[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো সপ্তম পর্ব]
১৯৮৭ অথবা ৮৮ সালে সাপ্তাহিক জাগো প্রহরীতে একটা গল্প ছাপা হয়। সেটাই সম্ভবত আমার প্রথম মুদ্রিত লেখা। গল্পটির শিরোনাম ছিল ‘সময়ের কান্না’। এরও আগে দেয়াল পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে, সেটা বোধহয় ৮৪/৮৫ সালের দিকে।
তখন জালালাইন বা এ রকম কোনো ক্লাসে পড়ি। সম্ভবত ইনকিলাব থেকে প্রথম লেখক সম্মানী পাই। কোনো কোনো লেখার বিল পেয়েছি দেড়শ টাকা, একশ টাকা। আমি আশি টাকাও লেখার বিল পেয়েছি। আর নব্বইয়ের দশকে বড় লেখার জন্য, বিশেষ সংখ্যায় লিখে তিনশ, সাড়ে তিনশ টাকাও পেয়েছি। তখন এটা আমার কাছে অনেক টাকা। প্রথম বিল সম্ভবত নব্বইয়ের আগে আটাশি-উনানব্বই সনে এবং সেটা একশ টাকার ভেতরে। ইনকিলাবে তখন আমার লেখাগুলো প্রধানত ছাপা হতো আধ্যাপক আবদুল গফুর সাহেব ও ইউসুফ শরীফ ভাইয়ের সম্পাদিত পাতায়।
লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে আছি,অনেক দিন তো হয়ে গেল। তবে এর প্রাপ্তি নিয়ে ওইভাবে ভাবিনি। মূলত আমি কিছু লেখা আর কিছু বলা ছাড়া আর কিছু তো পারি না! এজন্য এই দুইটা জিনিসই করি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমাকে আমার এই দুর্বল লেখালেখির মধ্যেই এমন অনেক পুরস্কার দিয়েছেন, দোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সময়ে সময়ে যেগুলো আমার সামনে এসেছে, এগুলোর কথা যখন মনে হয় তখন আমি আমার সন্তানকে সামনে নিয়েও বলি, কৃতজ্ঞতা আদায় করে শেষ করতে পারবো না।
আমি এমন কী লিখেছি! দশ বছর আগে কক্সবাজার গিয়েছি, একজন এসে বললেন,আমি আপনার ‘সবুজ গম্বুজের ছায়া’ পড়েছি। আমি তখন থেকে আপনাকে খুঁজছি। আমি বগুড়ায় গিয়েছি, এই মুফতি মনোয়ার হোসেন, তার প্রথম অভিব্যক্তি ছিল, আমি ছাত্রজীবনে ‘সবুজ গম্বুজের ছায়া’ পড়েছি।
আমার দেশ পত্রিকায় আমার কোনো একটা লেখা প্রকাশ হয়েছে, আবেগমিশ্রিত লেখা, যে লেখাটি লেখার সময় আমার ভেতরেও খুব আবেগ কাজ করেছে, আমি হঠাৎ করে ফোন পেয়েছি একজনের, বলেছেন গতকাল আপনার লেখাটি পড়ে আমি কেঁদেছি। এর মধ্যে বড় আলেম আছেন, ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ আছেন, ব্যবসায়ী আছেন, দীনদার তাবলিগি আছেন।
যারা কেউ কেউ বলেছেন, আপনার ওই লেখাটি পড়ে আমি কেঁদেছি, ওই লেখাটি পড়ে আমি খুব উদ্দীপ্ত হয়েছি, ওই লেখাটি পড়তে গিয়ে আপনাকে খুঁজছি। আমার মতো মানুষ এই দোয়া, এই ভালোবাসা অন্য কোনভাবে পেতাম! আমি যদি আজ কোটি টাকার মালিকও হয়ে যেতাম, মানুষের বুকের ভেতর থেকে আসা, এই আবেগদীপ্ত ভালোবাসা অথবা দোয়া পাওয়া আমার পক্ষে কি সম্ভব ছিল! আমি এটা পেয়েছি, আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। আমি এই প্রাপ্তির জন্য আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করি।
বড়দের অনেক দোয়া পেয়েছি। একটি ঘটনা। ইনকিলাবের কোনো বিশেষ সংখ্যায় আমার তখন কয়েকটি লেখা ছাপা হয়েছে মাত্র। সেটা ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে। আমাদের এক উস্তাদ, তাঁর সঙ্গে হঠাৎ দেখা। তিনি খুব যোগ্য মানুষ, এই মুহূর্তে নামটি বলছি না। তিনি বললেন, তোমার যে লেখাগুলো আমি ইনকিলাবে পড়ি বিশেষ সংখ্যায়, অন্য অনেক লেখার চেয়ে এই লেখাগুলো সুন্দর লাগে। তাঁর তবিয়তে বা রুচির মধ্যে অহেতুক কাউকে প্রশংসা করাটা নেই। হতে পারে আমার প্রতি অতি স্নেহ থেকেই তিনি এটা বলেছেন। বিষয়টি ছিল আমার জন্য অনেক ভালো লাগা একটি ঘটনা। আমি তাঁরএ অভিব্যক্তিতে অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি।
আরেকটি ঘটনা। তখন বেফাকের অফিস নয়াপল্টনে। সাহিত্য বা সিলেবাস এ ধরনের কোনো একটি বিষয় নিয়ে বেফাক অফিসে একটা মিটিং হচ্ছিল। সে মিটিংয়ে প্রফেসর আবদুল গফুর সাহেবকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। ওখানে আমাদের কয়েকজন উস্তাদও উপস্থিত ছিলেন। কেউ বেফাকের কর্মকর্তা হিসেবে, কেউ নেগরান হিসেবে। ঢাকার আরও শীর্ষস্থানীয় আলেমরা উপস্থিত ছিলেন। ওখানে অধ্যাপক আবদুল গফুর সাহেবের কাছে লেখালেখি সংক্রান্ত কোনো কাজের ব্যাপারে লোক চাওয়া হলো।
তিনি বললেন, আপনাদের মধ্যেই তো লোক আছে। আমি তো মাওলানা শরীফ মুহাম্মদকে চিনি, সে মতিঝিল মাদরাসার শিক্ষক। আপনারা তাকেই কাজে লাগান। আবদুল গফুর সাহেব যে সেখানে একথা বলেছেন সেটা তিনিও আমাকে বলেননি এবং আমিও তখন জানতে পারিনি। পরে কয়েকজন উস্তাদ আমাকে সেই কথাটি বলেছেন। তখন ইনকিলাব অনেক প্রভাবশালী পত্রিকা। বলা যায়,আজকের প্রথম আলোর পর্যায়ের। সেখানে আমার উস্তাদদের সামনে ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক, ভাষাসৈনিক আবদুল গফুর সাহেব আমার সম্পর্কে এই কথা বলেছেন। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওনা মনে হয়েছে।
আরেকটা ঘটনা আমি বলতে পারি, হাফেজ্জী হুজুর রহ. স্মারকগ্রন্থের কাজ শেষ হওয়ার পরে আমি কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কারণ ঢাকায় আমার সামনের কাজ কী, আমাকে আবার হয়তো ময়মনসিংহে ফিরে যেতে হবে। তখন ওই স্মারকগ্রন্থের মূল উদ্যোক্তা মাওলানা হামিদুল্লাহ সাহেব রহ.একটা কথা বলেছিলেন, যা আজও মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, শরীফ! আল্লাহ তোমাকে দিয়ে যে বড় কাজটা করিয়েছেন তোমাকে ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ বা ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দাঁড়াবে না।
আল্লাহ তোমাকে সবসময় কেন্দ্রে রাখবেন এবং বড় কোনো কাজ করাবেন। আমার কাছে এটা অনেক বড় দোয়া মনে হয়েছে তাঁর। আল্লাহর শোকর, এটা ২০০৪ বা ২০০৫ সালের কথা বলছি; এখন ২০১৯; গরিবি হালতেই আছি, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা চালিয়ে নিচ্ছেন। এবং সারাদেশে বড় আলেম ব্যক্তিত্বরা যারা আমাদের অভিভাবক তাদের স্নেহ পেয়ে যাচ্ছি।
বেশ কয়েক বছর বিরতির পর কাছাকাছি সময়ে আমার অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু গত দেড় বছর যাবত, সম্ভবত আরও বেশি সময় ধরে কোনো বই তৈরি করার জন্য কোনো কিছু লিখতে পারিনি। এটার একটা বড় কারণ হলো, ইসলাম টাইমস এবং এর আগে ফাতেহ টোয়েন্টিফোরে একটু সময় দিতে হয়েছে। সবদিক মিলিয়ে একটা সময় আমার এটার পেছনে দিতে হয়। আমি আসলে লেখায় যখন বসি যেটা আমার মৌলিক লেখা, সেখানে একটা ঘোরের মধ্যে যেতে হয়, একটা মানসিক প্রস্তুতি ও নিমজ্জন লাগে।
মনের দিক থেকে নির্জনে আনতে হয় নিজেকে। এটা হওয়ার আগ পর্যন্ত আসলে একটা বইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে আমি পারি না। গত এক দেড় বছর আগে আমার কয়েকটি বই একসঙ্গে বেরিয়েছে, এর কয়েকটি বই-ই রয়েছে এমন যেগুলো আসলে প্রকাশিত লেখাগুলোর সংকলন।
সেখানে আরেকটু বিন্যাস করে বইটি সাজিয়েছি। এজন্য এটা আমার জন্য সহজ হয়েছে। কিছুদিন আগে আমার আত্মজৈবনিক যে বইটা বের হলো ‘রঙিন মখমল দিন’ এটার তিন চারটা লেখা আগে লেখা ছিল। বাকি লেখাগুলো সব আমি সময় নিয়ে নিয়ে লিখেছি। বসে বসে ভেবে ভেবে লিখেছি। আবার এটাও হয়, বিরতি দিলে লেখার জ্বলন তৈরি হয়। আল্লাহ তাওফিক দিলে আগামী এক-দেড় বছরে আরও কয়েকটি বই আসতে পারে।
লেখালেখি এটা আসলে একটি সৃজনশীল জগৎ। চাল, ডাল, লবণ, তেল এগুলোর ব্যবসা শতভাগ কমার্শিয়াল একটা পথ ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, লেখালেখির জীবনের পথ ও প্রক্রিয়াটা এর সঙ্গে মিলবে না। তাছাড়া বাংলাদেশে ইসলামি বইপত্রের বাজারের বিস্তৃতির কথা বিবেচনা করলে একজন লেখকের ভেতরে ত্যাগী মানসিকতাও থাকতে হবে এবং ধৈর্যও থাকতে হবে। এবং নিজের কাজ উত্তীর্ণ করা, মানটাকে বাড়ানোর চেষ্টাটাও থাকতে হবে। আর দেনাপাওনা নিয়ে এখানে অনুযোগ ব্যক্ত করতে শুরু করলে আসলে অনেক দিক থেকে অনেক অনুযোগ করা যাবে।
একজন প্রকাশক যদি বলেন, আমি কি এতো বই বিক্রি করতে পারি? আমাকে কি পাঠকরা এতো টাকা দেয়? আবার একজন পাঠকের দিক থেকে বললে, আমরা কত বই কিনব এত এত টাকা দিয়ে? আবার একজন লেখকের দিক থেকে বললে বলা যায়, আমি যা লিখছি এতো কষ্ট করে আমি কি তার পারিশ্রমিকটা পাচ্ছি?
এসব প্রশ্নের আসলে সমন্বিত উত্তর হলো, আমাদের বাজার এবং জগৎ আরও সম্প্রসারিত করতে হবে বা হতে হবে। যখন ক্ষেত্র আরও বিকশিত হবে, সম্প্রসারিত হবে, একজন লেখকের তখন দেশের মার্কেটে এমন বই থাকবে যে একটি বই-ই এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে, দুই লাখ কপি বিক্রি হয়েছে, তখন রয়্যালিটি, প্রকাশনা, অন্য বিষয়গুলোও আরও সুন্দর ও পরিণত হবে।
এমনও হতে পারে, একজন লেখক সারা বছরে একটা বই লিখেছেন মেহনত করে, আর ওই বই দিয়েই পাঁচ বছর চলছেন। যেটা অন্যান্য দেশে হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এই প্রশস্ত পথটা খুলতে পারে, এরজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এখন ত্যাগ, ধৈর্য এবং নিজের কাজের মানের উত্তরণ-এই দিকগুলো বিবেচনায় রাখাটাকেই একজন লেখক হিসেবে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
চলবে...