে এখন ইসলামের নির্দেশনা মেনে ঘরমুখী হতে হবে এবং ঘরকেই মসজিদে রূপান্তরিত করতে হবে। দুনিয়ার সব বিজ্ঞ ও সচেতন মুফতি এবং আলেমগণের নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকুন। এমনকি জুমা ও শবেবরাতে মসজিদে না যেয়ে ঘরে ইবাদত করুন, গনজামায়েত হয় এমন সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা জরুরি।
“এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি উট বেঁধে রেখে আল্লাহর উপর ভরসা করব, না বন্ধনমুক্ত রেখে? রাসূল সা. বললেন, আগে উট বেঁধে নাও, অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা কর।” (তিরমিযী হা/২৫১৭)।
বেশি আবেগ না দেখিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নেয়াই মুসলিমদের সেরা সিদ্ধান্ত হবে। যেখানে হাদিসে সুযোগ দেওয়া আছে সেখানে বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। আল্লাহ আমাদের সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত মেনে চলার তাওফিক দান করুক।
লেখক, মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া-ঢাকা। বিভাগীয় সম্পাদক, মাসিক মদিনা।
-এটি