মহিব ফারহান । ।
স্যারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ২০১১ সালে। তখন আমি ঐতিহ্যবাহী দীনি বিদ্যাপীঠ দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসার ৯ শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। প্রথম দিন ৯ম শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাসে আসলেন ৬ ফুটের মত লম্বা সুঠাম হ্যান্ডসাম মানুষটি। মুখভর্তি দাড়ি। পরিচয় দিলেন এভাবে- ‘আমি জয়নুল আবেদীন। নাজাতের খেদমতে আছি। তোমাদের ইংরেজি শেখাতে চেষ্টা করবো।
শুদ্ধ বাংলায় স্যারের মুখে কথা গুলো শুনে তখনই স্যারের প্রতি এক ধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয়ে যায়। স্যারের প্রথম উপদেশ ছিলো, ‘ইংরেজি যেন মুখস্ত বিদ্যা না হয়ে যায় ।’ আগে Easy, paragraph, Application সব মুখস্ত করে ফেলতাম, স্যার বললেন এখন থেকে মুখস্ত বিদ্যা বাদ, শুরু করলেন ভিন্ন পদ্ধতিতে পাঠদান। ছবি এঁকে, ডায়াগ্রাম করে, স্যার Passage বুঝাতেন। আস্তে আস্তে ইংরেজিভীতি কাটতে শুরু করলো আমাদের।
প্রথম দিকে সারের সঙ্গে তেমন মিশতাম না। আমি খুব ভালো ইংরেজি পারতাম না তাই। খেয়াল করলাম স্যার নিজ থেকেই কাছে ডেকে পড়াশোনার খোঁজ নিতেন। যাতে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকি আমরা সেজন্য স্যার একটা কথা প্রায়ই বলতেন - আমার বন্ধু আমার নাকের উপর দিয়া চলে যায়, মানে হলো সে ভালো পড়াশোনা করার কারণে আজ পাইলট, আমি আরো ভালো পড়লে হয়ত...... তাই তোমরা সময়কে কাজে লাগাও।
এভাবে উপদেশ, পরামর্শ দিয়ে বাস্তবতা বুঝাতেন। আমিও আস্তে আস্তে স্যার এর সাথে মিশতে শুরু করলাম, ভালো মন্দ, গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে প্রত্যেকটি কাজ স্যার মূল্যায়ন করতেন। ইংরেজি কম বোঝার কারণে স্যারের কাছে ২ মাস প্রাইভেট পড়ার সুযোগ হয়। তখন জানতে পেরেছিলাম স্যারের কিছু সোনালী স্বপ্ন। স্যার স্বপ্ন দেখতেন একটি দারিদ্রমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার, অপরের কল্যাণে ছিলেন এক মহান নিবেদিত প্রাণ।
আমাদের কম্পিউটার স্যার যখন দুরাগ্যব্যধি ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়েছিলেন, স্যারের চিকিৎসা সেবার যে বড় অর্থের প্রয়োজন হয়েছিলো তার সিংহভাগ কালেকশন করেছিলেন ইংরেজি স্যার। স্যারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা কম্পিউটার স্যারকে আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের মাঝে ফেরত পেয়েছি ।
স্যার নিজেকে যতটা ভালোবাসতেন তার চাইতে বেশি ভালোবাসতেন দারুন নাজাতকে। স্যার ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ, তারপরও আলেমদের প্রতি ওনার শ্রদ্ধা ছিলো সীমাহীন । প্রিন্সিপাল হুজুরের প্রতি সারের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছিলো অনেক, হুজুরের দূরদর্শী চিন্তার কথা স্যার বলতেন সবসময় । একটা কথা বেশী বলতেন - এমন একটা পরিবেশে থেকে যেন আমার মৃত্য হয়।
মাদরাসা ছাত্ররা ইংরেজিতে যাতে পারদর্শী হয় সে আশা স্যারের ছিলো, একবার পরিকল্পনা বললেন আমাদের এখানে তো প্রতি মাসে ' বিকাশ ' বের হচ্ছে। আমরা কি পারিনা একটা ইংরেজি পত্রিকা বের করতে। স্যার নিজ উদ্দোগ্যে কিছু ছাত্রদের নিয়ে বের করলেন "The voice of DSM Boys" পত্রিকাটি কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পর আর্থিক সংকট ও ব্যস্ততায় বন্ধ হয়ে যায় । তবু স্যারের স্বপ্ন ছিলো যেন প্রতিষ্ঠান থেকে একটা ইংরেজি পত্রিকা বের হয়। আমরা যেন সে লক্ষে কাজ করি।
দারুন নাজাত আজ দেশসেরা। এখানে একটা ইংরেজি ডিবেটিং ক্লাব নেই, এটা স্যার আক্ষেপ করে বলতেন। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি, ইংরেজি চর্চা না করলে সারা পৃথিবীতে দীন প্রচার করবে কিভাবে। ডিবেটিং ক্লাস স্যারের ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও তৈরি হয়নি।
এ মাদরাসার সার্বিক উন্নতি অগ্রগতিতে স্যারের ত্যাগ, নিরলস পরিশ্রম অনিস্বীকার্য। মাদরাসা পুকুরে তখন সিঁড়ি ছিলো সনা, ছাত্রদের গোসলের সুবিধার্থে স্যার সিঁড়ি তৈরি করেছিলেন। মাদরাসায় বিনোদনমূলক কোনো ব্যবস্থা ছিলো না, ইংরেজি স্যারের হাত ধরেই ইসলামি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান "রেঁনেসার" অগ্রযাত্রা।
রেঁনেসার আয়োজনে স্যার প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতেন। অনুষ্ঠান পরিচালনায় যাবতীয় কার্যক্রম স্যার নিজেই করতেন । যারা অভিনয় করবে তাদের নির্বাচন করে স্যার অভিনয় শেখাতেন। হাসান ইয়াহইয়া ভাইয়েরা দুর্দান্ত অভিনয় স্যারের কাছেই শিখেছেন । স্যার নিজেও দক্ষ অভিনয়ের কলাকৌশল জানতেন।
যখনই কোনো সমস্যায় পড়তাম স্যারের বাসায় ছুটে যেতাম, স্যার কোনো ধরণের বিরক্ত না হয়ে আরো আগ্রহ নিয়ে সমস্যা সমাধান করে দিতেন। মনে পড়ে একবার রাত ১১ টার দিকে একটা প্রয়োজনে স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম, দরজার সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে আস্তে করে টোকা দিলেন। স্যার আস্তে করে দরজা খুলে বললেন, চুপ! আস্তে! গিন্নী উঠলে বকা দিবে আমাদের ( হাসি)।
তারপর আমরা কথা বলছিলাম হঠাৎ ম্যাম নাস্তা নিয়ে হাজির হলেন, আমরা সবাই অবাক! স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি বিরক্ত হওয়ার ভয়ে চুপি চুপি আলাপ হচ্ছে তাই না? ওরা তো আমারই সন্তানের মতো, ওরা আসলে আমারও ভালো লাগে । এ থেকেই বোঝা যায়, কতটা আপন করে নিয়েছিলেন স্যার ও স্যারের পরিবার!
২০১৯ সালের ১৭ ই এপ্রিল রাত ১১ টার দিকে ফেসবুকের নিউজ ফিডে দেখতে পেলাম দারুন্নাজাত মাদরাসার ইংরেজি স্যার অসুস্থ। সকালে এক বন্ধুর ফোন করে বলল, ইংরেজি স্যার...পুরো কথা শেষ করতে পারল না। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি, প্রিয় স্যার আর পৃথিবীতে নেই।
খবরটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম, বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিলো। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলাম নাজাত কাননে। হাসিমাখা মুখগুলো আজ বেদনায় বিধুর, কষ্ট আর চাপাকান্না কেউ আটকাতে পারছে না।
জোহরের নামাজের পর জানাজার পূর্বমুহূর্তে প্রিন্সিপাল হুজুরের কথায়, ছাত্র শিক্ষকদের কান্নায় যেন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছিল। ভালোবাসার মানুষকে এভাবে হারিয়ে ফেলা কষ্টের, খুব কষ্টের! সকলের একটাই মিনতি ছিলো, আল্লাহ যেন স্যারকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ৩য় বর্ষ।