সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো অষ্টম পর্ব
কোনো একজন মানুষ দুনিয়াতে বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে আছেন, সবসময় তাঁর হাতে তাসবিহ, সবসময় তাঁর ঠোঁট নড়ছে, এই দৃশ্যটা কোনো একজন মানুষের মধ্যে দেখে থাকলে, আমার ক্ষেত্রে সেই মানুষটি হচ্ছেন হাফেজ্জী হুজুর রহ.। তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কী কী করেছেন, কতজন আলেম তাঁর কাছ থেকে দীন ও ইলমের দীক্ষা নিয়েছেন, আধ্যাত্মিকভাবে উপকৃত হয়েছেন, কতজন আলেমকে তিনি হাদিস পড়িয়েছেন এসব কিছু তো আসলে আমার চোখের সামনে নেই। আমি ওই যে তাঁর ঠোঁট বিড়বিড় করা, সবসময় জিকিরে থাকা-সেই দৃশ্যটি দেখেছি। আর লম্বা সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে দেখেছি। আমার মনে পড়ে না, হাফেজ্জী হুজুরকে কখনও বসে বা চেয়ারে বসে নামাজ পড়তে দেখেছি। অথচ আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন তাঁর বয়স নব্বইয়ের ওপরে। তখন তিনি প্রায়ই হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন।
আর যদি পরবর্তী সময়ে তাঁর ময়দানগত কাজের বিশ্লেষণের আঙ্গিক থেকে বলি তাহলে বলব, একাত্তরের পরে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের আলেমদেরকে আবার দেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত, ইসলামি শাসন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত; আগে তো বড় বড় আলেমরা করেই গিয়েছেন এ কাজ, কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে এই জিনিসটাকে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় করে প্রতিষ্ঠার কাজ তিনি করে গিয়েছেন।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. আমাদের শৈশবে স্বপ্নের মানুষ ছিলেন। সারাদেশের একজন বরেণ্য মানুষ ছিলেন তিনি। কেমন বরেণ্য, সবাই তাঁর কাছে এসে চুপ হয়ে যেত। আলেম, গায়রে আলেম, আমরা দেখেছি ডান-বাম রাজনীতিকদের সবাই তাঁর ব্যাপারে খুব সংযত হয়ে কথা বলতো। সেই মানুষটাকে আমরা শৈশবে চার-পাঁচ বছর খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমরা তখন নূরিয়া মাদরাসার ছাত্র। হাতে ছুঁয়ে দেখেছি, মুসাফাহা করেছি। ওই মানুষটাকে নিয়ে একটা স্মারকগ্রন্থ হবে সেখানে আমাকে কাজের জন্য ডাকা হবে-সেটা আমার ধারণায়ও ছিল না। স্মারকের উদ্যোগটাও নেয়া হয় তাঁর ইন্তেকালের প্রায় ১৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরে। মূল উদ্যোগটা নেন তাঁর সেজো ছেলে হজরত মাওলানা হামিদুল্লাহ সাহেব রহ.। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। আমাদের উস্তাদ হজরত মাওলানা ইসমাইল বরিশালি সাহেব ছিলেন স্মারকগ্রন্থটির মূল সম্পাদক।
মাওলানা হামিদুল্লাহ সাহেবের হাতে তখন প্রচুর টাকা ছিল না, তবে স্বপ্ন ছিল। একসময় তিনি অনেক প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। নূরিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। দলেও তাঁর প্রভাব ছিল। দল চালানোর জন্য দেশ-বিদেশের অর্থ ও সহযোগিতা তাঁর কাছে এসে জমা হতো। এগুলো আমরা শুনতাম। কিন্ত তিনি যখন স্মারকগ্রন্থ শুরু করেন হাতে তখন তেমন কোনো টাকা পয়সা ছিল না তাঁর।
কয়েক জায়গা থেকে তিনি শুনলেন এই কাজটা করার জন্য শরীফ মুহাম্মদ হলে সুবিধা হয়। আমিও তখন মতিঝিল থেকে ময়মনসিংহে চলে গিয়েছি। খুব গভীরভাবে কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। টুকটাক নিজের কিছু কাজ করছি আর বেকারত্ব যাপন করছি। আল্লাহ তায়ালা এই কাজটির সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে দেন তখন। তাঁরা আমাকে ডেকে নিয়ে আসেন। এক সময় আবাসিকভাবে পারিবারিকভাবে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা হয় এবং স্মারকের কাজে আমি ঢাকায় চলে আসি।
হাফেজ্জী হুজুর রহ. স্মারকগ্রন্থের কাজ আমার জীবনে একটা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। কী অভিজ্ঞতা, কীভাবে হয়েছে এই অভিজ্ঞতা? বাংলাদেশের সবচেয়ে বরেণ্য একজন আলেমের ওপর স্মৃতিচারণের জন্য আমি ওই মুহূর্তে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেমদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছি। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে। আগে তাঁর সম্পর্কে যা পড়েছি, যা জেনেছি এটার চর্চা করেছি। পরে যখন প্রশ্ন সাজিয়ে সাজিয়ে বিভিন্নজনের অনুলিখন নিতে গিয়েছি, কাউকে গিয়ে দেখেছি কথা বলছেন আর কাঁদছেন। কারও সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল একরকম, তিনি হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে হয়তো কথাগুলো এই এই বলবেন, অথচ আমি গিয়ে অদ্ভুত অন্যরকম একটা চিত্র পেয়েছি। সেটা ছিল আরও অভিভূত হওয়ার মতো।
দেড়-দুই বছর এই স্মারকের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমি বাংলাদেশের শীর্ষ যত আলেম ছিলেন সবার কাছে যাওয়া এবং তাদের বক্তব্য গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি। বলতে পারেন সাহিত্য ও সাংবাদিকতার একটা মিশেল অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা আমার সেখানে তৈরি হয়েছে। রেকর্ডার নিয়ে ছোটাছুটি করেছি, আবার সেটাকে কপি করেছি। অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদের কাছেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
আমি এই স্মারকের কাজের কারণে জীবনে একবারই আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে গিয়েছি। তিনি তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। প্রিয়াঙ্কা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে তার ধানমণ্ডির অফিসে গিয়ে সরাসরি কথা বলেছি। হাফেজ্জী হুজুর সম্পর্কে কিছু লেখার কপি তার হাতে দিয়ে এসেছিলাম। তিনি বলেছিলেনও লিখবেন। পরে কোনো কারণে আর তাঁর লেখা আনা হয়নি।
এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান এরকম ডান-বাম অনেক বড় বড় রাজনীতিক নেতার সঙ্গে আমি দেখা করেছি, লম্বা লম্বা কথা বলার সুযোগ ঘটেছে। এজন্য হাফেজ্জী হুজুর রহ. স্মারকগ্রন্থের কাজটি আমার জীবনকে অভিজ্ঞতায় অনেক সমৃদ্ধ করেছে।
হাফেজ্জী হুজুর রহ. স্মারকগ্রন্থ ছাড়া আরও কয়েকটি স্মারক নিয়ে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। যেমন হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান রহ. স্মারকগ্রন্থ। তিনি হাফেজ্জী হুজুরের পীরভাই ছিলেন আবার খলিফাও ছিলেন। ময়মনসিংহ বড় মসজিদের সাবেক পেশ ইমাম ও খতিব। হজরত থানভি রহ.-এর খুবই স্নেহধন্য মানুষ ছিলেন। তাঁর স্মারকটা করার সুযোগ হয়েছে। সেটা বোধহয় পাঁচশ পৃষ্ঠার কাছাকাছি।
এরপরে আপনি (জহির উদ্দিন বাবর) নিজে আমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বাংলাদেশের আরেকজন বরেণ্য মানুষ হজরত মাওলানা নূরউদ্দিন গহরপুরি রহ.-এর স্মারকের কাজ করেছি। বেফাকুল মাদারিসের তিনি প্রায় দশ বছরের সভাপতি ছিলেন। তাঁর ওপরে আমরা স্মারকগ্রন্থটি সম্পন্ন করে রেখেছি, প্রকাশনাটা বাকি আছে। সিলেট-ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা এই স্মারকের কাজে গিয়েছি। এরপরে ময়মনসিংহের হজরত মাওলানা মঞ্জুরুল হক রহ. সম্পর্কে একটি স্মারকগ্রন্থে কিছুটা সময় দিয়েছি। এটাও বের হওয়ার পথে।
আরও বিভিন্নজন বিভিন্ন জায়গায় স্মারকগ্রন্থ করেছেন, শুধু আমরাই করেছি এমন না। দারুর রাশাদ থেকে হজরত ছদর সাহেবের ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ বের হয় হাফেজ্জী হুজুরের স্মারকেরও আগে। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এবং মাওলানা আবু সাঈদ ওমর আলী সাহেবের ওপর স্মারকগ্রন্থ বের হয়েছে। এছাড়া গত আট-দশ বছরে বিভিন্ন জায়গা থেকে আলেম মনীষদের ওপর স্মারকগ্রন্থ বের হতে দেখেছি। দুজন মণীষীর স্মারকগ্রন্থ না হওয়া নিয়ে আমার ভেতরে আক্ষেপ আছে। হজরত মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. আর জাতীয় মসজিদের সাবেক খতিব হজরত মাওলানা উবায়দুল হক রহ.। মুফতি আমিনী সাহেবের স্মারকগ্রন্থের কাজ শুরু হয়েছিল কিছু, এখন থেমে আছে। আমার নিজস্ব সামর্থ থাকলে আমি কাজে নেমে পড়তাম। হয়তো কেউ করবেন ভবিষ্যতে, তখন সুযোগ থাকলে আমি সহযোগিতা করব।
হাফেজ্জী হুজুর রহ. স্মারকগ্রন্থটা একটা মাইলস্টোনের মতো। এর বিষয়, আয়তন, বিন্যাস সবই আলাদা। এক্ষেত্রে আমি ছাড়াও আরও অনেকেই সময় দিয়েছেন। বিশেষ করে সম্পাদক হিসেবে আমার উস্তাদ মাওলানা ইসমাঈল সাহেব, প্রফেসর মাওলানা গিয়াসুদ্দিন সাহেব, মাওলানা আজিমুদ্দিন সাহেব, মাওলানা ফারুক আহমদ সাহেব, মাওলানা সাঈদুর রহমান ভাই-তাঁরাও সময় দিয়েছেন। তবে প্রায় নব্বই ভাগ লেখা ডিক্টেশনের ভিত্তিতে আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে, কাজ গোছাতে হয়েছে।
আমি বলব, আমাদের মনীষী আলেম যারা চলে যাচ্ছেন, যাদেরকে নিয়ে লেখার মতো মানুষ আসলে নেই বাংলাদেশে, যারা লিখবেন বা স্মৃতি ব্যক্ত করবেন,তারা আসলে লিখতে অভ্যস্ত নন। এজন্য তাদের কথা থেকে লেখা বানাতে হবে। এখন বড় আয়তনের না হলেও তিনশ পৃষ্ঠার, চারশ পৃষ্ঠার, আড়াইশ পৃষ্ঠার জীবন এবং তার সঙ্গে স্মারক এই ধারাটি একটি সুন্দর ধারা। এই ধারাটি চালু থাকা দরকার। এখানে একটি পরামর্শ দেয়া প্রয়োজন মনে করি, কেউ স্মারকগ্রন্থের উদ্যোগ নিলে কোনো বুজুর্গের ইন্তেকালের বছরখানেকের মধ্যে নেয়া উচিত। কারণ স্মারকের স্মৃতিচারণ নিতে হয় সমকালীন মানুষদের। দেরি হলে অনেককেই পাওয়া যায় না। প্রেক্ষাপট, আবেগ এবং স্মৃতিও তাজা থাকে না।
-এএ