মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
লেখক ও মুহাদ্দিস
হৃদয় ও শরীরের সমন্বয়ে মানুষ। শরীরহীন কোন সত্তা যেমন মানুষ নয়, তেমনি হৃদয়হীন কোন দেহও মানুষ নয়। ধর্ম ও সভ্যতার ফয়সালাও এটাই। এ কারণেই ধর্মে যেমন শরীরের ভাল-মন্দ বিচার করা হয়, তেমনি হৃদয় ও আত্মার শুদ্ধি ও শান্তিকেও যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
সভ্যতার প্রভাব নির্মাণ হয় মানুষের মন ও আত্মায়। দেহ-মন, শরীর-আত্মা, বদন ও হৃদয়ের এই সমন্বিত সাধনাই মানব জীবনকে করে তুলে সফল, স্বার্থক ও ফলবান। পক্ষান্তরে এই দুয়ের পরস্পর দূরত্ব ও বিরােধ জীবনকে শুধু বিষিয়েই তােলে না, বরং পর্যদস্তু ও বিপর্যস্ত করে ছাড়ে। করে ছাড়ে বিষন্ন ও ধ্বংস।
মূলত মানব জীবনের এই পূর্ণতা, হৃদয় বদনের ফলবান এই সমন্বয়ের কাঙ্খিত লক্ষ্যেই দাম্পত্য জীবনের আয়ােজন। কারণ, এই মানব জীবনের প্রতিটি সত্তার যেমন ভেতর-বাহির দু’টি পিঠ আছে, তেমনি সমাজ জীবনেরও ভেতর বাহির দু'টি পিঠ রয়েছে। এর একটি নর, অপরটি নারী। দুয়ের সুশৃঙ্খল সমন্বিত ফসলই যুগ-যুগান্তরে এই মানব-সভ্যতা, মানব-সংসার।
মানব জীবনে প্রতিটি পুরুষ সকাল-সন্ধ্যা যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি বিলিয়ে যায় শরীরের আহার সন্ধানে, ধর্মপ্রাণ সেই পুরুষই আবার তার এই সুখ-স্বপ্ন ও কল্পনার পূর্ণতা খুঁজে ফিরে কোন মমতাময়ী নারীর কোমল পরশে। অস্থির হয়ে পড়ে সে এমন কোন ঠিকানার সন্ধানে যেখানে সমর্পিত হবে তার হৃদয়, স্বপ্ন, ভাবনা ও জীবনের বাঁকে বাঁকে লালিত গচ্ছিত যত কথা!
একইভাবে শারীরিক কোমলতায় নমিত নারীদেহ জীবন ও জীবিকার অনিবার্য প্রয়ােজনে যেমন পরম বিশ্বাসে ভরসা পেতে চায় কোন সক্ষম হৃদয়বান পুরুষের উপর, তেমনি তার কোমল বদন মন স্বপ্ন অনুভব সদা খুঁজে ফিরে এমন এক উর্বর ফসলী মাঠ, হৃদয়ের সকল মমতা প্রেম ও মাধুর্য ঢেলে যেখানে ফলাবে মানবতার সােনার ফসল।
আর এই দুই সন্ধান, দুই স্বপ্ন ও দুই প্রেরণার সমন্বিত রূপই হলাে আদর্শ দাম্পত্য জীবন। সুবাসিত এই মহৎ দাম্পত্যের সূচনা হয়েছে সৃষ্টির সূচনা থেকেই। তাই ইতিহাসের প্রথম মানবমানবী প্রথম দম্পতিও।
তারা অপরূপ বেহেশতে যেমন পরস্পর পাশাপাশি ছিলেন পাপদগ্ধ এই ঘাত-প্রতিঘাতের দুনিয়াতেও ছিলেন একে অপরের সঙ্গীজীবনসঙ্গী। তারা একে অন্যের অংশীদার প্রাপ্তিতে বঞ্চনায়, সুখে-দুঃখে এবং স্বপ্ন ও নির্মাণে জীবনের সকল ক্ষেত্রে।
হযরত আদম আ. ও মা হাওয়া আ. হলেন প্রথম মানব-মানবী এবং মানবতার প্রথম মডেল। দাম্পত্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েই তারা এই মাটির পৃথিবীতে আগমন করেছেন, যাতে করে কিয়ামত পর্যন্ত আগতব্য প্রতিটি আদম সন্তান জীবনের পূর্ণতা অনুসন্ধান করে দাম্পত্যের মাঝেই। সম্ভবত এ কারণেই হযরত আদম আ.-এর সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান কুল মানবতার অহংকার।
হযরত মুহাম্মাদ আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বিয়ে আমার সুন্নত, আমার আদর্শ। আর বলেছেন, যে বিয়ে করল সে যেন দীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করল। অধিকন্তু বলেছেন, ইসলামে কোন বৈরাগ্যতা নেই।
এসব বাণী থেকে এ কথাই প্রতিভাত হয়, ইসলাম নারী-পুরুষের স্বভাবজাত চাহিদা, মানব-মানবীর সুখময় ফলময় বন্ধনকে শুধু সমর্থনই করে না, উৎসাহিত এবং উৎসাহিত করেই ক্ষান্ত হয়নি। সেই বন্ধনকে প্রতিষ্ঠিত রাখার যাবতীয় কৌশল এবং পথও বাতলে দিয়েছে অতীব যত্নের সাথে।
দুর্বল নারীর শারীরিক যত্ন, কোমল হাত ও মনের যথার্থ লালনের দিকে তাকিয়ে কামাই-রােজগার, সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ কঠোর সকল কর্তব্য এই বলে বলবান পুরুষের কাধে তুলে দিয়েছে- “আর রিজাল কাওয়ামূনা আলান নিসা” অর্থাৎ পুরুষরাই নারীর কর্তা।
অভিমানী নারীর মখমল-হৃদয় ও সােহাগী বাকামী যাতে হারিয়ে না যায় মানব বাগিচা থেকে সে জন্য পুরুষকে সতর্ক করা হয়েছে এই ভাষায়- “ওয়া 'আশিরহুন্না বিল মারূফ” অর্থাৎ তাদের সাথে উত্তমরূপে জীবনযাপন কর।
আরাে ইরশাদ হয়েছে- যদি তাদের মাঝে মন্দ কিছু দেখ, তাহলে তার অতীত কল্যাণের কথাটিও স্মরণ কর। | পক্ষান্তরে নারীকে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, রমযানের রােযা রাখবে,চরিত্রকে পবিত্র রাখবে এবং স্বামীর আনুগত্য করবে, সে বেহেশতের যে দরােজা দিয়ে খুশি প্রবেশ করবে। [আবু নাঈম]
অন্য হাদীসে আছে, পুরুষের উপর সবচেয়ে বড় হক তার মায়ের আর নারীর উপর সবচেয়ে বড় হক তার স্বামীর।
পশু ও মানুষের মধ্যে অন্যতম মৌলিক পার্থক্য হলাে, পশুদের দাম্পত্য জীবন নেই, মানুষের আছে। যৌনক্ষুধা পূরণের ক্ষেত্রে পশুদের কোন বিধিনিষেধ নেই, মানুষের আছে। আর এ কারণেই শয়তান সর্বোচ্চ মনােযােগসহ তৎপরতা চালায় এই দাম্পত্যের বাঁধ ভাঙ্গার পেছনে। তার কারণ, মানুষের জীবন থেকে এই বাঁধনটি আলগা করে ফেলতে পারলেই তাদের আর পশুদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। ফলে মানুষের সমাজ আর বন্য পশুদের সমাজ হবে একাকার।
সংসার ভাঙ্গার এই বিনাশী পয়গাম নিয়েই আজ দ্বারে দ্বারে ঘুরছে সেবার ক্যাপ মাথায় দিয়ে শয়তানের ভারবাহী এনজিওগুলাে। নারীকে স্বনির্ভরতার নেশা খাইয়ে এক স্বামী থেকে আলাদা করিয়ে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে শত স্বামীর (পরপুরুষ) মাঝে। ফলে ভাংছে ঘর, ভাংছে সংসার।
অতঃপর দাজ্জাল বৃটিশী আইনের পেছনের দরােজা দিয়ে অসহায় সন্তানের দোহাই দিয়ে ফিরে যাচ্ছে আবার পূর্বের স্বামীর ঘরে। রিপুর তাপে গলে যাচ্ছে স্বামীও। শুরু হচ্ছে নতুন করে ব্যভিচারের পথে নিয়মিত যাত্রা।
আল্লাহর বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের এই ভয়াবহ অপরাধের বিষফল আজকে এসিড, খুন, যৌতুক, নিপীড়ন ও তালাকের পৃথিবী! পাপের এই রাজ্য একান্তই প্রিয় শয়তানের এবং শয়তানের চামুন্ডদের। আজ সত্যিকারের মানুষরা যেখানে বন্দী।
মানব-মানবীর এই কাঙ্খিত বন্ধনকে ধরে রাখতে হলে প্রথমেই যে বিষয়টি স্থির করে নিতে হবে, তাহলাে- তারা পরস্পরে একে অপরের বন্ধু । জীবনবন্ধু- প্রতিপক্ষ নয়। আর বন্ধুত্বের প্রধান দাবী হলাে পস্পরকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা, একে অন্যের মন, চাহিদা, স্বপ্ন ও অনুভূতিকে প্রাণ খুলে বুঝতে চেষ্টা করা।
অতঃপর প্রিয় সঙ্গীর মন স্বপ্ন অনুভব ও ভাল লাগাকে নিজের কামনা ও ভাল লাগার উপর প্রাধান্য দেয়া। মূলত প্রাণের, ভাল লাগার ও ভাল লাগাকে উপলব্ধি করার এই অন্তরঙ্গতাই তাে দাম্পত্য জীবনের মহান সুখ ও স্বার্থকতা- যেখানে এসে স্বপ্নে, চাহিদায়, প্রাপ্তিতে, ভাবনায়, বঞ্চনায় একাকার হয়ে যাবে দুটি মন, দুটি তনু, অনুভূতির দুটি স্বতন্ত্র পৃথিবী!
অতএব, যে স্বামী কিংবা স্ত্রী তার জীবন বন্ধুর অন্তরে হাত দিয়ে তার অনুভূতিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না; পাঠ করতে চায় না তার ভাল লাগার কথকথা কিংবা পড়ার চেষ্টা করে না তার হৃদয়ের আকাশে অংকিত অব্যক্ত প্রেমের কাব্য সে প্রকৃত অর্থে স্বার্থক স্বামী কিংবা স্ত্রী নয় বরং মানব সংসারের একেকটি নিপ্রাণ যন্ত্রাংশ মাত্র।
সার কথা হলাে, মানব সভ্যতার লালন ও মানবতার বিকাশ উৎস মধুময় দাম্পত্য জীবনকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে হলে কয়েকটি টিপস সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে। যথা-
১. স্বামীকে সর্বদাই মনে রাখতে হবে, তার স্ত্রী তার জীবনসঙ্গীনী, হৃদয়, মন ও স্বপ্নের সমর্পিত ঠিকানা। সে আদৌ তার সেবকিা নয়। তাই তার মন ও অনুভূতিকে বুঝতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাকে সম্মানের সাথে অবস্থানের সুযােগ দিতে হবে।
২. স্ত্রীকেও মনে রাখতে হবে, তার স্বামীই তার মাথার তাজ। সংসারের কর্তা স্বামী! শরীয়ত সম্মত সকল ক্ষেত্রেই তার কথা মাথা পেতে নেবে। প্রতিবাদে নয়, সমর্পণের যাদুর ছোঁয়ায় স্বামীকে স্বীয় হৃদয়ের কোঠায় ধরে। রাখতে হবে।
৩. পরস্পরের সম্পর্ক হবে ভালবাসার সূতােয় গাঁথা, আইনের শৃঙ্খলে বন্দী নয়।
৪. যৌথ সংসারের ক্ষেত্রে স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনের সংরক্ষণ স্বামীর কর্তব্য। গীবত, কথায় কথায় অভিযােগ ও ত্রুটি সন্ধানের পথকে কঠোরভাবে রােধ করতে হবে স্বামীকেই।
৫. কখনাে পরস্পরে দূরত্ব সৃষ্টি হলে, প্রেমের পিঠে অবাঞ্ছিত বরফ জমে ওঠলে তা নিজেদেরই সরাতে হবে প্রেমের পরশ বুলিয়ে। অতীত সম্পর্ক ও সামাজিক মর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে উভয়কেই। তাহলে সমস্যাকে জয় করা সহজ হবে।
৬. উভয়কেই নামায-রােযা কুরআন তিলাওয়াতসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান মেনে চলতে সচেষ্ট হতে হবে। সােনা-গয়না অর্থ-বিত্ত আর পার্থিব লাভ-লােকসানের আলােচনার পরিবর্তে ঘরে ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। নিশ্চয়ই শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণই মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও কল্যাণ পথের সন্ধান দিতে পারে, অন্য কিছু নয়।
লেখক: গবেষক আলেম ও মুহাদ্দিস