সম্মিলিত কওমি মদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়াহ বাংলাদেশ’-এর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে দাওরায়ে হাদিসের আরো একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা। অংশগ্রহণ করেছে প্রায় ২৬ হাজার পরিক্ষার্থী। নতুন বছরে কেউ পড়বেন তাখাসসুস, আবার কেউ খুঁজবেন কর্মসংস্থান।
তবে সরকারি সনদপ্রাপ্তির পর নতুন কোন কর্মসংস্থানের দুয়ার এখনো সেভাবে উন্মুক্ত হয়নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত দারুল আরকাম মাদরাসায় গেল দুই বছর বেশ কিছু কওমি তরুণের অস্থায়ী চাকরি হয়েছে।
কওমি পড়ুয়া তরুণ আলেমদের কর্মসংস্থান নিয়ে আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্তে সময় দিয়েছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ পরিচালক, তেজগাঁও রেলওয়ে মাদরাসা’র শাইখুল হাদিস ও আল্লামা শাহ আহমাদ শফী’র খলিফা ড.মাওলানা মুশতাক আহমদ। সাক্ষাৎকারে তার সঙ্গে ছিলেন- বিশেষ প্রতিবেদক সুফিয়ান ফারাবী।
আওয়ার ইসলাম: কওমি পড়ুয়া তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থধান কেমন হওয়া উচিৎ?
ড. মুশতাক আহমাদ: আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ পাকের অসংখ্যা শুকরিয়া আদায় করছি, যে তিনি এ দেশের বুকে হাজার হাজার আলেম দিয়েছেন। আমাদের মুরুব্বিদের মেহনতের ফলে আজ আগের তুলনায় আমাদের দেশে আলেমের সংখ্যা অনেক বেশি। দিনের খাদেমদের জামাত বড় হয়েছে। এটা আমাদের জন্য সুখের খবর।
তবে এ কথাও মানতে হচ্ছে, আমরা যেভাবে আলেম বাড়ানোর চেষ্টা করেছি, ইলমের মেহনতে কাজ করেছি, সেভাবে তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। বিষয়টি এরকম- আমরা শুধু ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দিলাম, দীনের লাইনে, মানবতার লাইনে, ইনসানিয়াতের লাইনে। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র খুব বেশি তৈরি করা হয়নি।
শুধু দরস ও তাদরিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। অথচ বিষয়টি ব্যাপকভাবে চিন্তা করার দরকার। দরস ও তাদরিসের পরিপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা মেটানোর পর অন্যান্য কর্মক্ষেত্রকেও গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি। তাই আবারো বলবো- বিষয়টির ব্যাপকভাবে চিন্তা করা দরকার।
আওয়ার ইসলাম: দরস ও তাদরিস ছাড়া আর কোন কোন পেশা কওমি ছাত্রদের জন্য শোভনীয় বলে মনে করছেন?
ড. মুশতাক আহমাদ: আম্বিয়ায়ে কেরাম দিনের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকতেন আয়ের জন্য। যেমন হজরত নূহ আ. কাঠের কাজ করতেন, হজরত দাউদ আ. লোহার মাধ্যমে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতেন। যেটাকে আমরা বর্তমানে কামারের কাজ বলে থাকি।
আম্বিয়া কেরাম কখনোই দিনের কাজের বিনিময় গ্রহণ করতেন না। তারা এ বিষয়টা অপছন্দ করতেন। বলতেন- “লা আসআলুকুম মিন আজরিন। ইন আজরিয়া ইল্লা আলাল্লাহ । সুতরাং দিনের কাজ কখনোই আয়-রোজগারের মাধ্যম নয়। এটা শধু দীনের তা’লিম ও তারবিয়তের জন্য।
সাহাবায়ে কেরামও নানান পেশায় যুক্ত ছিলেন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা. কাপড়ের ব্যবসা করতেন, হজরত ওমর ফারুক রা. পশু চড়াতেন, হজরত উসমান রা. বড় ধরণের ব্যবসা করতেন, হজরত আলী রা. পরিশ্রম করে আয় রোজগারের ব্যবস্থা করতেন।
সুতরাং আমরা যেকোন হালাল পেশায় যুক্ত হতে পারি। সেটা ছোট হোক বা বড় হোক। আরেকটা বিষয় হলো কাজ কখনো ছোট হয় না। মনযোগ দিয়ে কাজ করলে সকল কাজই একসময় গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটা সময় পশু প্রতিপালনকে ছোট করে দেখা হতো।
এখন এটা শব্দের পরিবর্তন হয়ে খামারে রূপ নিয়েছে। তাই সবাই এখন এটাকে সম্মানের সাথে দেখে। এরকমভাবে প্রতিটি কাজই যখন ভালোভাবে করা হয় তখন সেটার মূল্য অনেক বেড়ে যায়। সম্মানজনক পেশা হয়ে উঠে।
তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো- বিভিন্ন পেশায় জড়াতে গিয়ে নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে যাওয়া যাবে না। আমাদের মাকসাদ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা জরুরি।
সুতরাং কওমি তরুণদের বলবো চাকরির প্রতি আগ্রহী না হয়ে নিজে কিছু করার মানসিকতা তৈরি করুন। মনে রাখবেন- চাকরি করলে দীনের কাজে ব্যত্যয় ঘটতে পারে। চাকরি হলো গোলামির জীবন। তাই নিজে উদ্যোগী হওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন। আলেম উদ্যোক্তা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করছি।
আওয়ার ইসলাম: সরকারি চাকরিতে প্রবেশে কওমি তরুণদের আইনি কোন বাঁধা আছে কিনা?
ড. মুশতাক আহমাদ: আমাদের দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সরকার পার্লামেন্টের মাধ্যমে মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি দিয়েছে। এ জন্য আমি বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাবো।
যেহেতু আইনগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমানের সার্টিফিকেট, তাই অন্যন্য ভার্সিটির মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের সমমর্যাদা তারা পাবে।
তবে একটা বিষয় চিন্তা করবেন, কেউ কাউকে জায়গা করে দেয় না। নিজের অবস্থান নিজেরই তৈরি করে নিতে হয়। নিজেদের দাবিগুলো নিজেদেরই আদায় করে নিতে হয়। বিশেষ করে যেসকল ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অভাব থাকে, সেসকল ক্ষেত্রে তো কেউ কাউকে ছাড় দিতে চাইবে না। সবাই সামনে যেতে চায়।
এজন্য বলবো- যেহেতু আইন আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছে, তাই আমাদের অধিকার আদায়ে আমাদেরই চেষ্টা করে যেতে হবে। প্রয়োজনে আন্দোলন করতে হবে, দেন দরবার করতে হবে, নানামহলের সুপারিশ আনতে হবে। তারপর নিজেদের দাবি আদায় সম্ভব হবে। ঘরে বসে থেকে এসব দাবি আদায় করা সম্ভব হয় না।
আওয়ার ইসলাম: প্রশাসনিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে আল-হাইয়ার ভূমিকা দরকার কিনা?
ড. মুশতাক আহমাদ: সন্তানকে কাজ শেখানোর পর তাকে কর্মসংস্থানে ঢুকিয়ে দিতে পারাই হলো আদর্শ বাবার দায়িত্ব। তখন পরিপূর্ণ দায়িত্বটা আদায় হয়। তা না হলে বিষয়টি অপরিপূর্ণ থেকে যায়। আমাদরে যারা মুরুব্বি আছেন, তাদের শুকরিয়া আদায় করবো।
তারা আমাদের জন্য বহু কষ্ট করেছেন। দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত বানিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থের জোগান দিয়ে মাদরাসা পরিচালনা করেছেন।
এতে বুঝা যায় তাদের মনে ছাত্রদের জন্য ভালোবাসা আছে। এখন তারা যদি একটু সু-নজর দেন- আমাদের সন্তানদের সম্মানজনক কর্মসংস্থান ঠিক করা দরকার, তাহলে তারা সেটা পারবে। সকলের একটু প্রচেষ্টা দরকার। তাহলে বিভিন্ন দুয়ার খুলে যাবে।
আমি আমার এ সাক্ষাৎকারে শীর্ষ আলেমদের প্রতি আহ্বান জানাবো- আপনারা একটু চিন্তা করলে হাজরো কওমি সন্তানের সু-ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আপনাদের ভালোবাসায় কোনরূপ স্বার্থ নেই। আপনারা কওমি ছাত্রদের সন্তানের মতো ভালোবাসেন।
আওয়ার ইসলাম: দরস তাদরিস ছাড়া এধরণের কর্মে সংযুক্ত হলে কোন লাভ বা ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কিনা?
ড. মুশতাক আহমাদ: নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে সচেতনতার সাথে চলতে পারলে সুখকর হয়ে উঠবে। আগেই বলেছি আত্মপরিচয় ভুলে গেলে চলবে না। ভুলে গেলে তো আমাদের মূল মাকসাদই নষ্ট হয়ে গেল। এ বিষয়টি মাথায় রেখে যেকোন পেশাই বেঁছে নিতে পারেন জাতির তরুণ দায়িত্বশীলগণ।
আওয়ার ইসলাম: খুব শিগগির সার্টিফিকেটের যথাযথ মূল্যায়ন শুরু হবে বলে মনে করছেন কি?
ড. মুশতাক আহমাদ: আমাদের মুরুব্বি আলেমগণ বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করলে, সঠিক পদ্ধতিতে এগুলো আশা করা যায় কওমি তরুণ আলেমরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পাবে। আমার বিশ্বাস তারা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। এবং কৃতকার্য হবেন।
আওয়ার ইসলাম: আমাদের মূল্যবান সময় দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড. মুশতাক আহমাদ: সময় উপযোগি একটি বিষয় উপস্থাপনের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
-এটি