মোস্তফা ওয়াদুদ
একসময় সমাজে শুধুমাত্র পুরুষের জন্য পরিপূর্ণ মাদরাসা শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। নারীদের জন্য শুধু শৈশবের মক্তব ছিল একমাত্র দীনি শিক্ষার পাঠশালা। কিন্তু সময়ের সাথে নিয়মে এসেছে। বর্তমানে সারাদেশে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের জন্যও গড়ে উঠেছে হাজার হাজার মহিলা মাদরাসা। সম্প্রতি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, দেশে পুরুষ মাদরাসার ‘সংখ্যার’ তুলনায় মহিলা মাদরাসা অনেক বেশি।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে অনেক মহিলা মাদরাসা গড়ে উঠেছে। এসব মাদরাসার মধ্যে, কিছু আছে আবাসিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত আবার কতক মাদরাসা অনাবাসিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। তবে সব মাদরাসায়ই ডে-কেয়ার সিস্টেম চালু রয়েছে। অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের উজ্জল ভবিষ্যতের আশায় সাধ্যানুযায়ী মাদরাসার নিজস্ব সিস্টেমে মেয়েদের পড়িয়ে থাকেন।
তবে দীর্ঘদিন ধরে মহিলা মাদরাসার ব্যবস্থাপনার প্রতি দেশের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম কিছুটা অসন্তুষ প্রকাশ করে আসছেন। নানা অভিযোগে জর্জরিত মহিলা মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে উন্নত ও নিরাপদ শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেসব নিয়েও ভাবছেন তারা।
দেশের অধিকাংশ মহিলা মাদরাসা কওমি শিক্ষাব্যবস্থার নামে চরম অনিয়ম করছেন বলে অভিযোগ করেন কুমিল্লা জেলা কওমি মাদরাসা সংগঠন এর সভাপতি ও কুমিল্লা বটগ্রাম মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা নুরুল হক।
তিনি বলেন, মাদরাসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনরকম রুলস বা নিয়ম-নীতি না থাকায় যে যেভাবে পারছে মহিলা মাদরাসা গড়ে তুলছে এবং সুযোগটি গ্রহণ করে বাণিজ্যিক ফায়দা লুটছে। যা অত্যান্ত দুঃখজনক ও শিক্ষার নামে প্রতারণা।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠানের নামে এধরণের প্রতরণা সুস্পষ্ট গোমরাহী ও কেয়ামাতের আলামাত উল্লেখ করেন মাওলানা নুরুল হক।
এদিকে, মহিলা মাদরাসার দিকে দেশের মুসলিম অভিভাবকগণের ঝোঁককে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আমেনা বেগম দারুল উলুম টাইটেল মাদরাসার মুহতামিম মুফতি সাঈদ আল মামুন।
তিনি বলেন, আগে নারীরা তাদের প্রয়োজনীয় দীন শেখার যথাযথ জায়গা পেত না। বর্তমানে এ সীমাবদ্ধতা কমে এসেছে। এখন নারীরাও তাদের দৈনন্দিন দীন শেখার পাশাপশি আম্মাজান আয়েশা রা. এর সুন্নাতকে বাস্তবায়ন করতে পারছে। তারাও যোগ্যতানুপাতে কুরআন-হাদিস নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পাচ্ছে।
তবে মহিলা মাদরাসার ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ নারী শিক্ষিকা দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। অন্যথায়, মহিলা মাদরাসায় নারী-পুরুষের সমন্বয়ের মাধ্যমে ফেতনা হতে পারে বলে জানান এ মুহতামিম।
তিনি বলেন, “মহিলা মাদরাসা সম্পূর্ণ নারী শিক্ষক দ্বারা পরিচালনা করা দরকার। মূল জিম্মাদার বা পরিচালক হিসেবে একজন মাত্র পুরুষ থাকতে পারেন। বাকি কাজ মাহরামের মাধ্যমে শুধু মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তাদের শিক্ষাদান, দরসের সিস্টেম সবকিছুতে মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সেখানে পুরুষ মহিলার সমন্বয় সাধন ঠিক না। এতে ফেতনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।”
মহিলা মাদরাসায় খাবার টাকা যে পরিমাণ নেয়া হয় সে টাকার পরিমাণ খাবার দেয়া হয় না। এটা সরাসরি খেয়ানাত করা হয়। এরকম বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে মহিলা মাদরাসাগুলো বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিলেন মুফতি সাঈদ আল মামুন।
দেশে শুধু মহিলা মাদরাসার সংখ্যা বাড়ছে এমন নয়, বরং নারীদের সংখ্যাও বাড়ছে। এ কারণে নারী জনসংখ্যার জন্য মহিলা মাদরাসার সংখ্যাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি একটি সুখকর সংবাদ। পাশাপাশি পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ জায়গা সঙ্কটের কারণে গাদাগাদি অবস্থা একটি দুঃখজনক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
সুখকর ও দুঃখজনক দু’টি বিষয় নিয়ে কথা মতামত জানালেন রাজধানীর জামিয়া আরাবিয়া ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা নুরুল আমীন। তিনি মহিলা মাদরাসার গাদাগাদি অবস্থানের পক্ষে নন।
মাওলানা নুরুল আমিন বলেন, দেশে পুরুষ মাদরাসার মতো মেয়েদের দীন শেখার ব্যবস্থা করা গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। ভাড়া বাসায় মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে মাস শেষে ছাত্রীদের বেতনের টাকা দিয়ে মাদরাসা চালালে সেটা দীন নির্ভর থাকে না বরং দুনিয়া নির্ভর হয়ে যায়। তাই দীনের নামে দুনিয়া নির্ভর মাদরাসা করার চেয়ে না করাটা বরং বেশি ভালো।
মহিলা মাদরাসার পর্দারক্ষা ব্যাপারে বিশিষ্ট এই আলেমের পরামর্শ হল, মহিলা মাদরাসার ভবন এমন সিস্টেমে করা দরকার যেখানে পর্দার সাথে পর্যাপ্ত বাতাসের ব্যবস্থা থাকে। ভবনের চারপাশে বারান্দার পরিধি লম্বা রেখে উপরে বাতাস আসা-যাওয়ার জায়গা রাখা যেতে পারে। যাতে ভবনের চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেও বাতাস গমনে কোনো বাঁধার সম্মুখিন না হতে হয়। এতে মহিলাদের শারীরিক কষ্টের লাঘব হবে। আবার পর্দাও বজায় থাকবে।
“এদিকে, মহিলা মাদরাসার ব্যবস্থাপনাগত সমস্যার কারণেই আমরা অপ্রীতিকর বক্তব্য শুনে থাকি। যা অত্যান্ত আফসোস ও দূর্ভাগ্যজনক বিষয়। হাদিসের ভাষায়, নারীদের কণ্ঠও পর্দার অন্তর্ভূক্ত। এ বিষয়টি যেনো মহিলা মাদরাসার উস্তাদগণ ভুলতে বসেছেন। পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া অন্য কথা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা জরুরি। আর এর সবচেয়ে উত্তম সলিউশন হলো, মহিলা মাদরাসায় নারী শিক্ষিক দ্বারা পাঠদান করানো। পুরুষ শিক্ষককে শুধু জিম্মাদার হিসেবে রাখা। পুরুষ শিক্ষক দিয়ে পাঠদান না করানো।” যোগ করেন মাওলানা নুরুল আমিন।
-এএ