সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ কিউবায় ইসলামের নব জাগরণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রকিব মুহাম্মদ


কিউবার রাজধানী পুরনো হাভানার বিভিন্ন রাস্তায় মনোরম পরিবেশে বোরকা ও হিজাব পরে হাঁটতে দেখা যায় মুসলিম নারীদের। আর সেথানে দিন দিন বাড়ছে এর সংখ্যা। সেখানে ধর্মচর্চা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে নারী-পুরুষদের। ইসলামের আলোয় রীতি-নীতি ভালোভাবেই মেনে চলার চেষ্টা করছে কিউবার নারী-পুরুষরা।

জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ মুসলিম বসবাস করছে এখন কিউবায়। নিরবে ইসলামের প্রসার হচ্ছে সেখানে। অন্য ধর্মের মানুষগেুলো আস্তে আস্তে ভিড়ছে ইসলামের পতাকা তলে। তবে ইসালামের দীক্ষায় সেখানে নারীদের জন্য হালাল খাবার খুঁজে পাওয়া এবং পুরো দেশে একটি মাত্র মসজিদ থাকার কারণে ইবাদত-বন্দেগিতে অসুবিধায় পড়তে হয়।

অনেক সমস্যার মাঝেও সেখানে নরীদের মধ্যে বড়ছে ধর্মে-ধর্মান্তরিত হওয়ার দৃশ্য। ইসলামের চোখ জুড়ানো ভ্রাতৃত্ব তাদের নতুর করে ভাবাতে শুরু করে। নতুন বিশ্বাসকে গ্রহণ করে: আধ্যাত্মিক উদ্ঘাটন, ধর্মীয় কৌতূহলের কারণে মুসলিমদের সাথে অংশ নেয় অন্য ধর্মের নারীরা। আর এভাবেই বেড়ে চলছে দীনের প্রচার।

২৭ বছর বয়সী মরিয়ম ক্যামেজো পেশায় একজন সাংবাদিক। যিনি সাত বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী মহিলাদের এবং বিশেষত কম বয়সী মহিলাদের সংখ্যা বেড়েছে।

মরিয়ম স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত এবং হাভানার মসজিদে আরবি এবং কুরআন ক্লাস পাঠদান করান। যা ২০১৫ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল।

৩৫ বছর বয়সী ইসৌরা আরগুদিন বলেন, দ্বীপে "জ্ঞান" না থাকার কারণে তিনি কিউবার মুসলিম মহিলা হিসাবে অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

কিউবার ইসলামিক লীগের মতে, ১ হাজার ২শ’ জন মহিলাসহ প্রায় ১০ হাজার মুসলমান রয়েছে সেখানে।মসজিদ নেই সেই দেশ মুসলমানদের জন্য ভ্রাতৃপ্রতীম নয় এ কথা অনস্বীকার্য। আর খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কিউবায় মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার। যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.১ ভাগ।

সত্তর ও আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিউবায় পড়তে আসা কিছু ছাত্র ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। ইসলামের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কিউবার স্থানীয়রা ইসলাম গ্রহণ করা শুরু করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে ইসলামের প্রচার বেড়ে যায়। কিউবার দুটি মুসলিম সংগঠন (অরাজনৈতিক) ইসলাম প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে।

https://www.facebook.com/331651104451847/videos/2966960639986235/

মসজিদ না থাকায় কিউবার মুসলিমরা সাধারণত বাড়িতেই তাদের ইবাদত-বন্দেগি করে থাকেন। কারণ কিউবায় জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়ার জন্য নেই কোনো মসজিদ। তবে হাভানায় ‘আরব হাউজ’ নামে একটি ইমিগ্রান্ট ভবনে (বর্তমানে এটি যাদুঘর ও রেস্টুরেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত) শুধু জুমার নামাজ পড়ার জন্য কিউবা সরকার অনুমতি দিয়েছে। মাত্র তিন ঘন্টার জন্য খুলে দেওয়া হয় ভবনটি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ঐখানে নামাজ পড়তে পারবে শুধু যারা নন-কিউবান মুসলিম তারা। কিউবার মুসলিমদের ক্ষেত্রে সে অনুমতিও নেই।

কিউবায় মুসলিম জীবনাচার মেনে চলা কষ্টকর হলেও স্থানীয়রা যথাসম্ভব তাদের সহায়তা করেন। বিশেষ করে হালাল খাবার খুঁজে পেতে তাদের অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়। সমগ্র কিউবায় মুসলিমদের জন্য কোনো হালাল মাংসের দোকান নেই।

উল্লেখযোগ্য দুজন কিউবান নওমুসলিম: আলী নিকোলাস কোসিও, সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী, বর্তমানে তিনি ‘ভয়েস অব ইসলাম’ নামের একটি রেডিও স্টেশনে সাংবাদিকতা করছেন। জুয়ান কার্লোস গোমেজ, সাবেক বিখ্যাত কিউবান বক্সার।

ইসলাম এখন কিউবায় দ্রুত বেড়ে চলেছে। তবে তা নীরবে। এখন সেখানে প্রায় ১০ হাজার মুসলিম বাস করে। কিউবার এক কোটি ১৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে তারা একেবারেই ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে অল্প কিছু মুসলিমের বিষয়টি মাথায় রাখলে তাদের বৃদ্ধি ব্যাপক বলে মানতেই হবে।

[caption id="" align="alignnone" width="998"] ঘরেই নামাজ আদায় করছেন কিউবান মুসলিমরা[/caption]

‘কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মীয় বহুত্বের দরজা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম বিকশিত হতে থাকে।’ এটা ছিল আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মাইকেল লিও ওয়েন্সের বিশ্লেষণ।

কিউবায় ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটছে মূলত ছাত্র আর কূটনীতিবিদদের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে- এমনটিই মনে করেন স্পেনের বার্সেলোনাভিত্তিক সাংবাদিক জুয়ান আলভারো। ২০১৪ সাল থেকে আলভারো কিউবার মুসলিমদের জীবনযাপন নিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছেন। বিশেষ করে কিউবার রাজধানী হাভানার মুসলিমদের প্রতি তার আগ্রহ ব্যাপক। অতি সম্প্রতি আলভারো কিউবায় ফিরেছেন। তিনি এখন আরো গভীরভাবে তার কাজে মনোনিবেশ করেছেন।

আলভারোর পরিচিত ওসমান রেয়েস ইসলাম গ্রহণ করেছেন ২০১৫ সালের জুনে। আলভারো জানান, ওসমান তাকে জানিয়েছেন, ইসলাম তাকে ‘আরো স্বাধীনতার’ অনুভূতি দিয়েছে। ওসমান বাস করেন কিউবার মধ্যাঞ্চলীয় নগরী ক্যামাগুয়েতে। ২০০০ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় মুসলিমরা সেখানে একটি বাড়িতে চলনসই ধরনের মসজিদ নির্মাণ করেছেন।

১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে কিউবায় যে কয়েকজন মুসলমান ছিলেন, তারা তাদের ধর্মচর্চার জন্য নির্যাতনের মুখে পড়বেন বলে শঙ্কায় ছিলেন। অবশ্য এখন দিন বদল হয়েছে। তাদের এখন নেতা আছে, শিক্ষক আছে, ইবাদত করার জন্য বড় বড় বাড়ি আছে। নামাজ পড়ার পোশাক দেয়া হয়, রমজান মাসে মুসল্লিদের গোশতও সরবরাহ করা হয়।

ইসলাম গ্রহণ মানে কিউবানদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা। তাদেরকে তখন শূকর খাওয়া বন্ধ করতে হয়, অ্যালকোহল পান করা যায় না। বেশির ভাগ কিউবান মুসলিম সেটা মেনেও নেন। অবশ্য, যেখানে ইমাম নেই, সেখানে ইসলাম গ্রহণের পরও অনেকে আগের রীতিনীতি অনুসরণ করতে থাকেন।

হোর্হে এলিয়াস সম্প্রতি ইসলামে দীক্ষা নিয়েছেন। তার মুসলিম নাম ইসা। গত বছর অপর কয়েকজন মুসলিমের সাথে মক্কায় গিয়ে হজ্জ্বও করে এসেছেন।

তিনি বলছিলেন, কিউবায় একজন মুসলমান হিসেবে ধর্ম মেনে চলা একদিকে খুব সহজ, আবার অন্যদিকে খুবই জটিল। তার বর্ণনায়-

আমরা এখনো খুবই ছোট্ট এক সম্প্রদায়। অনেক সময় মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন আমাদের জন্য অতটা সহজ নয়। যেমন ধরুন, আমরা হালাল খাবার চাই, কিন্তু সেটা পাওয়া সহজ নয়। আর কিউবায় লোকজন প্রচুর শুকরের মাংস খায় এবং মদ পান করে। আপনি জানেন, ইসলামে এসব নিষিদ্ধ। তবে এটা কোন বড় সমস্যা নয়। এখানকার মানুষ খুব ভালো। সবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই চমৎকার। তবে এটা সত্য যে, মুসলিম হিসেবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সমস্যা রয়েই যায়।

https://www.facebook.com/331651104451847/videos/1426513870820106/

কিউবার রাজধানী হাভানায় মুসলমানদের নামাজ পড়ার জায়গা এখন পর্যন্ত একটাই। আর সেটা হলো ইমাম ইয়াইয়া পেড্রো টোরেজের বাড়ির আঙ্গিনা। তিনি কিউবার ইসলামিক লীগের প্রেসিডেন্ট। ইমাম পেড্রো টোরেজ অবশ্য স্বীকার করলেন যে, কিউবার মত দেশ, যেখানে মদ্য পান আর খোলামেলা যৌনতা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার, শুকর যেখানে জাতীয় খাদ্য, সেখানে কড়াকড়িভাবে ইসলাম মেনে চলা খুবই কঠিন।

সম্প্রতি কিউবা সফরে এসেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসিপ তাইয়িপ এরদোয়ান। কলম্বাসের অনেক আগে মুসলমানরাই প্রথম দ্বাদশ শতকে কিউবায় নেমে আমেরিকা আবিস্কার করে বলে দাবি করে তিনি কিছুদিন আগে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। কিউবার নেতা রাউল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কিউবার প্রথম মসজিদ তৈরি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এই প্রস্তাবের আগেই মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে সৌদি আরব। হাভানার শিল্পাঞ্চলের কাছে সৌদি অর্থে তৈরি হতে যাচ্ছে কিউবার প্রথম মসজিদ। কিউবার ছোট্ট মুসলিম সম্প্রদায় শীঘ্রই এখানে এসে নামাজ আদায় করতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ