শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


আল মাহমুদ : একজন বিশ্বাসী কবির আখ্যান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রিদওয়ান হাসান: আল মাহমুদকে বলা হয় একজন ‘বিশ্বাসী কবি’। এই বিশেষণটা বিশ্বাসী মানুষরা যতটা ব্যবহার করেছে, তারচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে অবিশ্বাসীরা। বিশ্বাসী মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন একজন আপাদমস্তক কবি। বাংলা কবিতার অনিবার্য স্তম্ভ কিংবা আধুনিক কবিতার প্রবাদপুরুষ। কিন্তু অবিশ্বাসী বা বামদের কাছে তিনি ছিলেন একজন ডানপন্থী ও বিশ্বাসী কবি। বামরা এই বিশেষণের বিশ্লেষণে একটা সাম্প্রদায়িক অর্থ করে—তাদের মতে শুরুর দিকের আল মাহমুদকে গ্রহণ করা যায়।

অর্থাৎ তারা বলতে চান, শুরুর সময় আল মাহমুদ একজন কমিউনিস্ট বা বাম ছিলেন, এটা প্রমাণ করার জন্যই বামদের এ মতবাদ। আর এ শুরুর দিককার সময়টা বামরা ডেটলাইন করে থাকে তার সোনালী কাবিনের প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। তাদের মতে, সোনালী কাবিনের আল মাহমুদকে নেয়া যায়, তারপরে তাকে আর গ্রহণ করা যায় না। তার মৃত্যুর পরেও অনেক পত্রিকায় দেখা গেছে—সোনালী কাবিনের আল মাহমুদ আর নেই।

বামরা আল মাহমুদকে প্রথমত কমিউনিস্ট প্রমাণ করেছে। সোনালী কাবিনের পর আল মাহমুদকে বিশ্বাসী কবি বলে তার একটা ধর্মীয় অবতারের মূর্তপ্রতীক দাঁড় করিয়েছে। আর আমরাও বামদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আল মাহমুদকে বিশ্বাসী কবি এবং শুরুর সময় তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, পরে ধার্মিক হয়েছেন বলে থাকি। অথচ আল মাহমুদ শুরু থেকেই বংশগতভাবেই মুসলমান ছিলেন। তার পারিবারিক ঐতিহ্যেই গাঁথা ছিল মুসলমানিত্ব। তিনি একথা বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।

বামদের মতে, আল মাহমুদ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্ম বা এক বিশেষ ইসলামি দলকে বেছে নিয়েছে তার কবিতা-গল্প-উপন্যাসের প্রতিপাদ্য হিসেবে।যদিও স্থুলভাবে ধর্মপ্রচারের মাধ্যম গল্প-উপন্যাস নয়, গল্প-উপন্যাসকে হতে হয় কিছুটা সর্বজনীন। বলা হয়ে থাকে, এ ধর্মপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার কারণে কবি আল মাহমুদ সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আসলেই কি আল মাহমুদ সে রকমভাবে ধর্মকে টানতেন?

তার যেসব গদ্য সাহিত্য পড়েছি, তাতে ধর্মেরউপস্থিতি ততটা প্রকট ছিল না। তার ‘সোনালী কাবিন’ নিয়ে হুমায়ুন আজাদ সমালোচনা করেছিলেন এই বলে যে, কাবিন হচ্ছে দাসত্বের ফাঁদ আর আল মাহমুদ তাকেই মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন! হুমায়ুন আজাদ কবিতা সংকলন করেছিলেন, সেখানে আল মাহমুদের কবিতা স্থান পায়নি।

কারণ হিসেবে তিনি তার এই সাম্প্রদায়িকতাকেই দায়ী করেছেন। অথচ আমার কাছে সাম্প্রদায়িকতা একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত বিধিসম্মত মনে হয়। প্রত্যেকটা মানুষই সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা। নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি তার সামান্য হলেও সেন্সরিটি থাকবে। কিন্তু এর বাইরে অন্য সম্প্রদায়কেও সমীহ করবে—এটাই বিধিসম্মতার প্রান্তসীমা। যখন অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি গণহারে নেতিবাদিচর্চায় যাবে, সেটাই প্রকৃত সাম্প্রদায়িকতা।

হুমায়ুন আজাদ খুবই চালাকির পরিচয় দিয়েছে এখানে। কবি আহমদ মাযহার বলেছেন, আমার স্মৃতি যদি ভ্রষ্ট না হয়ে থাকে। তাহলে আমি হুমায়ুন আজাদের কাব্য সংকলনের কাজটা করে আসছি সেই শুরু থেকে। আমাকে আল মাহমুদের কবিতা নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সেই মর্মে আমি কবিতা আনতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু আল মাহমুদ এই সংকলনের কবিতা দিতে অস্বীকৃতি জানান। অথচ হুমায়ুন আজাদ চালাকি করে তার কাব্য সংকলনের ভূমিকায় আল মাহমুদ ও আব্দুল মান্নান সৈয়দের কবিতাকে স্থান না দেয়ার পেছনে কারণ হিসেবে সাম্প্রদায়িকতাকেই দায়ী করেছেন। ব্যাপারটা কতটা হাস্যকর, তা আর খোলতাই করতে হবে না বোধহয়।

প্রকৃতপ্রস্তাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটি আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতিবাচক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আদতে সব মানুষই সাম্প্রদায়িক। কারণ, নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষপাতিত্ব সব মানুষের ভেতরেই থাকে। এটা দোষের কিছু নয়। তবে অন্য সম্প্রদায়কে হেয় করা, তাদের ন্যায্য অধিকারকে হরণ করা, নিজ সম্প্রদায়ের বিশ্বাস-আচার-নিয়ম অন্য সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়াই নিন্দনীয়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মীয় স্বাধীনতা পাবে মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই অন্য ধর্মের দেবদেবীকে কটুক্তি করতেও নিষেধ করে গেছেন। এটাই হলো পরমতসহিষ্ণুতা। এটাই যৌক্তিক আচরণ। আর এটাকেই অসাম্প্রদায়িকতা বলা হয়।

অথচ আমাদের সমাজ ধর্মীয় বিশ্বাসসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই সাম্প্রদায়িক চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এটা অযৌক্তিক। রবি ঠাকুর, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র সবাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষপাতিত্ব করেছেন। কারণ, নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের মমত্ব ছিল, বরং আমাদের মুসলমান কবি সাহিত্যিকদেরই নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল কম। কিছু ক্ষেত্রে তো আত্মবিধ্বংসীও দেখা যায়। এদের মধ্যে যারা পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন, তারাই সাম্প্রদায়িক অভিধা পেয়েছেন। এমনকি আহমদ ছফা, আল মাহমুদ, ফররুখ আহমদও। অথচ এক বঙ্কিম ছাড়া রবি ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র কাউকেই সাম্প্রদায়িক বলতে শুনি না।

অথচ দেখেন, এখন যদি রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিস্নানে শূচি হোক ধরা’কে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বলি, সেক্যুলাররা তেঁতিয়ে উঠবেন। কিন্তু যখন তাদের বলা হবে, উযুর পানিতে শূচি হোক ধরা—তখন তারা বলবে এটা সাম্প্রদায়িক। এখানে ‘উযুর পানি’ যদি নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হয়ে থাকে, তাহলে ‘অগ্নিস্নান’ কিভাবে সর্বজনীন হলো?

এই কথার প্রেক্ষিতে একবার আমাকে একজন বামপন্থী সেক্যুলার বলেছিল—রবীন্দ্রনাথে মানুষের নানা কারণেই অরুচি থাকতে পারে, সেটাকে পুঁজি করে তাকে সামগ্রিক বিচার করাটা ঠিক নয়। আর আরেকটি কথা, যদি সেক্যুলার না হতে পারেন তাহলে মানবিক মানুষও হওয়া প্রায় অসম্ভব। এমনকি একজন সত্যনিষ্ঠ মুসলমান হতে গেলেও এখন সেক্যুলার হওয়াটা এখন সময়ের দাবি।

তাকে উত্তরে যা বলেছিলাম, তা এখন প্রায় বিস্মৃত। যদ্দুর মনে পড়ে, আমি বলেছিলাম—অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা কথাটির মধ্যে আমি রবীন্দ্রনাথে কোনো অনাগ্রহ বা অরুচির কিছু পাইনি। কারণ, প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা। রবীন্দ্রনাথও সম্প্রদায় থেকে এসেছেন, সে অর্থে তিনিও একজন ‘সাম্প্রদায়িক’। হয়ত এই কারণেই তার নিজস্ব ধর্মের আদলে অগ্নিস্নানে ধরাকে শূচি করতে চেয়েছেন। এতে আমি মন্দ কিছুই পাইনি। কিন্তু আমি একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী হিসেবে আমিও উযুর পানিতে পৃথিবী শুদ্ধ করতে চাইব—এটাই আমার ধর্মীয় আবেদন। আর ‘মানবিক’ আবেদন তো কেবল পৃথিবী শুদ্ধ করা। তাই আদতে মানবীয় ও ধর্মীয় অনুভবে কোনো ব্যবধান নাই, ব্যবধান শুধু পদ্ধতিগত।

যাই হোক, সত্যনিষ্ঠ মুসলমান হওয়ার জন্য সেক্যুলার হতে হবে, এটা ভুল কথা। সেক্যুলারের জন্ম ইতিহাস বলে, যার সাথে কোনো ধর্মীয় অনুভবের সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু এ সংজ্ঞা তখন অতটাও ধোপে টেকেনি এই কারণে যে, আপনি যেই দল ও মতই প্রকাশ করছেন—তা পৃথিবীর প্রায় পাঁচ হাজার ধর্মের কোনো না কোনো ধর্মের সাথে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে মিলেই যাচ্ছে। তাই ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রগত কোনো চিন্তাই ধর্মাতীত নয়।

এ কারণে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা সেক্যুলারের অর্থগ্রহণ করেছে—যার যার ধর্ম পালনে নিজ নিজ স্বাধীনতা। এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের অগ্নিস্নানে ধরাকে শূচি করতে চাওয়াটা তার নিজস্ব ধর্মের ব্যানারেই কেবল মানানসই। কিন্তু এটা যখন সেক্যুলাররা একটি রাষ্ট্রের সকলকে মানতে বাধ্য করেন, তখনই সেক্যুলাররা তাদের নাড়িপরিচয় থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এখন এই বিবাদে জড়িয়ে পড়াটা কতটুকু মানবিক? যেখানে মানবিক আবেদন ছিল শুধুপৃথিবীকে শুদ্ধ করা!

আসলে সবসময় আমাদের বিবাদটা হয় পদ্ধতি ও আদর্শ নিয়ে। থাকুক না যে যার আদর্শ নিয়ে। কেন নিজের আদর্শ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চাওয়া, এটা তো সেক্যুলারের ভীত নয়। তাই নিজ আদর্শে চলার অর্থই কিন্তু প্রচলিত সাম্প্রদায়িকতা নয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি শুধু ইসলামপ্রীতির সমার্থক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। হয়ত কিছুদিন পর সাম্প্রদায়িকতার অর্থ লেখা হবে এমন—ইসলামপ্রিয়তা, ডানপন্থী মনোভাব যার। সে অর্থে আল মাহমুদ একজন সাম্প্রদায়িক, একজন বিশ্বাসী। কারণ তার শেকড় আছে। শেকড়ের প্রতি মমত্ববোধ আছে।

অসাম্প্রদায়িকতার নামে শেকড়ভোলা মানুষ এককথায় পরগাছা। একেক বৃক্ষে একেক রূপে দেখা দেয়। এদের কোনো নাড়িপরিচয় নেই। এরা অন্যের পাকা ধানে কেবল মই দিতেই জানে। এজন্যই বলি, অমন অসাম্প্রদায়িক কবি লেখকদের চেয়ে সাম্প্রদায়িক কবি লেখকরাই শ্রেয়। অন্তত এদের একটি নাড়িপরিচয় আছে, নাড়ির প্রতি টান আছে। আর অসাম্প্রদায়িকদের আছে স্রেফ নারীর প্রতি টান। নারীকে খুলে প্রকাশ করার মধ্যেই যেন এদের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। অথচ আল মাহমুদও লিখেছেন, কবিতা হলো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।- মাসিক আঙিনায় প্রকাশিত

লেখক : ক্রিটিক ও প্রাবন্ধিক 

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ