তানভীর সিরাজ
ইসলাম স্বীকৃত আনন্দ বা খুশি প্রকাশ করা ঈদের একটি আদাব। তাই পরিবারবর্গ, আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের সামনে ঈদের খুশি প্রকাশ করা ঈদ কেন্দ্রিক সুন্নত। ইসলামে সবকিছুর একটা সীমা, প্রান্তসীমা কিংবা সীমারেখা আছে। যে সীমা বা প্রান্তে থেকেই আমাকে আপনাকে ইসলামের সৌন্দর্য্য ও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে হবে, পালন করতে হবে তার হুকুম, আদায় করতে হবে তার আদেশ আর দূরে থাকতে হবে তার নিষেধ থেকে। এই আনন্দঘেরা সময়, যাকে ঈদুল ফিতর বলে।
যে ঈদ ও আনন্দের বিষয়ে রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও আনন্দ প্রকাশ করতে বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। যেখানে মদিনাবাসীরা খেলাধুলায় মেতে উঠত। সেদিন তিনি - জানতে চেয়েছেন, ‘তোমাদের কাছে এ দুই দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগ থেকে আমরা এ দুই দিনে উৎসব করে আসছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বললেন, "আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুইদিনের পরিবর্তে আরও উত্তম কিছু দান করেছেন: ঈদুল আযাহা ও ঈদুল ফিতর।" [সূনান আবু দাউদঃ১১৩৪; সুনানে নাসায়ীঃ১৫৫৬]
ঈদের দিনে বিশেষ কিছু কাজ রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করা হলো, সাদকাতুল ফিতর: যার কাছে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা তার সমপরিমাণ সম্পদ থাকবে তার জন্য সাদকাতুল ফিতর (ফিতরা) দেয়া ওয়াজিব। চলতি বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বলেছে, তার পরিমাণ ৭০ টাকা আর জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর রায় হল ৭৫ টাকা।
সাদকাতু ফিতর বা ফিতরা দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হল অনাথ, অসহায়দের সহায়তা দান। সুতরাং যে পদ্ধতিতে তাদের সুবিধা বা তারা লাভবান হয় সে পদ্ধতিতে সাদকাতু ফিতর আদায় করা শরিয়তের দাবি। তাই কেউ যদি টাকা দেয়াকে তাদের জন্য ভালো মনে করেন তাহলে অবশ্য সেটিই উত্তম। আবার অঞ্চলভেদে কেউ যদি আটা, খেজুর আর যব ইত্যাদি দিয়ে আদায় করতে চান তাহলে অঞ্চল হিসাবে তাও বেশ ভালো সিদ্ধান্ত।
যাদের যাকাত দেয়া যাবে, তাদের ফিতরাও দেয়া যাবে। ঈদের দিন ঈদগাহে যাবার আগে দেয়ার কথা কিতাবে আছে ঠিক, তবে অনাথ, অসহায়দের অবস্থা বুঝে দু'একদিন আগেও দেয়া যাবে।
হযরত নাফে রা. বলেন, হযরত ইবনে ওমর রা. ছোট-বড় সবার ফিতরা দিতেন। এমনকি আমার ছেলেদের ফিতরাও তিনি দিতেন। তিনি তাদেরকেই ফিতরা দিতেন, যারা তা গ্রহণ করতো। (বোখারি শরিফ, হাদিস-৯৯৯)।
তাহলে বাবা তার নাবালেক বালবাচ্চার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে পারেন। আকেল বালেগ, বিত্তবান আত্মীয় অনাত্মীয় কারোর পক্ষ থেকে কেউ ফিতরা দিতে চাইলে অবশ্য তাকে জানিয়ে, তার সম্মতির ভিত্তিতে আদায় করতে হবে, অন্যতাই এ ফিতরা আদায় হবে না।
ফিদিয়া: ফিদিয়া আর ফিতরার পরিমাণ এক হলেও পরিভাষার দিক দিয়ে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফিদিয়া আদায় করতে হয় রোজা রাখতে অপারগ হলে। মৃত ব্যক্তির, আবার কেউ এমন বার্ধক্যে উপনিত হলেন, তার পক্ষে রোজা রাখা অসম্ভব হলে রোজার ফিদিয়া আদায় করা। তবে কেউ অসুস্থ, কিন্তু এখনো সুস্থ হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে, কিংবা রোজা রাখলে শুকিয়ে বা দুর্বল হয়ে যাবে এমন ভ্রান্ত ধারণার কারণে রোজা রাখেনি, অথবা হায়েয-নেফাসের কারণে রোজা রাখতে পারেনি, এদের পক্ষ থেকে ফিদিয়া আদায় করলেও আদায় হবে না, বরং শরিয়তী অপারগতা পাওয়া আবশ্যক। একটা সময় তারা সুস্থ হবেন, পরে রোজা রেখে দিবেন।
এক রোজার ফিদিয়া এক ফিতরা সমান আর একজনের ফিতরা এক রোজার সমান। প্রচলিত ৭০/৭৫ টাকা।
ঈদের দিন রোজা: জামহুর আলিমদের মতে ৫টি দিনে রোজা রাখা হারাম, ঈদুল ফিতরে, ঈদুল আযাহায়, আয়্যামুশ তাশরিকে (কুরবানির পরে ৩দিন)।
ঈদের দিনে করণীয়:
১. জামাতের সাথে এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করা, যাতে সারারাত ইবাদতের নেকি পাওয়া যায়। এ দুই ঈদের রাতকে ইবাদত- বন্দেগি করে যে ব্যক্তি জীবিত রাখবে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাকেও জীবিত রাখবেন। তাই ঈদের রাতের মাগরিব, এশা আর ফজর যদি জামাতের সাথে আদায় করা হয় তাহলে সেই রাতকে জীবিত রাখার মতই হবে। তা সুন্নত।
২. মিসওয়াকসহ সকাল সকাল গোসল করা। সাধ্যমত ভালো বস্তু ব্যবহার করে গোসল করা। বিশেষভাবে হালাল খুশবো সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করা। যাতে শরীর থেকে সুঘ্রাণ আসে। মানুষ আর ফেরেশতাসকল যেন কষ্ট না পায়। তা সুন্নত।
৩. শরীয়তের গণ্ডিতে থেকে তাওফিক অনুযায়ী ভালো পরিষ্কার কাপড় পরিধান করা। সুসজ্জিত হয়ে ঈদের খুশি প্রকাশ করা। ৪. আতর: আতর, খুশবো ইত্যাদি ব্যবহার করা। হাদিসে খুশবো ব্যবহারের বেশ তাকীদ এসেছে। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এলকোহল যেন এতো বেশি না থাকে, যার ব্যবহার হারামের পর্যায়ে চলে যায়।
৫, ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া। ঈদুল আযহাতে কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব, তবে খেয়াল রাখতে হবে। ৬. ঈদুল ফিতর বা রমাজানের ঈদে ছোট আওয়াজে তাকবীর বলা আর ঈদুল আযাহা বা কুরবানির ঈদে বড় আওয়াজে তাকবীর বলে বলে যাওয়া। তবে আওয়াজ এত বড় যেন না হয়, যাতে পাশের জনের কষ্ট হয়।
৭. ঈদগাহে যাওয়ার সময় একরাস্তা দিয়ে যাওয়া আর আসতে আরেক রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। তা মুস্তাহাব বা সুন্নতে যায়েদাহ। ৮. ঈদগাহে যাবে পায়ে হেঁটে। তবে তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে অন্যভাবেও যাওয়া যাবে।
৯, নামাজে যাওয়া। সূর্য উদিত হয়েই সাথে সাথে ঈদের নামাজ পড়ে ফেলা ভালো। আর না পারলে বেশি দেরি না করা ভালো। যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি পড়ার চেষ্টা করা ভালো। যাতে যোহর বা জুমার নামাজে সমস্যা না হয়। ১০. ঈদের নামাজের পূর্বে ফিতরা আদায় করা।
ঈদের দিনে বর্জণীয়: ১. ঈদের দিনে রোজা রাখা। ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম।
হাদি নিষেধ করা হয়েছে। আবু হুরাইরা র. থেকে (মারফুয়ান) একটি হাদিস আছে। তাকে দুইদিন রোজা রাখা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এক: রমজানের ঈদ, দুই: কুরবানির ঈদের দিন। (বুখারী, মুসলিম)
২. বিজাতীয় সংস্কৃতিতে ঈদ উদযাপন করা। যেমন, নাচ-গান, নানাধরণের ফৌকফেস্টিভাল করা ইত্যাদি বড় গোনাহের কাজ।
৩. যেখানে সেখানে যত্রতত্র অবাধ মেলামেশা করা না করা। ঘুরাঘরির ক্ষেত্রে শরিয়তি পর্দার খেলাফ যেন না হয় সেদিকে সজাগদৃষ্টি রাখা।
৪. ঈদের আনন্দে আমরা অনেকে নামাজ বাদ দিয়ে দেই, এটা মস্তবড় মূর্খতা। যে আল্লাহ্ আনন্দ দান করেছেন আমরা সে আল্লাহ্কেই ভুলে গেলাম! বিশেষভাবে কুরবানির ঈদে জোহরের নামাজের বেলায় নামাজী-বেনামাজীর মাঝে ফারাকটা কমে যায়!
-এএ