রফিকুল ইসলাম জসিম।।
আজ ২৬ মার্চ। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন। স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রম করছি আমরা। আর মাত্র একটি বছর। আগামী বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছর পূর্ণ করবে। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সে যুদ্ধে চা-শ্রমিকদের অবদানও কম নয়। অনেক চা-শ্রমিক অংশ গ্রহণ করেছিলেন যোদ্ধে। সম্মুখ যোদ্ধে অংশ নিয়ে অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার আকঙ্ক্ষা ছিল এদেশে বাঙালি সহ বিভিন্ন জনজাতির সকলের নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা। মুক্তিযোদ্ধারা স্বপ্ন দেখেছিল শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি মানবিক সমাজের। তাদের দেখা সেই স্বপ্নের সমাজে স্থান পায়নি অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, ১৯৭১ সালের মৃক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ চা শ্রমিকের প্রাণ সময়ের স্রোতে উৎসর্গীত হয়েছে। আজকের এই প্রতিবেদন: স্বাধীনতার ৪৯ বছর: কেমন আছে এ দেশের চা শ্রমিকরা!
স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিক্রম পর বঞ্চিত চা শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবনের কাহিনী। সবুজে ঘেরা চা বাগানের উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা টিলায় বেষ্টিত অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ চায়ের বাগানে পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৯০ শতাংশ শ্রমিকই হচ্ছেন নারী। প্রায় প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়ো করে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে ছোট ছোট সন্তানদের রেখে বা সঙ্গে নিয়ে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগানে।
এক চিমটে লবণ চা দিয়েই সকালের যাত্রা শুরু হয় তাদের। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না। তারা কলম কাটা, প্রোনিং বা চারাগাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কারও করে থাকেন। বিপরীতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অমানবিক ও হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে ২৩ কেজি পাতি উত্তোলনের বিনিময়ে মাত্র ১০২ টাকা পেয়ে থাকেন। আর দুপুরের খাবারে নারী শ্রমিকরা পাতি ছানা (চা পাতার ভর্তা) সঙ্গে পেঁয়াজ ও মরিচ দিয়ে রুটি অথবা ভাত খেয়ে থাকেন। এসব খাবার খেয়েই তাদের জীবন চলে। যে জন্য পুষ্টিহীনতা তাদের নিত্যসঙ্গী।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত রাখতে মৌলভীবাজারে চা-বাগান কর্তৃপক্ষকে চা-শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক বিজ্ঞপ্তিতে চা-বাগানে সব বহিরাগতের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চা-বাগানের পাট্টাগুলো (দেশি মদ তৈরির কারখানা) পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
দেশের ১৬৩টি চা-বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় আছে ৯২টি। চা-শ্রমিকেরা চা-বাগানে কাজ করার সময় কিছুটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও দুপুরের খাবার, উত্তোলন করা চা-পাতা জমা দেওয়ার সময় দলবদ্ধ ও অনেকটা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অবস্থান করেন। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
চা বাগানের শ্রমিকের বড় অংশই নারী। সবাই হাড্ডিসার। খাটুনি খেটে সংসার চালালেও পুষ্টির অভাব সবার। এসব সংসারের পুরুষরা খুবই অলস হাড়িয়া পান করে নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমায়। সরেজমিন দেখা যায়, চা বাগানগুলোতেও নারী শ্রমিক বা তাদের পরিবারের জন্য থাকে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। সেখানে প্রায় শ্রমিককেই দেখা যায় রক্তশূন্যতা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে। সাধারণ রোগশোকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শিক্ষা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা, বসবাসের জন্য উপযোগী বাসস্থানসহ স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব বাগান কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শ্রম আইনে উল্লেখ করা এসবের কোনো কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে।
এদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের অনেক বধ্যভূমি রচিত হয়; লুণ্ঠিত হয় অনেক মা-বোনের ইজ্জত। চা শ্রমিকরা হারিয়েছিল চা সমাজের অসংখ্য সংগ্রামী ও যোগ্য নেতাকে। ঠিক তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধে কমলগঞ্জে চা শ্রমিকদেরও রয়েছে গৌরবময় অংশগ্রহণ। শমসেরনগর চা বাগান, ডবলছড়া, আলীনগর, পাত্রখোলা, ধলই চা বাগানে চা শ্রমিকরা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন৷ চা শ্রমিকদের অবদানের ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ হলেও আজও চা শ্রমিকরা স্বাধীনতার স্বপ্ন হতে বঞ্চিত রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে কমলগঞ্জে ১২ টি চা বাগানে ৯২ জন শহিদ, ১৯ জন আহত ও ৪১ নির্যাতত হন।
-এটি