বেলায়েত হুসাইন
আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। ভারতবর্ষের একজন প্রখ্যাত মুসলিম রাজনীতিবিদ। তিনি সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন দলের প্রেসিডেন্ট। হায়দারাবাদ থেকে তিনি পরপর চারবার আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
ভারতীয় মুসলিমদের অধিকার নিয়ে সবসময় সোচ্চার থাকতে দেখা যায় তাকে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ইস্যুতে তার জ্বালাময়ী বক্তব্য ও নৈতিক যুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় মুসলিমদের মনে শক্তিশালী জায়গা করে নিয়েছেন এ মুসলিম নেতা।
আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ১৯৬৯ সালের ১৩ মে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দারাবাদে (বর্তমান তেলেঙ্গনা,ভারত)
জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সুলতান সালাহউদ্দিন ওয়াইসি। ১৮৯৬ সালে ফারহিন ওয়াইসিকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের ৬ জন সন্তান রয়েছে।
আসাদুদ্দিন ওয়াইসি একজন আইনজীবী। ভারতীয়দের কাছে ‘নকিব-ই-মিল্লাত’, ‘কায়েদ’, ‘আসাদ বাবা’, ‘আসাদ ভাই’ নামেও পরিচিত তিনি। ১৫ তম লোকসভায় শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের জন্য ২০১৪ সালে তিনি সংসদ রত্ন পুরষ্কার লাভ করেন।
শেষবার নির্বাচিত হয়ে যখন তিনি লোকসভায় শপথ গ্রহণ করতে আসেন এ সময় ‘‘ভারতমাতা কি জয়'' ও ‘‘বন্দেমাতরম'' ধ্বনি তোলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি সাংসদরা। ওই চিৎকার শুনে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি হাসেন এবং ইশারায় তাদেরকে আরও জোরে চিৎকার করতে বলেন।
আর উগ্রবাদীদের হিন্দুত্ববাদী চিৎকারের প্রতিবাদে স্বগর্ভে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘জয় ভীম, জয় মীম, তাকবির আল্লাহু আকবার, জয় হিন্দ।''
সবশেষ ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে ৩০৩ আসনে জয়লাভ করেছে। নির্বাচনের এই ফল প্রকাশের পরপরই আসাদুদ্দিন বলেন, বিজেপির ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পরে মুসলিমদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ সংবিধান ভারতের সব নাগরিককে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে তিনি বলেন, ভারতের আইন ও সংবিধান আমাদের অনুমতি দিয়েছে নিজেদের ধর্মকে অনুসরণ করার। যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মন্দিরে যেতে পারেন, তাহলে আপনিও গর্বভরে মসজিদে যেতে পারেন।
একবার আসামের গভর্নর পদ্মনাভ আচার্য মন্তব্য করেন,'হিন্দুস্থান শুধুমাত্র হিন্দুদের বসবাসের জন্য, আর কারো জন্য নয়'। আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ওই মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন এবং তা ভারতের সংবিধানবিরোধী উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের উপর যে অমানবিক নির্যাতন চলছে, শুরু থেকে এরও কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন বর্ষীয়ান নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি।
এনডিটিভির খবর অনুযায়ী ২০১৯ সালের মে মাসের শেষদিকে বিহারের বেগুসরাইতে এক মুসলিম হকারকে গুলি করা হয়৷ সেই ঘটনার উল্লেখ করে টুইট করেছিলেন মুহম্মাদ আসিফ খান নামে এক ব্যক্তি৷ সেই টুইটকে তুলে ধরে বিজেপির কড়া সমালোচনা করেছিলেন আসাদুদ্দিন ওয়াইসি।
এ ব্যাপারে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, বিজেপির আমলে মুসলিমদের মানুষ জ্ঞান করা হচ্ছে না৷ যা খুশি তাই ব্যবহার করা হচ্ছে তাঁদের সাথে৷ যেটা রীতিমত নিন্দনীয়৷ মুসলিম বিক্রেতাকে গুলি করার ঘটনা ঘটেছিলো, কারণ সে একজন মুসলিম৷
চলমান ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত দলীয় কর্মিসভায় বলেছিলেন, নতুন প্রজন্মকে ভারত মাতার জয় স্লোগান শেখানোর সময় এসেছে। এই নির্দেশকেও বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহারাষ্ট্রের লাতুরে একটি দলীয় সভায় হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেছিলেন, ‘আপনি আমার গলায় ছুরি ধরলেও আমি ওই স্লোগান দেব না। ভাগবত সাহেব, আপনি কি করবেন? সংবিধানের কোথায় এটা লেখা নেই যে, সবাইকে ভারত মাতা কি জয় স্লোগান দিতে হবে।’
সঙ্ঘ প্রধানের বিরুদ্ধে তোপ দেগে ওয়াইসি আরও বলেছিলেন, ‘উনি কাকে ভয় দেখাতে চাইছেন? তিনি কখনই তার আদর্শ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না।’ পরবর্তীতে এই প্রতিবাদের জন্য ওয়াইসিকে উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার তোপের মুখে পড়তে হয়। শিবসেনা শীর্ষ নেতা তথা মন্ত্রী রামদাস কদম বলেছিলেন, ‘ওয়াসির পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত। আমি মহারাষ্ট্র সরকারকে বলেছি, ওনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।’
বহুল সমালোচিত তিন তালাক বিলের তীব্র বিরোধিতা করেছেন আসাদুদ্দিন ওয়াইসি।পার্লামেন্টে তিনি বলেছিলেন,যে দেশে সমকামিতা কোনো অপরাধ নয়, সেখানে কীভাবে তিন তালাকের জন্য মুসলিম পুরুষের শাস্তি হতে পারে? খবর বিবিসির।
গোমাংস রাখার অপরাধে এক যুবককে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিজেপির একদল উগ্র নেতাকর্মী। এর বিরুদ্ধে সরব হয়ে এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াসি টুইটারে লেখেন, ‘মুসলিমদের সঙ্গে এই ধরনেরই আচরণ করা হয়। মোদির ভোটাররা এই ভাবেই নজরদারি চালান’।
কাশ্মীর সংকট নিরসনের জন্য ওয়াইসি বলেন, এই সমস্যার সমাধানে বিজেপি ও কংগ্রেসের কাছে ভালো কোনো পলিসি নেই। কাশ্মীর ভারতের জাতীয় ইস্যু। ভারত সরকারকেই কাশ্মীরের বিষয়টি সমাধান করতে হবে।
গত ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেন, সেক্যুলারিজমের ব্যাপারে আর আশ্বস্ত থাকা উচিত হবে না। এখন মুসলমানদের নিজস্ব স্বাধীন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
সম্প্রতি সময়ে বাবরি মসজিদ ইস্যুতে তার জ্বালাময়ী কিছু বক্তব্যকে ঘিরে নতুন করে বিতর্কের জন্ম নিয়েছে ভারতীয় রাজনৈতিক মহলে। মমতা ব্যানার্জী এই মুসলিম নেতাকে বিজেপির পেইড এজেন্ট বলেও কটাক্ষ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিজেপির কাছ থেকে টাকা নেয় আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল সর্বভারতীয় মজলিসে-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন।
সময়ে সময়ে মুসলিমদের অধিকার নিয়ে নির্ভীক এ নেতার বিভিন্ন পদক্ষেপ ভারতীয় মুসলিমদের জন্য ‘মোটিভেশন’ হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও মুসলিম ইস্যুগুলো মিডিয়ার নজরে আসে এবং শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে।
আরএম/