আদিল মাহমুদ
‘মাবুদ/ বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিলে/ প্রেমের আনকাবুত। জড়িয়ে গেছে জয়িফ হৃদয়/ আনকাবুতের জালে/ এই বিরহের কালে।’ (কাসিদায়ে আনকাবুত)
এই কবিতাটা তানভীর এনায়েতের প্রথম কবিতার বই ‘কাসিদায়ে আফরিঁ’ থেকে নেয়া। বইমেলা থেকে ‘কাসিদায়ে আফরিঁ’ বইটা কিনে বৃহস্পতিবার রাতে যখন পড়া শুরু করি, তখন একটা ঘোর ও মোহ কাজ করছিল আমার ভিতরে। এক বসায় বইটা পড়া শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু আমি এই শেষ হওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এরকম বই শেষ হবে কেন? এই রকম বই শেষ হওয়াটা তো মেনে নেয়া যায় না!
তারপর থেকে প্রতিদিন আমি নিয়ম করে বইটা পড়ছি। আর রিভিউ লিখবো, লিখবো ভাবছি। কিন্তু লেখা হচ্ছে না। যদিও বই পড়া যতটা সহজ, তার থেকেও সহজ রিভিউ লেখা। তবে কবিতার ক্ষেত্রে অনেক ব্যতিক্রম। কবিতার বই পড়া অনেক কঠিন, এবং তার চেয়েও কঠিন কবির ভাবের সাথে ভাব মিলানো।
আর কবিতার বইয়ের রিভিউ লেখা, সে তো অসাধ্য কাজ। তাই আর রিভিউ লেখা হচ্ছিলো না। কিন্তু মন তো মানে না, এই অসাধ্য কাজকেও সাধন করতে চায় মন। তাই রিভিউ লিখতে বসা।
তানভীর এনায়েত আপাদমস্তক শুধুই একজন কবির নাম। প্রেমের কবি। দ্রোহের কবি। মানবতার কবি। সূফিবাদী কবি। এক নতুন উজ্জ্বল তারকা-বুদ্ধিবৃত্তিক, উদ্ভাবনী এবং অসম্ভব প্রতিভাবান একজন কবির নাম তানভীর এনায়েত। প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্য, সবকিছু নিয়েই তিনি কবিতা লিখেছেন। আর প্রেম, মানবিকতা ও দ্রোহ সূফিবাদ কবিতা নিয়েই তানভীর এনায়েতের ‘কাসিদায়ে আফরিঁ’।
‘কাসিদায়ে আফরিঁ’ পড়তে গিয়ে অনেকবার আটকে গেছি গুটি কয়েক লাইনে। একটা পুরো উপন্যাস বহন করে দুই লাইনের একটা ছন্দ বা একটি কবিতা।
এমন ক’টি কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদেরকে— (কসমের স্লোগান) ‘একশো একটা ফুলের কসম/ তুমি অসম তুমি অসম।’ (অন্যতম শূন্যতা) ‘অনেক পাঠের পরও আমার পাঠ করা আর হয়নি তোকে/ অনেক দেখার পরেও আমার হয়নি দেখা অরণ্যকে।’ (হ্রস্ব দীর্ঘশ্বাস)
‘কিছু কিছু ছবি ফ্রেমের বাইরে থাকে/ কিছু কিছু প্রেমিকা প্রেমের বাইরে থাকে।’ (অবতরণ) ‘সূর্যের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসো প্রিয়া/ রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে গিয়াছি ভিজিয়া।’ (বৈপরীত্য) ‘আমার শরীরে হাঁটে বুড়ো তেলাপোকা/ তোমার শরীরে জাগে জোনাকির থোকা।’ (কাবারণ) ‘তোমার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে/ আমি থাকতে রাজি আছি তেত্রিশ বছর জেলে।’ (ধর্মের অহম) ‘তুমি কাফের আমি মোমিন/ এই মনোভাব সবচে কমিন।’
'কাসিদায়ে আফরিঁ’তে কবি কবিতার ক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। নতুন স্বাদ ও রুচি সৃষ্টি করেছেন। ‘কাসিদায়ে আফরিঁ’র কবিতাগুলো আমার নিভৃত ব্যক্তিসত্ত্বাকেও নিবিড়ভাবে স্পর্শ করেছে। আমাকে ভাবিয়েছে এবং দুলিয়েছে। কবির ‘গন্ধবিধুর ধূপিকাঠি’ কবিতা আমাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে। আমার হৃদয় কাফের না মুমিন, এই দ্বন্দ্বে। কারণ আমার হৃদয়ে পাপ ও পুণ্য দু’টই বসবাস করে।
এখন আমার হৃদয় কাফের নাকি মুমিন! ‘গন্ধবিধুর ধূপিকাঠি’ কবি তার এক অদ্ভুত অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেছেন— ‘জানে আকাশ না জমিন/ হৃদয় কাফের না মুমিন। পথ পেয়ে ফের হারায় সে পথ দাঁড়ায় থমকে নতুন মোড়/ মন্দ ভালো ঘুরতে থাকে মনের মধ্যে লাগায় ঘোর।’
কবি তার বইয়ে অনেকগুলো কবিতায় নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাসিদা শব্দটা ব্যবহার করেছেন। আমি তো ‘কাসিদায়ে আফরিঁ’ কবিতাটা পড়েই মুগ্ধ। আমার জন্য এতটুকু মুগ্ধতাই যথেষ্ট ছিলো। আর কোন কাসিদার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু নাহ! কবি আমার মুগ্ধতার পরিধী আরো বাড়িয়েছেন। কাসিদায়ে লাইলাহ। কাসিদায়ে আনকাবুত। কাসিদায়ে তাহাজ্জুদ। কাসিদায়ে আগরবাতি। কাসিদায়ে গন্দম। কাসিদায়ে তাবাসসুম। কাসিদায়ে মারেফত। কাসিদায়ে দিওয়ানা ও আরো কতোগুলো চমক আটকে থাকা কাসিদা নামের কবিতা দিয়ে!
'কাসিদায়ে আফরি’ বইটার মাধ্যমে তানভীর এনায়েত কখনো আমাকে আচ্ছন্ন করছেন নিদারুণ মানবিকতায়, কখনো কাতর করেছেন দ্রোহে ও দেশাত্ববোধে, আবার কখনো প্রেমের মায়ায়। তার প্রেমের কবিতা মানেই হচ্ছে মনের মধ্যে উথাল-পাতাল ঢেউ, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে প্রেয়সীর ঠোঁটে চুমু খাওয়া কিংবা মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকা কয়েক ঘন্টা।
কবির এক একটি প্রেমের কবিতা এক একটি আকাঙ্ক্ষার নাম, যে আকাঙ্ক্ষা গোগ্রাসে গিলে খায় একের পর এক অমীয় কবিতার পাতা। কবির ভাবনার জগতে আপনাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেমের কিছু কবিতার কবিতাংশ উল্লেখ করছি— (গোলাপ বিসর্জন) ‘তোমার জন্য কালো গোলাপ লাল গোলাপও তোমার জন্য/ তোমার জন্য সকল গোলাপ গোলাপভর্তি এক অরণ্য।’ (বোতামফুল) তুমি পারো ধরে নিতে আমায়/ একটি বোতাম তোমার সাদা জামায়। (কসমের অর্ঘ্য) ‘এতটুকু প্রেম নিলে দিয়ে দেবো সবটুকু দান/ সাক্ষী রাতের ডাহুক, ভোরের শিশির প্রমাণ/ দিয়ে দেবো তারও বেশি যতটুকু দেয়ার রসম/দিয়ে দেবো খোদার কসম।’
(টান) ‘ভেবেছিলাম ফিরবো না আর/ তবু আমায় ফিরতে হলো আবার একই এই শহরে/ এই নগরের একটি ঘরে।’ (ভালোবাসা দিলাম) ‘ভালোবাসা নিও সাতটি ফুলের অমর/ সাত কৌটায় লুকিয়ে রাখা/ সাতটি জীবন-ভ্রমর।’
‘ধর্মের অহম’ কবিতাটা যখন আমি পড়ি, তখন আমার শরীর শিউরে ওঠে। আমি নিবর-নিস্তব্ধ হয়ে যাই। মনে হলো, দু’লাইনের এই কবিতায় কবি যেন একটা মহাকাব্য কিংবা উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। বর্তমানে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও ভোগবাদ বিশ্বকে অস্থির করে তুলছে। কে মুমিন কে কাফের এই বিবাদে জড়িয়ে আমরা আমাদের আসল পরিচয়, মূল পরিচয়, মানুষ পরিচয়টাকে ভুলে চাচ্ছিলাম।
এমন সময় ‘ধর্মের অহম’ কবিতায় কবি অদ্ভুত রকমের ভাবে আমাদের মানুষ পরিচয়টা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন— ‘তুমি কাফের আমি মোমিন/ এই মনোভাব সবচে কমিন।’
‘কাসিদায়ে আফরিঁ’ বইটার যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক এবং অভিভূত করেছে সেটা হলো, বাংলা কবিতায় আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষার শব্দ ব্যবহার। পুরো বইয়ের বেশ কয়েকটি কবিতাতেই তিনি এই তিন ভাষার শব্দের প্রয়োগ করেছেন অভিনব আঙ্গিকে। যা বাংলা কবিতায় একটা নতুনত্ব নিয়ে এসেছে।
যেমন— (কাসিদায়ে দিওয়ানা) ‘তোমাকে দেখার পর/ অস্ফুটে ঝরে পড়বে লফজ- সুবহানাল্লাহ। এমন শীতল উচ্চারণে/ জিহ্বা ঘুমিয়ে পড়বে এক বেহেশত আদরের আরামে/ অনন্দি আনন্দে মন হবে শারাবান তাহুরায় মাতাল।’ (শায়েবে শরাব) ‘হবার যা ছিলো গিয়েছে হয়ে/ এখন সেরেফ মৃত্যু বাকি/ এখন কী আর করবো হাসিল/ নতুন শরাব নতুন সাকি।’
মোটকথা! তানভীর এনায়েতের ভিন্ন আঙ্গিকের বিচিত্র ভাবনার ‘কাসিদায়ে আফরিঁ’ কাব্যগ্রন্থটা আমার অসাধারণ মনে হয়েছে। ভাষা প্রকাশে তার সাহসিকতা, ভাবনার মৌলিকত্ব এই দশকে তার অবস্থান মূল্যায়নে যথেষ্ট এগিয়ে নিয়ে যাবে এই বইটা।
কবি তানভীর এনায়েতের শুদ্ধ স্বর কতটুকু শুদ্ধতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় তা দেখার প্রতীক্ষায় রইলাম আমি। কবির জন্য পাঠক হিসেবে রইলো একরাশ কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা।
আরআর