[সম্প্রতি বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদের একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নেন জহির উদ্দিন বাবর। সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়েছে লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যায়। আওয়ার ইসলামে পুরো সাক্ষাৎকারটি পর্যায়ক্রমে গদ্য আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো পঞ্চম পর্ব]
মাদরাসায়ে নূরিয়ায় পড়ার সময় হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর খেলাফত আন্দোলনের অনেক মিটিং-মিছিলে যেতে হয়েছে। লালবাগে পড়ার সময় মুফতি আমিনী সাহেবের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে থাকতে হয়েছে। এজন্য মনের মধ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের একটা বিষয় ঢুকেই ছিল। আর আমাদের ওই সময়টাতে পৃথিবীব্যাপী নানারকম ইসলামি আন্দোলন, সংগ্রাম, জেহাদের একটা প্রেক্ষাপট ছিল। ১৯৯২ সালে আমি মতিঝিলের শিক্ষক, যখন বাবরি মসজিদ লংমার্চ হয়। ওই সময় মিছিল-মিটিংয়ে ভূমিকা রাখা; বিশেষ করে প্রেসের বিষয়টি দেখা, লংমার্চ যখন সফরে ছিল তখন ঢাকায় প্রেসের সমন্বয়ের দায়িত্বটা আমার ওপরে ছিল। প্রেস রিলিজ তৈরি করে সেটি নিয়ে তখন সংবাদপত্রের অফিসে অফিসে যেতে হতো।
এরপরে ১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরিনবিরোধী বা নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী একটা আন্দোলন বাংলাদেশে হয়। শুধু তসলিমা না, তার নামটা সামনে এসেছিল, আন্দোলনটা ছিল নাস্তিক্যবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে। এর আগে থেকেই সাহিত্য পড়ার কারণে আমি সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, যেটা নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত হয়ে বের হতো, ওখানে তসলিমার কলামগুলো পড়তাম। তখনই আমার খুব খারাপ লাগতো। বাংলা একাডেমির মেলায় যেতাম। বামধারার দৈনিক পত্রিকাগুলো তখন এতোটা সক্রিয় ছিল না। তবুও কোনো লেখায় ইসলামকে আঘাত করতে দেখলে খুব খারাপ লাগতো, মন খারাপ হতো, রাগ লাগতো। কিন্তু কোনো সঙ্গী পেতাম না। কারণ তখন মাদরাসাগুলোতে ব্যাপকভাবে পত্রিকা পড়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি করার মতো পরিবেশ ছিল না।
যখন তসলিমা নাসরিনের বিতর্কিত একটি বক্তব্য, ‘কুরআন পরিবর্তনে’র বক্তব্য নিয়ে মূলত আন্দোলন শুরু হয়; তখন কবির চৌধুরীর বিতর্কিত বক্তব্য, শামসুর রাহমানের বিতর্কিত বক্তব্য, দৈনিক জনকণ্ঠের কিছু বিতর্কিত রচনা-লেখা এরকম একটি বিষয় নিয়ে নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী একটি গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। একটা পর্যায়ে সারা বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামই এর সঙ্গে জড়িত হন। মুফতি আমিনী সাহেবের ছাত্র হিসেবে, আমি যদিও মতিঝিল মাদরাসার শিক্ষক ছিলাম তখন, খুব ওৎপ্রোতভাবে মিছিল-মিটিংয়ে জড়িয়ে যাই।
ঢাকার বাইরে থেকে অনেকেই অনেক ভূমিকা রেখেছেন তখন, বিশেষ করে সিলেটের প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেব।
তখন আসলে ঢাকার বাইরে কেউ ভূমিকা রাখলেও ব্যাপকভাবে সামনে আসতো না। কারণ মিডিয়া এতো ব্যাপক ছিল না। বিটিভির বাইরে ছিল দৈনিক পত্রিকা। রেডিওকে মানুষ মিডিয়া মনে করত না। বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না। পত্রিকা মানুষ পরের দিন পেত। তখন আমাকে ঢাকায় এবং ময়মনসিংহে দুই জায়গায় আন্দোলনের সহযোগী হিসেবে ব্যাপক সময় দিতে হয়েছে। খুব আবেগের সঙ্গে সময় দিই। আমার কাছে ব্যক্তি তসলিমা নাসরিন কোনো ব্যাপার ছিল না। ইসলামবিরোধী কিছু লেখক, কলামিস্ট তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলছে, একটা ঈমানি প্রেরণা থেকে তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই।
আমরা তখন যা করেছি সেটাকে প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক কাজ বলা যায় কি না তাতে আমার সন্দেহ আছে। আমি অনেক সময় ভাবি, উলামায়ে কেরাম যে রাজনীতি করেন এটা কি আসলে সিয়াসত, নাকি তাহরিক। বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক ইসলামি আন্দোলন বলা যায়। এটাও অন্তত ধরে রাখার দরকার আছে। এটাতে একটা সময় আমার খুব আবেগ ছিল।
মাঝে মাঝে এখনও যদি এরকম পরিস্থিতি সামনে চলে আসে আবার আমার ভেতরে আবেগ উথলে ওঠে। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মেজাজ আমার মধ্যে নেই, আমাদের মধ্যেও নেই। তারপরও রাজনীতি যারা করেন সেই রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু গ্রামার মেনে চলতে হয়। মিছিল-মিটিংয়ে দল, পথ, মত মেন্টেন করতে হয়; আমি একটা সময় বুঝেছি যে, আমার আসলে আবেগ যতটুকু বা আবেগপ্রবণতার জায়গাটায় আমি যতটুকু, রাজনৈতিক ময়দানে এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনীতির বাস্তব নিয়মগুলো মেনে চলা এবং এটাকে পুরোপুরি নিজের সঙ্গে ফিট করা; এই জায়গাটিতে আমি আসলে তত উপযুক্ত নই। বরং লেখালেখির অংশটাতেই আমার বেশি সময় দেয়া উচিত।
এজন্য আন্দোলন মনস্কতা বলেন বা রাজনৈতিক মনস্কতা বলেন প্রবলভাবে আমার ভেতরে থাকার পরও ময়দানে নামার ব্যাপারটা আমার ভেতরে কমে আসে। আমার মনে হয় যে, একটু বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ, একটু লেখালেখির কাজ, যারা ময়দানে নেমে কাজ করেন তাদের পেছন থেকে সহযোগিতা করি, আমার জন্য মনে হয় এই অঙ্গনটাই ভালো। আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু আমার এখনকার অনুভবের বাস্তবতা এটাই।
প্রিয় উস্তাদ মুফতি আমিনী রহ.
মুফতি আমিনী সাহেবের সমকালীন মানুষেরা তাঁর ব্যাপারে অনেকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবেন। আমি যেহেতু তাঁর ছাত্র ছিলাম আমি কিছু ভালো দিকের কথাই বলি। উনার দরসের দিক অথবা বড় আলেম হওয়ার দিক, মুতালায়া করার দিকগুলো ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। বয়ানের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষকে উদ্দীপ্ত করতেন। শুধু রাজনৈতিক জাগরণের কথা বলছি না, মাহফিলের কথাও বলছি, পুনর্জাগরণ যাকে বলে; হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রতি আশাবাদী করে তোলা, প্রতিরোধের একটা আওয়াজ উঁচু করা-তাঁর এই ভূমিকাটা আমার কাছে খুব ভালো লাগত।
আরেকটি দিক হলো, বিভিন্ন ইসলামি ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের কোনো ক্রান্তিকালে খুব এককভাবে, হয়তো আয়োজন নেই; সবাই সংযুক্ত হবে কি না সংশয় আছে, বীরবিক্রমে কোনো দিকে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং পরিস্থিতিটাকে সফলভাবে উৎরে যাওয়া, এই কৃতিত্বটা তাঁর ছিল। ‘তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ’ বলে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং একটা জায়গায় চলে যাওয়া-তাঁর এই জিনিসটাও আমার কাছে ভালো লাগতো।
আরও একটা জিনিস ভালো লাগত, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে স্নেহ করা বা মূল্যায়ন করা। আমি ফারেগ হয়ে লালবাগ থেকে মতিঝিলে চলে এসেছি, এরপরে যখনই আমিনী সাহেব হুজুরের সামনে যেতাম খুব আশ্চর্য হয়ে যেতাম; কোনো রাজনৈতিক ও আন্দোলনগত তৎপরতা, সাংবাদিকদের ফেস করার বিষয়; বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়; আমি গেলে অথবা মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেলকে দিয়ে ফোন দিয়ে ডাকিয়ে নিয়ে এসব ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করার ভঙ্গিতে কথা বলতেন।
এমন গভীর গভীর আলোচনা অনেক সময় তিনি আমার সঙ্গে করতেন আমার কাছে মনে হতো, হুজুর আমাকে অনেক বড় একজন ‘বুদ্ধিমান’ মানুষ মনে করছেন। অনেক বাড়তি সম্মান দিচ্ছেন। আমার বিবেচনাটাকে, আমার চিন্তাটাকে তিনি এতো আমলে নিচ্ছেন; আমাকে ডেকে এনে পরামর্শ করছেন; তাঁর এই অবস্থানটা আমার কাছে বা তাঁর এই মায়াটা আমার কাছে অসাধারণ লাগতো। এ বিষয়গুলো ছিল তাঁর উদারতা ও বিশালতা, কিন্তু আমি আপ্লুত হয়ে যেতাম।
-এএ