২০১৫ সাল থেকে সৃষ্টির সেবায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে হাফেজ্জী হুজুর রহ. সেবা সংস্থা। মানবতার ডাকে দেশের নানা প্রান্তে ছুটে গিয়েছে সংস্থাটি। রোহিঙ্গা মুহাজির, শীতার্থ আর বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের এই কঠিন মুহূর্তেও খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে হাফেজ্জী হুজুর সেবা সংস্থঅ। সংস্থাটির পরিচালক মাওলানা রজীবুল হকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের ডেপুটি এডিটর আবদুল্লাহ তামিম।
আওয়ার ইসলাম: বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব একটি কঠিন সময় পার করছে। মানবতা ও দেশের কল্যাণে এই কঠিন পরিস্থিতিতে আলেমদের কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিদ বলে মনে করেন?
মাওলানা রজীবুল হক: সর্বপ্রথম বিষয় হচ্ছে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের বিষয়ে উলামায়ে কেরামের ভূমিকা থাকবে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা। মোকাবেলা জাতীয় শব্দ পরিহার করা। জনসাধারণ মোকাবেলা শব্দ ব্যবহার করছে না বোঝে। উলামায়ে কেরাম সেটা বোঝেন। আল্লাহ তায়ালা যে গজব বা পরীক্ষা পাঠিয়েছেন এর মোকাবেলা কখনও সম্ভব নয় এ বিষয়টা মানুষকে বোঝাতে হবে।
আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে কোনো বিষয়ে কখনও মোকাবেলা হয় না। এজন্য আলেমরা নিজেরাও মোকাবেলা জাতীয় শব্দ পরিহার করবেন এবং অন্যকেও এই জাতীয় শব্দ পরিহার করতে বলবেন।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে আলেমরা ওয়ারিসে নবী বা নবীর উত্তরাধিকারি। সেজন্য রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত পথে তারা চলবেন এবং উম্মতকে সে পথে চালানোর জন্য চেষ্টা করবেন। সুতরাং এই কঠিন মুহূর্তে আলেমদের সর্বপ্রথম মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। কারণ রাসুল সা. সবচেয়ে বড় মানবতার সেবাকারী ছিলেন।
আজ থেকে ১০ বছর আগে আমাদের একজন বুজুর্গ মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী একটি মজলিসে একটা ঘটনা বলেছিলেন, এই ঘটনাটা আমার খুব বেশি মনে পড়ে। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যাবেন। তখন দেখলেন তার চাদরের এক কোণে একটা বিড়াল ঘুমিয়ে আছে।
রাসুল সা. সাহাবায়ে কেরামকে বললেন একটা কেচি নিয়ে এসো। কেচি আনা হলো। চাদরের যে কোণে বিড়ালটা ঘুমিয়ে ছিল রাসুল সা. চাদরের সে কোণাটা কেটে নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেলেন। তারপরও তিনি ঘুম থেকে বিড়ালটাকে জাগাননি। সুবহানাল্লাহ। এ ঘটনাটা আমার খুব বেশি মনে পড়ে, আমি এখনও ভুলতে পারিনি। তাই আলেমদের উচিত এ কঠিন সময়ে মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে মানবতার সেবায় জনগণের জন্য বিলিয়ে দেয়া।
মোটকথা, এ কঠিন পরিস্থিতে যতটুকু সম্ভব জনগণকে সতর্ক করা সেই সঙ্গে বিশ্বাস যেন ঠিক থাকে সেই বিষয়টার প্রতি লক্ষ্য রাখা। আল্লাহ তায়ালা চাইলে এ ভাইরাসে আক্রান্ত করতে পারবেন। আল্লাহ্ না চাইলে আমাকে এটা আক্রান্ত করতে পারবে না। আমি সবধরনের সতর্কতা অবলম্বনের পরেও আমাকে এই ভাইরাস আক্রমণ করতে পারবে যদি আল্লাহ চান- এ বিশ্বাস মনে মনে রাখা।
আওয়ার ইসলাম: ঢাকাবাসীর বিভিন্ন দুর্যোগে আপনাকে তাদের পাশে দেখা গেছে। মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। করোনার এ কঠিন পরিস্থিতিতে আপনি ঢাকায় কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন?
মাওলানা রজীবুল হক: আসলে আমি বড় ধরনের একটা এক্সিডেন্ট করেছি কিছুদিন আগে। টেকনাফ থেকে ফিরছিলাম। আমি ড্রাইভ করছিলাম। আমার পাশে যে ছিল সে মারা গেছে এ কঠিন এক্সিডেন্টে। বাকি চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সবাই হাসপাতালে আছে। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে এ কারণে। আমি ভাবিনি এবার জনসাধারনের পাশে দাঁড়াতে পারবো। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে এবারেও এ করোনার মতো কঠিন মুহূর্তে আমরা জনসাধারণ অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছি। নেক কাজ করার জন্যই হয়তো আল্লাহ তায়ালা বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমরা এ কঠিন মুহূর্তে করণীয় নিয়ে গত ২৫ মার্চ আমাদের কার্যালয়ে আলোচনায় বসি। ২৮ মার্চ আমরা বড় পরিসরে সহায়তা করি।
আমরা আমাদের কাজগুলো ভিন্ন ধারায় করে থাকি। আমরা যারা মানবতার সেবায় কাজ করি, আমাদের সবার উচিত এ নিয়ম অনুসরণ করা। এতে অনেক ফায়দা হয়। আমাদের কাজের ধরণ হলো আমরা যে এলাকায় সহায়তা দিই, যাদেরকে সহায়তা দিই তাদের জমায়েত করি। মসজিদে বা ভিন্ন কোনো জায়গায়, প্রথমে বড় বড় আলেমদের দিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করি। কালেমা শুদ্ধ করে পড়ানোসহ ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়ার পর নামাজ আদায় করি। দোয়া করে তাদের সহায়তা দেয়া হয়। অন্য কোনো সেবা সংস্থা এটা করে কি না আমার জানা নাই। কিন্তু এটা করা উচিত। তাদের পেটের খোরাকের সঙ্গে সঙ্গে আত্মার খোরাক দেয়ার চেষ্টা করি।
আওয়ার ইসলাম: ঢাকায় আপনার নেতৃত্বে পরিচালিত উল্লেখযোগ্য মানবসেবাগুলো যদি বলতেন।
মাওলানা রজীবুল হক: আমরা সাধারণত ঢাকার বাইরেই বেশি কাজ করি। বছরের সবসময়ই ধারাবাহিকভাবে আমরা কাজ করি। করোনার এ কঠিন মুহূর্ত হোক আর শীত হোক আমরা বছরের সবসময় একাধারে কাজ করে যাই।
হাফেজ্জী হুজুর রহ. সেবা সংস্থা আলহামদুলিল্লাহ ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে মুহাজির ক্যাম্পে কাজ শুরু করে। আমরা তাদের রোহিঙ্গা বলি না। আমরা মুহাজির বলি।
আমরা তখন থেকেই তাদের ধারাবাহিকভাবে সহায়তা দিয়ে আসছি, এ বছরও আলহামদুলিল্লাহ ২২টি গরু ও ২৩টি ছাগল সহায়তা দিয়েছি। তিনটি খতনা প্রোগ্রাম করেছি। আমাদের সহায়তা ধারাবাহিক চলতে থাকে। মুহাজিররা যখন আসছেন তখন অনেক সংস্থা আলেম গায়রে আলেম সেখানে সহায়তা করতে গিয়েছেন। এখন আর কাউকে চোখে পড়ে না। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আমরা সেখানে সহায়তার অনুমতি নিয়েছি অনেক কষ্ট করে। আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে সেখানে সহায়তা দিয়ে আসছি।
এছাড়াও আমরা শীতের আড়াই মাসে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আমরা প্রতি শুক্রবার শীত বস্ত্র বিতরণ করেছি। এছাড়াও ইজতেমায় আমাদের মেডিকেল টিম ছিলা। সবচেয়ে বড় মেডিকেল টিম। ডাক্তার ছিল প্রায় ১৭ জন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যায় সহায়তা দিয়েছি।
এছাড়াও আমরা পত্রিকা ছাপি সৃষ্টির সেবা। মানবতার কল্যাণে। এটা দেশের প্রত্যেকটি জেলায় এ পত্রিকা যায়। সামনে রমজান মাস আসছে, প্রত্যেক দিন আমরা ইফতাসামগ্রী বিতরণ করে থাকি। হজের মৌসুমে হাজিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ফিরে আসলে তাদের নিয়ে আমভাবে দোয়ার ব্যবস্থা করা। হজ বিষয়ক পত্রিকা বের করা। নানান বিষয়ে সারা বছর আমাদের সহায়তা চলতে থাকে। আমরা চাই এ সহায়তা ধারাবাহিকভাবে চালু রাখতে।
আওয়ার ইসলাম: আমরা জানি আপনারা শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্যই এসব সেবামূলক কাজ করে থাকেন। আপনাদের এ কাজগুলো মিডিয়ায় প্রচার হয় না। এর কারণ আপনি কী বলে মনে করেন? প্রচার হওয়া প্রয়োজন বলেও কী মনে করেন?
মাওলানা রজীবুল হক: প্রচার প্রচারণা এটা জরুরি তখন, যখন নিয়ত ঠিক থাকবে। নিয়তে যদি সমস্যা থাকে তাহলে প্রচার না করাই ভালো। নিয়ত ঠিক থাকলে অন্যকে উৎসাহ তে প্রচার করা যেতে পারে।
আওয়ার ইসলাম: মানব কল্যাণমূলক এ কাজে আপনি কাদের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করবেন, আপনার প্রেরণা কাকে বলে মনে করেন।
মাওলানা রজীবুল হক: আলেমদের এই মানবসেবায় বেশি বেশি আসা উচিত। যদি এখন আমাদের দেখাদেখি অনেক আলেম এগিয়ে আসছেন। এটা অনেক খুশির বিষয়। আমি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা পেয়েছি জামিয়া রাহমানিয়ার আরাবিয়া সাত মসজিদ মোহাম্মদপুর মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস, শতাধিক গ্রন্থপ্রণেতা, মাওলানা নোমান রহ.-এর।
তিনি আমাকে এ পরিমাণ উৎসাহ দিয়েছেন, যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এরপর যাকে স্মরণ করবো তিনি হলেন, কুরআনের পাখি যাকে বলা হয়, মাওলানা আতিকুল্লাহ, তিনি কারাগারে আছেন। মুহাজিরদের বিষয়ে আমাদেরকে অনেক অর্থ ব্যবস্থা হয়েছে তার মাধ্যমে। আমি তাদেরকে আমার কাজের প্রেরণা হিসেবে পাই।
আওয়ার ইসলাম: ঢাকা ও ঢাকার জনমানুষের সেবা করতে গিয়ে অসহায়দের যে চিত্র দেখেছেন একটু যদি বলতেন।
মাওলানা রজীবুল হক: আসলে আমরা বলতে পারি, কিন্তু আসল চিত্র দেখলে, মানুষের অসহাত্বের চিত্র চোখে দেখলে কোনো মানুষ ঠিক থাকতে পারবে না। মানুষ খুব কষ্টে জীবন যাপন করে।
আমরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে চেষ্টা করবো। তাহলে অসহায় মানুষদের মুখে হাসি ফুটবে। আমরা যারা এ লাইনে কাজ করি, আমাদের দরকার একে অপরের সহযোগী হওয়া, প্রতিপক্ষ না হওয়া। আর একে অপরের কাজে সহযোগিতা করা। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের কাজগুলোকে কবুল করুন।
-এটি