মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম দীনী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান শিক্ষক এবং শাইখুল হাদিস। তার দরসের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি, শুনেছি। কিন্ত এর বাহিরেও তার অনেক বড় একটা পরিচয় আছে, সেটা অনেকেই জানি না। মাদরাসা শিক্ষকের পাশাপাশি তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী! একজন মাদরাসা শিক্ষক থেকে কীভাবে তিনি সফল ব্যবসায়ী হলেন? দারুল উলুমের এক দরসে ছাত্রদের সেই গল্প শোনালেন তিনি নিজেই। আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য সেই জীবন পাল্টে দেওয়া গল্পটি তুলে ধরেছেন দেওবন্দ প্রতিনিধি নুরুল্লাহ্ আশরাফী।
আমি যখন দারুল উলুম দেওবন্দে থেকে ফারেগ হওয়ার পর গুজরাটের একটি মাদরাসায় ১৪০ রুপি বেতনে আমার চাকরি ঠিক হয়। কিন্তু বাজারদরের তুলনায় যা ছিলো অনেক কম! আমি ভাবতে লাগলাম, পরিবার দেখাশোনার জন্য মাদরাসায় খেদমতের পাশাপাশি আমাকে বাড়তি কিছু করতে হবে। আমি তাসনিফাতের কাজ অর্থাৎ কিতাব লেখা শুরু করলাম। প্রথম যে কিতাবটি লিখেছিলাম সেটার নাম ছিলো "দাড়ি রাখা সুন্নাত"।
কিতাবটি লিখে দেওবন্দের একটি মাকতাবায় পাঠিয়ে দিলাম ছাপানোর জন্য। সেখান থেকে ছেপে গুজরাটে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমি একজন লোকের মাধ্যমে সেই কিতাবটি বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করতে পাঠাতাম। তারও কিছু কমিশন থাকতো, আমারও কিছু থাকতো। এরপরে আমি আরো কিছু ছোট ছোট রেসালা (বই) লিখে সেগুলো এভাবে বিক্রি করতে লাগলাম। গুজরাটের এই মাদরাসায় আমি ৯ বছর ছিলাম। ইতিমধ্যে দেওবন্দ থেকে আমার ডাক পড়লো, চলে আসলাম সেখানে।
দেওবন্দে এসেও লেখালেখির কাজ চালিয়ে গেলাম। এখানে প্রথম যে কিতাবটি লিখেছিলাম সেটা আল ফাউযুল কাবীরের আরবি আউনুল কাবীর লিখলাম। সেটি লিখার পরে আমি খুব বিপদে পড়ে গেলাম! কারণ কোন প্রকাশকই তাদের লাইব্রেরী থেকে ছাপাতে চাচ্ছিলো না শরাহ্'টি! তারা বলতে লাগলো তোমার এই আরবি শরাহ্ পড়ার লোক হিন্দুস্থানে নেই!
মুফতি সাঈদ আহদ পালনপুরীর সকল বই কিনতে ক্লিক করুন
তবুও নিরাশা না হয়ে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে ঘুরতে লাগলাম যদি কেউ ছাপে সেই আশায়, কিন্তু কেউই ছাপলো না। মনটা ভিষণ খারাপ ছিলো! দারুল উলুমের লাইব্রেরিতে কিতাব মুতা'আলা করছিলাম। ইতিমধ্যে দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আসলাম কাসেমী নামে একজন সিনিয়র শিক্ষক (যিনি পরবর্তীতে দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দের শাইখুল হাদিস এবং সদরুল মুদাররিসীন ছিলেন) লাইব্রেরিতে আসলেন।
আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মৌলভী সাঈদ! তোমাকে চিন্তিত লাগছে কেনো? তখন হজরতের কাছে সব ঘটনা খুলে বললাম। হজরত আমাকে নিজে অর্থ সহায়তা করে বললেন, যাও! নিজেই লাইব্রেরি করো এবং সেখান থেকেই তোমার কিতাবগুলো ছাপাও।
হযরতের পরামর্শনুযায়ী আমি দরস-তাদরিসের পাশাপাশি লাইব্রেরীর কাজও শুরু করলাম। লাইব্রেরির নাম দিলাম মাকতাবাতুল হিজাজ। আর আল ফাউযুল কাবিরের সেই শরাহ্'টিও মাকতাবাতুল হিজাজ থেকেই ছাপালাম। এরপরে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ফনের (বিষয়ের) উপর কিতাব লিখতে থাকলাম এবং সে কিতাবগুলি আমার মাকতাবাতুল হিজাজের নামেই ছাপিয়ে বিক্রি করতাম।
এভাবে ধীরে ধীরে আমার কিতাবগুলো অনেক চলতে লাগলো, ব্যবসার পরিধিও বাড়তে লাগলো। বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে আলহামদুলিল্লাহ্ এত পরিমাণ হলো যে আমার লাইব্রেরী ব্যাবসা থেকেই আমার পরিবারের যাবতীয় খরচের টাকার ব্যাবস্থা হয়ে যেতো এবং তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে দারুল উলুম থেকে আর তনখা (বেতন)নিবো না।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা মারগুবুর রহমান (রহিমাহুল্লাহ্) বরাবর দরখাস্ত লিখে জানালাম যে, হজরত আমার মাকতাবা থেকে প্রাপ্ত আয়ের মাধ্যমে আমার পরিবারের পুরোপুরি খরচ উঠে আসছে, অতএব আমার এখন দারুল উলুম থেকে বেতন নেয়ার প্রয়োজন নেই।
হজরতও আমার দরখাস্ত কবুল করে সাক্ষর করে আমার মুনাফা বৃদ্ধির জন্য দু'আ লিখে দেন। সেই দরখাস্ত আজও দারুল উলুমের মহাফেজখানায় (রেকর্ড রুম) সংরক্ষিত আছে।
তলাবায়ে আযীয!
তোমাদেরকেও বলি, মাদরাসা মসজিদে খেদমতের পাশাপাশি যে-কোন একটি ব্যবসা করবে এবং শুরুতেই নিয়তকে দুরস্ত (সহীহ্) করে নিবে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যবসা করেছেন,ব্যাবসা করা সুন্নত। অতএব আমিও সুন্নাতের নিয়তে ব্যবসা করছি, তবেই দেখবে ব্যবসায় অনেক বেশি বরকত হতে থাকবে!
আরএম/