আবদুল্লাহ মারুফ ।। অথিতি লেখক
সংসারী জীবনে প্রায় প্রতিটি ঘরেই কিছু-না-কিছু বিবাদ হয়ে থাকেㅡ কথায়, কাজে। অনেক পরিবার খুব সুন্দরভাবে এই সমস্যাটার সমাধান করে, মিলেমিশে যায় একে-অপরে। অনেকখানে আবার সামান্য একটু কথার জের ধরেই সৃষ্টি হয় কলহㅡ ভেঙে যায় পর্যন্ত সংসার!
কেন হয় এই বিবাদ?
কী-বা কারণ এই কচকচির?
কোন প্রক্রিয়ায় এগোলে বাঁচা যাবে এর থেকেㅡ চলো একটু চোখ বোলাই।
শুরুটা হয় যেভাবে
একপক্ষের কথায় ভর ক'রে হাঁটা ধরলেই পা-পড়ে এই গর্তে। একজনের কথা শোনে অপরজনকে বলতে না দিয়ে যদি বিচার শুর হয়ㅡ তখনই সৃষ্টি হবে এই কলহ। প্রথমে তাই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে উভয়পক্ষের কথা। কারণ, নবীজি করেছেন তাই।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কোন সিদ্ধান্তে যাবার আগে উভয়পক্ষের কথায় মনোযোগ দিতেন।
মক্কা বিজয়ের আগে যুদ্ধের গোপন তথ্যটা চিরকুটের মাধ্যমে জনৈক ব্যক্তি মদীনা থেকে কাফেরদের কাছে পাঠায়।। একজন মহিলা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন সেই বার্তা। তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু গিয়ে মহিলার চুলের বিনুনি থেকে উদ্ধার করেন চিঠিটা।
তারপর যে এই কাজ করেছে তাকে তলোয়ারের কোপে দ্বিখণ্ডিত করার আবেদন ওঠে নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু নবীজি আমার, কী বলে ওই লোকটি কেন সে প্রেরণ করতে গেলো চিঠিটাㅡ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। পরে বেরিয়ে এলো এর কারণ যা আমরা জানি। তারপর লোকটি মুক্তি পায়।
আবার আরেকদিন, এক মহিলা এসে নবীজিকে বলেㅡহুজুর, আমার স্বামী আমাকে মারধর করে। আমি যদি রোজা রাখি আমাকে জোর করে রোজা ভাঙায়, নফল পড়তে নামাজে দাঁড়ালে কিলঘুষি দেয়!
অথচ সে ফজর নামাজ পড়তে যায় দেরি করে, সূর্য যখন লাল হ'য় তখন যায়ㅡ আপনি এর বিচার করুন হুজুর!
মহিলার এই কথা শুনে বাহ্যত যে-কেউ মনে করবে লোকটা কতো-বড়ো জালেম!
নিজে তো করেই না আমল বউকেও করতে দেয় না!
ধরে আন ব্যাটাকে, লটকিয়ে দে পিটুনিㅡ আমরা হলে এমনটাই বলতাম।
কিন্তু নবীজি তা করলেন না, ডেকে আনলেন মহিলার স্বামীকে। তারপর বললেন তুমি কি এই কাজগুলো করো?
তখন সে জানালোㅡ আমি হুজুর গরীব মানুষ, হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সারাদিন, ঘুমোতে-ঘুমোতে অর্ধরাত পেরিয়ে যায়; ক্লান্ত শরীরে তারপর ঘুমিয়ে পড়লে সূর্যের আলো চোখে না পড়া পর্যন্ত আমি জাগতে পারি না। তাই ফজর পড়তে কিছুটা দেরি হয়ে যায় আল্লাহর রাসূল!
আর নফল নামাজ, হুজুর সে নফল পড়বে সুরা বাকারা আর আলে ইমরান এইরকম বড়ো-বড়ো সুরা দিয়ে। কাজ করে এসে একটু জলদি খে'তে বসবো ক্ষুধা-পেটে, তা আমি পারি নাㅡ রাগে তখন একটা-দুইটা থাপ্পর দেই।
রোজার কথা যদি বলি, অনেকসময় দিনের বেলা আমার কামুক-মন জাগ্রত হয়, কিন্তু তার লাগাতর রোজা রাখার কারণে আমি আমার চাহিদা মেটাতে পারি না! এইসব কারণে তাকে একটুআধটু প্রহার করেছি।
তার এই কথা শুনে নবীজি দেখলেন দোষী তো ওই স্ত্রীলোকটিই, তারপর সে অনুপাতে বিচার করলেন।
স্ত্রীর কথায় যদি প্রথমেই স্বামীকে শাস্তি দেওয়া হতো তাহলে অন্যায় হতো, নবীজি তাই উভয়ের কথা শুনে পরে ডিসিশনে গিয়েছেন। সেজন্য প্রথমে শুনতে হবে উভয়পক্ষের কথা।
এখন এসো আমাদের দিকে
ধরো তুমি খুব বউ-ভক্ত, বউয়ের একটা কথা শুনেই যদি তুমি তোমার মায়ের উপর চোখ রাঙাও, কথা দিয়ে জখম করোㅡ তাহলে তুমি জুলুম করবে। আবার, মায়ের কোন একটা কথা শুনেই যদি বউয়ের চুলের মুঠি ধরোㅡ তাহলেও তুমি জুলুম করবে।
তাহলে কী করবে?
দুজনকেই বসাবে তোমার সামনে। মায়ের পক্ষ থেকে যদি বিচারটা আসে, ধরো তুমি বাহির থেকে মাত্রই এলে বাড়িতে, আর তোমার মা নাশিল করতে লাগলো বউয়ের নামে।
তখন বউ এবং তোমার মা, উভয়কেই সামনে বসাবে।
যদি দেখো মায়ের 'ইবারত' নড়ে গেছে, আর দোষটা মায়েরইㅡ তাহলে কৌশল করবে, বউয়ের সামনেই মাকে বকা দেওয়া শুরু করে দিবে না। বলবে আমি এখন বাহির থেকে এসেছি, শরীর ক্লান্ত, আগে খাবার খেয়ে নিই, পরে দেখবোㅡ চলো যাই খেতে!
এভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে খাবারের পর মাকে একা বসিয়ে বলবে, ও তো তোমারই মেয়ে... এভাবে বোঝাবে।
يا أيها اليذين آمنوا كونوا قوامين باقسط شهداء لله ولو علي أنفسكم أو الوالدين والأقربين
হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইনসাফের পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকারী, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যপ্রধানকারী হয়ে যাওㅡ যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়বর্গের বিপক্ষে হয়। সুরা নিসা : ১৩৫
স্ত্রীদের উপর রহম করো
অনেক স্বামী আছে স্ত্রীদের গরুর মতো প্রহার করে। না, এটা ঠিক না। স্ত্রীর উপর তোমারা রহম করো। আজকে যদি তুমি অন্যের মেয়েকে কষ্ট দাও, তাহলে মনে রেখোㅡ তোমার মেয়েকেও কষ্ট পেতে হবে। কষ্ট পেতে হবে!
একটা মেয়েমানুষ, সারাটা দিন পরিবারের লোকদের কাজ করে, সংসারের সব-কাজ শেষ করতে-করতেই রাত বেড়ে যায়, তারপর ক্লান্ত হয়ে শোবার ঘরে আসে, আর তখন যদি তুমিও তাকে জোর করোㅡ এটা জুলুম হবে।
এটা করো না। স্ত্রীদের উপর রহম করো!
খেয়াল রাখো আপনদের
তোমার নিজের আত্মীয়-স্বজনদের কেউ হয়তো নিরবে সয়ে যাচ্ছে হাজারো কষ্ট। কিছু বলতে পারছে না। তাদের প্রতি খেয়াল করো!
অনেক স্বামী যৌনদলনের মাধ্যমর স্ত্রীর উপর জুলুম করে। সারাদিন গাধার মতো খেটে আবার দৈহিক অত্যাচার, এমন যদি হয় তোমার নিজের মধ্যে কারও সাথে, তাহলে অবশ্যই তার প্রতি খেয়াল রাখা তোমার কর্তব্য। প্রয়োজনে তাকে নিয়ে আসো, পরে কঠোর আইন প্রয়োগ করো যেন দ্বিতীয়বার আর তার শিকার না হতে হয়।
সর্বশেষ
তোমরা বিয়ের আগে অবশ্যই নিজেদের পছন্দের কথা বলে দিবে মা-বাবাকে।
কে নাকি একজন, শুধু লম্বা চুলের জন্যই বিয়ে করেছিলো তিনটি!
তাই, তোমার যা পছন্দ করো সেটা আগেই বলে দিবে আপনদেরㅡ যেন সে-রকম পাত্রী তারা খুঁজে বের করতে পারে। নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখে বিয়ের পর স্ত্রীর সেটা পছন্দ না হলে, তাদের কষ্ট দিয়ো না! জালেম হয়ে যাবে। রেহাই পাবে না!