আতাউর রহমান খসরু ।।
রাসুল সা. এর মাঝেই রয়েছে মুমিন জীবনের সর্বোত্তম দিশা। নবীজীবনই তার জন্য সর্বোত্তম জীবনপাথেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রাসুল সা. এর জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ। তাই আদর্শ মানুষ হতে হলে সামগ্রিক নবীজীবন তথা সিরাতচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আর তা শুরু হওয়া দরকার শৈশব থেকেই।
শৈশব ও কৈশোরেই শিশুর মনে এঁকে দিতে হবে প্রিয় নবীজীর জীবনরেখা। তবে তার জীবন চালিত হবে আল্লাহর জন্য, আল্লাহর পথে।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে সিরাতের জায়গা খুবই সংকীর্ণ। না পরিপূর্ণ সিরাতের চর্চা আছে সরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায়, না তার বিস্তৃত জায়গা আছে কওমি মাদরাসায়।
সরকারি স্কুল-কলেজে সিরাতচর্চা নবী সা. এর জীবনপঞ্জি ও কিছু মানবিক ঘটনায় আবদ্ধ। সরকারি আলিয়া মাদরাসার চিত্রও প্রায় এক। আলিয়া মাদরাসার সিলেবাসের ফাঁকে ফাঁকে সিরাতের কিছু অংশ থাকলেও তা বিধি-নিষেধ মুক্ত নয়।
বিশেষত রাসুল সা. জীবনের বৈপ্লবিক ঘটনাবলী যা একজন শিশুকে সুগঠিত রাষ্ট্র ও জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতে পারে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত অথবা নিষিদ্ধ।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সিরাতের প্রতি এমন অনীহা ও অবিচার দুঃখজনক হলেও বিস্ময়ের নয়; যতোটা না বিস্ময়ের কওমি মাদরাসায় সিরাতচর্চার সংকীর্ণ পরিধিটি।
কওমি মাদরাসার ১০ বছরের সিলেবাসে মাত্র ১টি সিরাত বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক রয়েছে এবং তাও প্রাথমিক স্তরে। নাহবেমির জামাতের সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া ব্যতীত সিরাত বিষয়ক আর কোনো পাঠ্যপুস্তক নেই দরসে নেজামিতে। অথচ কওমি মাদরাসাকে বলা হয় ইলমে দীন (ধর্মীয় জ্ঞান) চর্চার সর্বশেষ নিরাপদ কেন্দ্র।
কওমি শিক্ষা সিলেবাসে সিরাতগ্রন্থের অপর্যাপ্ত উপস্থিতিকে হতাশা ও দুঃখের বলেই মনে করেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিশিষ্ট আলেম ও মুহাদ্দিস, হজরত মাওলানা শাহ হাকিম আখতার রহ. এর খলিফা ও খুলনা দারুল উলুমের দীর্ঘদিনের প্রধান মুফতি, মুফতি নুুরুল আমিন।
তিনি বলেন, ‘কওমি শিক্ষা সিলেবাসে একটি মাত্র সিরাতগ্রন্থ থাকা দুঃখজনক। আমি এটাকে যথেষ্ট মনে করি না। সিলেবাসে সিরাতের স্থান আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।’
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও লেখক মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীনও সিরাত বিষয়ক একটি বই পড়ানো যথেষ্ট মনে করেন না। তিনি মনে করেন সিরাতের বিষয়গুলো ভাগ ভাগ করে প্রতিটি শিক্ষা স্তরে পাঠদান করা প্রয়োজন। অবশ্য বিষয়ে তার একটি ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে।
তাহলো, পাঠ্যপুস্তক একটি হলেও নানাভাবে সিরাতে পাঠসম্পন্ন হয় কওমি মাদরাসায়। যেমন, হাদিস পাঠদান সিরাতচর্চার একটি প্রধান উৎস। তাফসিরে কিতাবেও সিরাতের বিস্তৃত অংশ রয়েছে। কিন্তু এটি যে সিরাতের প্রধান উৎস বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ফলে অনেক সময় শিক্ষার্থীগণও ঠিক জানেন না যে সে সিরাতের এতো বিশাল একটি ভাণ্ডার অবগাহন করলো।
সিরাতের বিশাল ভাণ্ডার পেতে ক্লিক করুন
কওমি শিক্ষা সিলেবাসে সিরাত বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক কম হওয়ার কারণ কী?
মুফতি নুরুল আমিন মনে করেন, ‘উপমহাদেশের আলেম সমাজ আরবির চেয়ে উর্দু-ফার্সি বেশি চর্চা করতেন। আর সিরাতের বিখ্যাত সব বই আরবিতে। এ সঙ্কটটি এখন আর নেই।
দ্বিতীয়ত সিরাতের চর্চা উলামায়ে কেরাম নিজ দায়িত্বে শিক্ষাজীবনে এবং পরবর্তীতে সম্পন্ন করতেন। তাই পাঠ্যপুস্তকে তা কম রাখা হয়েছিলো। কিন্তু এখন ব্যক্তিগত চর্চা কমেছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা বাড়াতে হবে।
তা কিভাবে? প্রবীণ এ আলেমে দীন প্রস্তাব করেন আদব, ইফতা ও তাফসিরের মতো নবীজীবনের উপর তাখাসসুস বিভাগ (উচ্চতর গবেষণা বিভাগ) খোলা হোক।
প্রাথমিকভাবে বিভাগটি খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও তা ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে তিনি মনে করেন।
সিলেবাসে সিরাতগ্রন্থের অন্তর্ভূক্তি না শিক্ষা জীবন শেষ করে তাখাসসুস? বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী মনে করেন সিলেবাসে সিরাত বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোই বেশি উপকারী হবে।
তার ভাষায় ‘শিশুদের মন থাকে কোমল। যা দেখে এবং যা পড়ে তাই মনের পেলব জমিনে গেঁথে ফেলে। এজন্য পড়তে পারার বয়স থেকেই শিশুদের মনে সিরাতের ভালোবাসা, নবীজীর মহব্বত ওদের মনের গভীরে প্রোথিত করে দিতে হবে। তাহলে সামনের জীবনটা চলবে নবীপ্রেমের নিরাপদ ভেলায় চড়ে। বাইরের কলুষতা ওকে সহজে স্পর্শ করতে পারবে না।’
বাংলাদেশে সিরাতচর্চার আরেক সমস্যা হলো খণ্ডিত চর্চা। দেশের প্রচলিত শিক্ষা সিলেবাসে সিরাতের যে অংশটুকু আছে তার বেশির ভাগই ঘটনানির্ভর ও পরিসংখ্যানধর্মী।
ইতিহাস ও তথ্যের বাইরে সিরাতের জীবনঘনিষ্ঠ দিকগুলো সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে মানুষ সিরাতের প্রকৃত আলো থেকে বি ত হচ্ছে।
খণ্ডিত চর্চার সমস্যা থেকে মুক্ত নয় কওমি শিক্ষাব্যবস্থাও। যদিও সমস্যাটি মৌলিক নয়, পদ্ধতিগত।
লেখক যাইনুল আবিদীনের ভাষায় বিষয়টি এভাবে ধরা পড়ে ‘সিরাত বলতে আমরা ধরে নেই, রাসুল সা. ব্যক্তিজীবন বা জীবনী। আসলে সিরাত কিন্তু তা নয়। হাদিস সিরাতচর্চার একটি প্রধান দিক এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভাণ্ডার। কিন্তু হাদিসকে আমরা সিরাত হিসেবে দেখছি না। হাদিসের সামগ্রিক ভাণ্ডারই সিরাত।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাপকভাবে চর্চাটা হচ্ছে না। কিন্তু তার অর্থ এই না যে, পৃথিবীর কোথাও হচ্ছে না। মাদরাসা কেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সিরাতের ব্যাপক চর্চা হচ্ছে। কিন্তু জনগণের স্তরে এসে তা আর হচ্ছে না। তাই আমার মনে হয়, প্রত্যেকের তার নিজ নিজ জায়গা থেকে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক যেনো সামগ্রিকভাবে সিরাতের চর্চা হয়।’
সিরাতচর্চা ও গবেষণায় নিবেদিত এসব আলেম একমত হন যে, সিরাতের চর্চা না থাকার কারণেই সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা পরিমাণ বাড়লেও আদর্শ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। প্রতিনিয়ত আলেম বের হলেও কাঙ্ক্ষিত মানের নৈতিকতাসম্পন্ন ও দীনের জন্য নিবেদিত আলেম তৈরি হচ্ছে না।
সিরাতের চর্চা নেই বলেই মানুষ মুহাম্মদ সা. ও তার মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারছে না। ফলে মুসলমানের সন্তান মুসলমানের সামনে নবীকে গালি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। সমাজের জ্ঞান পাপীরা নবী কারিম সা. ব্যাপারে প্রপাগাণ্ডা চালানোর সুযোগ পাচ্ছে।
সমাজের এসব সঙ্কট সমাধানের সহজ উপায় হলো জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে সিরাতের অংশ বৃদ্ধি করা। বিশেষত কওমি শিক্ষা সিলেবাসে সিরাতের স্বতন্ত্র গ্রন্থের পরিমাণ বাড়ানো। কেননা আলেমরাই সমাজের ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদান করে থাকেন। তাদের এ বিষয়ে ঘাটতি থাকলে ঘাটতি পড়বে সমাজেও।
আরএম/