আমিন আশরাফ ছড়া মানে ঝরেপড়া মচমচে পাতার বন। চপলা-চঞ্চলা তরুণীর বেণী দোলানো বাঁধাহীন ছুটোছুটি। পায়েল পরা মেয়ের দড়িখেলা ছন্দ।
ঘর থেকে ওঘরে ছুটে ফেরা পুতুলের হৃদয় জাগিয়ে তোলা হাসি। কানের ভেতর আটকে না পড়া ঝর্ণার বিরামহীন ছলাৎ ছলাৎ সংগীত।
খই ফোটানো দুপুরে আচমকা নূপুরের নিক্বণতোলা টিনের চালের ছন্দতোলা বৃষ্টি। আকাশের গর্জনে হঠাৎ শিউরে ওঠা লাজুক শিশুর বিরতিহীন ঝংকার দেওয়া হাসি।
না-না ছড়া শুধু কানে আরাম উসকে দেওয়া কিছু মোহনীয় শব্দ না। ছড়ায় অনেক কিছু আছে। মুক্তির গান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাদ-প্রতিবাদ, আছে দ্রোহ, প্রেম, ভালোবাসা ও বিধাতার উপাসনা।
ছড়াতেও স্মৃতি, কৃতি ও সুফিপ্রেম। ছড়ায় আছে অনেক কিছু। যা বহুবার ছড়াকাররা প্রমাণ করেছেন। নতুন করে তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন সময়ের তরুণ আইডল মাসউদুল কাদির।
তার প্রকাশিত ‘একটি রঙিন ভোর’ সময়ের নতুন আলোকবর্তিকা। যাতে আছে সন্তানের পথ চেয়ে বাবার আকুতিভরা চোখ, নিজেকে গড়ে তোলার উদ্যমী কথামালা, আষাঢ়ের গান, বাতাসের পঙক্তিমালা। আছে বৃষ্টির ছন্দ, দোয়েলের ঘোরলাগা ছান্দসিক বয়ান, বোশেখের প্রাণ, ঝড়ো বাতাসের ভেঙে যাওয়া গাছ ও সমাজের গল্প।
আছে ভরদুপুরে ছন্দমেঘ, রোদপোড়া কাঁচা আমের ভর্তা খাওয়ার ছন্দ। আছে বাদল দিন, দৃষ্টির সৃষ্টিতে কৃষ্টিখেলার মোহনীয় নৃত্য। রোজা রাখা খুকুর উপোস করা ছবি। যেমন তিনি লেখেছেনÑ ‘সারাদিন উপুসে/সন্ধ্যাতে চুপুসে/ইফতার খাওয়া/গোগ্রাসে গজলে/আল্লাহর ফজলে/গুণগুণ গাওয়া।’
তার ছড়ায় আছে নগরজীবনে বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠা জ্যামের প্রোমোগ্রাফিও ‘থমকে আছে গাড়ির বহর/থমকে আছে ফেরি/সময়মতো হয় না কিছুই/সবকাজে আজ দেরি।’ সমাজ জীবনের মানুষের কষ্টতে তার দুঃখছোঁয়া চোখেও এসেছে টলটলে পানি। তিনি লেখেন ‘একটা ছড়া লিখতে গিয়েই/বার্ন ইউনিটের কাতরানো/আর পারি না সহ্য করে/ধ্বংসযজ্ঞ সাঁতরানো।’
শুধু ছড়াই তিনি লেখেননি, দিয়েছেন কিছু চমৎকার উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সঠিক ও প্রায়োগিক অন্ত্যমিলও। যেমন তার অন্ত্যমিল মিচির/লিচির, কাতরানো/সাঁতরানো, ভরকরে/ডরকরে, সুদিন/ফুঁদিন, আটকে/কাটকে। রমজান/ কম যান।
ছড়ার জন্যই তিনি কেবল একটি রঙিন ভোরকে মলাটবদ্ধ করতে যাননি, তার ছড়ায় স্থান পেয়েছে সমাজজীবনের অনেক বিষয়ের নান্দনিক উপস্থিতি এবং চমৎকার কিছু উপলব্ধি জাগানিয়া আহ্বান।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জঙ্গির বিরুদ্ধে সঙ্গিন উঁচু করার মন্ত্র, দ্রোহময় চেতনার মুক্তিময় যোদ্ধাদের আস্তিন ছড়া ছাড়াও দেশপ্রেমের সাহসী প্রাণেশ্বরও।
এত ভালো কিছুর পরও তার ছড়ার বইয়ে বেশকিছু খামতি রয়ে গেছে। আছে তাড়াহুড়োর ছাপ। একই বিষয়ের বেশকিছু ছড়া আছে এতে। সবমিলিয়ে তিনি ছড়াপ্রেমীদের অসাধারণ কতগুলো ছড়া উপহার দিয়েছেন। নিসা মাহজাবীনের হাত ছুঁয়ে ছড়ার প্রচ্ছদটা হয়ে ওঠেছে জীবন্ত আল্পনা।
একটি রঙিন ভোরই লেখকের প্রথম ছড়ার বই নয়। দুই হাজার দশ সালে প্রকাশ হয়েছিল তার ‘দৃষ্টি থামে সবুজ গ্রামে’ নামের একটি ছড়ার বই। আশা করি দৃষ্টি থামে সবুজ গ্রামের মতো একটি রঙিন ভোরও পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে।
একটি রঙিন ভোর
মাসউদুল কাদির
ধরন: ছড়া
প্রকাশক: সপ্তডিঙা
প্রকাশক: নাফে নজরুল
প্রচ্ছদ : নিসা মাহজাবীন
দাম : ১২০ টাকা
-এটি