আবুল কাশেম অফিক
বালাগঞ্জ (সিলেট) প্রতিনিধি>
বালাগঞ্জের ব্যবসায়ীরা দাদন (সুদ) ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সুদের টাকা এনে দেনা শোধ করতে গিয়ে প্রায় ২৫ ব্যক্তি ব্যবসা গুটিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। নিঃস্ব হওয়ার পথে আরও অসংখ্য পরিবার।
ভুক্তভোগীরা জানান, শুধুই বালাগঞ্জ বাজার ও আশপাশের এলাকার প্রায় ৩০-৩৫ ব্যক্তি ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে চড়া সুদের ব্যবসা করে আসছেন। এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সাপ্তাহিক কিস্তির, সমিতির নামে লাখ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে এই সুদের ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এলাকাবাসীরা জানায়, দরিদ্র ও স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের অভাবের সুযোগ নিয়ে ওই দাদন ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। মানি লন্ডারস আইন, ১৯৪০ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে মাসিক শতকরা আড়াই টাকা সুদে অর্থলগ্নি করতে পারবেন। লাইসেন্স ব্যতীত এই ব্যবসা পরিচালনা আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু তারা এ কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে এমন একটি ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।
জুলেখা বেগম। অবস্থান বালাগঞ্জ উপজেলা সদরে। বালাগঞ্জ উপজেলা সদর বা এর আশেপাশের এলাকার অনেক মহিলার মোটা অংকের টাকার প্রয়োজন পড়লে প্রথমেই মনে পড়ে জুলেখা বেগমের কথা।
তিনি টাকার ব্যবসা করেন! ধরুন তিনি কাউকে ৫০ হাজার টাকা দিলেন, সিকিউরিটি হিসেবে তিনি টাকা গ্রহীতার কাছ থেকে নেন গ্রহীতার স্বাক্ষরিত একটি খালি ব্যাংক চেকের পাতা। তারপর ওই ব্যক্তি যখন সুদে আসলে টাকা পরিশোধ করেন তখন এই খালি চেকে জুলেখা বেগম তার ইচ্ছা মতো টাকার পরিমান লিখে ব্যাংকে টাকা তুলতে যান, একাউন্টে টাকা না থাকলেই করে ফেলেন চেক ডিজঅনার মামলা। মূলত এটাই তার ব্যবসা।
জুলেখা বেগমের ফাঁদে পড়ে বালাগঞ্জ সহ আশেপাশের এলাকার অনেক লোক সব কিছু খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
জুলেখা বেগমের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে এরকমই একাধিক মহিলার সন্ধান পাওয়া গেছে। তার নাম নুরি বেগম (ছন্দ নাম)। বালাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম গৌরীপুর ইউনিয়নের হরিশ্যাম গ্রামে এই মহিলার বাড়ি। বর্তমানে ওই মহিলা বালাগঞ্জ উপজেলা সদরের হাসামপুর রোডের জিতু মিয়ার বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন। তার স্বামী সৌদি প্রবাসী।
যেহেতু দুজন মহিলাই একই এলাকায় বসবাস করেন তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় বেশ সখ্যতা।
২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। হঠাৎ টাকার প্রয়োজন পড়ায় ওইদিন বেলা আনুমানিক ১২ টার দিকে জুলেখা বেগমের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা সুদ নেন ফাহিমা বেগম। ৫০ হাজার টাকায় মাসিক সুদ নির্ধারিত হয় ১০ হাজার টাকা অর্থাৎ শতকরা ২০%। সিকিউরিটি হিসেবে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, বালাগঞ্জ বাজার শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর- A/C no-3571101044509 একাউন্টের তারিখ বিহীন স্বাক্ষরিত খালি দুটি চেগের পাতা প্রদান করেন জুলেখা বেগমকে। জুলেখা বেগম ঋন গ্রহীতা ফাহিমা বেগমের নিকট অঙ্গীকার করেন সুদে আসলে টাকা পরিশোধিত হলে তিনি ফাহিমা বেগমকে চেক দুটো ফেরত দেবেন।
২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুদে আসলে টাকার পরিমান দাড়ায় ১ লক্ষ টাকায়। ওই তারিখেই সুদে আসল মিলিয়ে ১ লক্ষ টাকা পরিশোধ করেন ফাহিমা বেগম। জুলেখা বেগম নিয়ম অনুযায়ী ফাহিমা বেগমের কাছে চেক দুটি বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলে অবৈধ ভাবে অসৎ উদ্দ্যেশ্যে আইনি ফায়দা হাসিলের জন্য ফাহিমা বেগমের স্বাক্ষরিত খালি চেকের পাতায় টাকার পরিমানে ৮ লক্ষ টাকা লিখে পূবালী ব্যাংক বালাগঞ্জ শাখায় টাকা তুলতে গিয়ে প্রত্যাখাত হয়ে ফাহিমা বেগমকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ম আদালত সিলেট এর মাধ্যমে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারিখে একটি উকিল নোটিশ প্রেরণ করেছেন জুলেখা বেগম।
ফাহিমা বেগম প্রতারণার শিকার হয়ে কোনো উপায় না পেয়ে একই আদালতের দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/৫০৬ (ii) ফৌজদারী আইনে একটি নালিশ করেছেন। তবে এ ব্যাপারে জুলেখা বেগমের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়টি অস্বীকার করেন।
বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে, শুধু জুলেখাই নয় আরো অনেকেই এই জুলেখার মতো সুদের ব্যবসা করছে যাচ্ছেন।
দেড় বছরে শুধুই বালাগঞ্জ বাজারের কমপক্ষে ২৫ জন 'বড় ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী চড়া সুদে টাকা নিয়ে ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য , স্থানীয় বাজারের কাপড়ের ব্যবসায়ী শামসুল ইসলাম, স্বপন দাস, ছিদ্দেক আলী, ভূষিমালের ব্যাবসায়ী মতিলাল, রঞ্জিত দাস, রুপিয়ার উকিল আলী, ইলিয়াস আলী, সুজন মিয়া, হান্নান মিয়া, বির্ত্বনীয়ার ডলি বেগম, রাদাকোনার বিশু নম সুত্র , সুরঞ্জিত নম সুত্র, চানপুরের , সুহেল মিয়া, বের কুড়ির শামীম আহমদ, গৌরীনাথপুর, কয়েছ আহমদ প্রমুখ।
সুদ দাতা সমিতি বা ব্যাক্তির নামের কথা জিজ্ঞাসা করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার আরো বেশ কজন ব্যাবসায়ীদের সাথে আলাপ হলে তারা জানান তারা খুব প্রভাবশালী নাম বলতে অপারগতা জানান।
এব্যাপারে বালাগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গাজী আতাউর রহমান বলেন, সুদ দেয়া-নেয়া দুটোই অপরাধ। আমাদের কাছে এ বিষয়ে কেউই যোগাযোগ করেনি। আমি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্তা নেয়া হবে।
-এটি