শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বিস্ময়কর হাফেজ শিশুর সঙ্গে শায়খ আহমাদুল্লাহ মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর জানাযা ও দাফন সম্পন্ন ১৬ টি বছর জুলুম-ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিল মাদরাসার ছাত্ররা: ড. শামছুল আলম  ‘সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় সংস্কার কমিশন’ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসানের ইন্তেকালে খেলাফত মজলিসের শোকপ্রকাশ কাল ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় রোজায় বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে বিএনপি মহাসচিবের শোক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনসহ যেসব সুপারিশ সংস্কার কমিশনের বাংলাদেশিদের সুখবর দিলো ইতালি, পুনরায় ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত

কায়রো বইমেলা; সাহিত্য সংস্কৃতির অনন্য নজির

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ তাওহীদুল ইসলাম
মাদিতুন নাছর, কায়রো থেকে

মিসরের কায়রোতে গত ২২ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ‘মারিদুল কাহেরা আদদুওয়ালি- ২০১৯’ (কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা)। নিউ কায়রোর আততাজাম্মুউল খামিস সিটিতে আল-হাইয়াতুল আম্মাহ আলমিসরিয়্যাহ লিল কিতাব (জেনারেল মিসরীয় বুক অর্গনাইজেশন) কর্তৃকআয়োজিত এ বছরের মেলা চলবে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

আরব বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম এই বইমেলার এবার চলছে ৫০ পর্ব। এ উপলক্ষে পালিত হচ্ছে আল-ইউবিল আযযাহাবী (GOLDEN JIBILEE)। প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আসসিসি এই মেলার উদ্বোধন করেন।

মেলার বেশ কয়েকটি স্টল পরিদর্শন করেন ৷ এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিসরের ইমামুল আকবার শায়খুল আযহার আহমাদ তায়্যিব ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ডা. ইনাস আব্দুদ দায়েমসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ৷

মেলা প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে ৷ এ বছর মেলায় প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ মিসরি পাউন্ড ৷ এছাড়াও বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে প্রবেশের বিশেষ কার্ড ৷

আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে ১৯৬৯ সালে কায়রো শহরের সহস্রাব্দপূর্ত অনুষ্ঠানে তৎকালিন সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ডা. ছারওয়াত ওকাশী (১৯২১-২০১২) কায়রোর এই বইমেলা প্রবর্তন করেন এবং বইমেলার সর্বপ্রথম পর্বের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত লেখিকা ডা. সুহির আলকালমাভী (১৯১১-১৯৯৭)৷

এবারের বইমেলাটি এই মহান ব্যক্তিদ্বয়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে ৷ আর স্পন্সর হিসেবে রয়েছে জামিয়াতু দুয়ালিল আরাবিয়্যাহ (আরব রাষ্ট্র লীগ) ৷

মেলার স্থান: সূচনা পর প্রথম বছর এই মেলার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল গীজা শহরে ৷ তারপর ধারাবাহিকভাবে একাধারে ৪৮বছর এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে মাদীনাতুন নাসরের কায়রো ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার গ্রাউন্ডসে।

তবে এ বছর সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে মারকাযু মিসর লিল মা‘আরিদিদ্দাওলিয়্যাহ
(Egypt International Exhibition Center) তে ৷

সদ্য নির্মিত মনোরম এই স্থায়ী স্থাপনাটি শহরের ব্যস্ততম এলাকার বাইরে নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত ৷ চারটি বিশাল সুুউচ্চ হলরুম নিয়ে অবস্থিত এই সেন্টারটি ৷ এর প্রদর্শনী এলাকা আয়তন ৪৫০০০ বর্গমিটার ৷

হলের বাইরে বিশাল চত্তর ও দর্শনার্থীদের উভভোগ করার জন্য রয়েছে মুগ্ধকর ফুলের বাগান ৷ বাহারি রংঙ্গের ফুলগুলো যেন বইপ্রেমী মানুষদের স্বাগত জানাচ্ছে ৷ চত্তরের মাঝখানে পানির ফোয়ারা মেলার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে ৷ দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য চত্তরের অস্থায়ী ছায়াদ্বার বিশাল বিশাল ছাতা ৷

এ ছাড়াও গাড়ি পাকিং এর জন্য বিশাল আয়তনের এরিয়া জুড়ে সুব্যবস্থা ৷

মেলার স্টল: চারটি বিশাল হলেরুমে আয়োজিত এ মেলায় মোট রয়েছে মোট ৭২৩ টি স্টল ৷ চোখ ধাঁধানো আলোয় আলোকিত এসব হলরুমের মেঝেতে বিছানো হয়েছে উন্নতমানের লাল গালিচা ৷ কাংখিত লাইব্রেরিকে সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রতিটি হলরুমকে সূবিন্যাস্ত করা হয়েছে A B C D সিরিয়ালে ৷

প্রতিটি সিরিয়ালের অধিনে রয়েছে অর্ধশতকের অধিক স্টল ৷ রয়েছে প্রতিটি হলের সামনে রয়েছে গোটা হলের বিস্তারিত নকশা ৷ হলের মাঝে মাঝে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র ৷

মেলা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ বছর আফ্রিকা থেকে ১০টি, এশিয়া থেকে ১৬ টি, ইউরোপ ৭ আমেরিকা থেকে ২ মোট থেকে ৩৫ টি রাষ্ট্রের সাতশতাধিক প্রকাশনী মেলায় অংশ গ্রহণ করেছে ৷ এর মাঝে ৫৭৯ টি মিশরীয় প্রকাশনার ও ১৭০ বিদেশী প্রকাশনী ৷

বিশেষ আকর্ষণ: দুই সাপ্তাহব্যাপী এই মেলায় বুকস্টলের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট প্যাভিলিয়ন ৷ মেলায় আগত দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব প্যাভিলিয়নে থাকে বর্ণাঢ্য সাজ ৷ এসব প্যাভিলিয়নে পরিচালনারত ব্যক্তিরা নিজ দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও পরিচিতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিদিন বিভিন্ন কর্মশালী পালন করে থাকে ৷

সৌদি আরবের প্যাভিলিয়ন প্রতিবছরের মতো এবারও ছিল জাঁকজমকপূর্ণ সুসজ্জিত ৷ বই ক্রয় ও বই পাঠ করার পাশাপাশি মেলায় আগত দর্শনার্থী এসব প্যাভিলিয়নগুলো পরিদর্শন করে অর্জন করে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ৷

এছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ও সংস্থার প্রদর্শনী স্টল ৷ এ সব স্টলে বিভিন্ন প্রকাশনা ও ঐতিহাসিক জিনিসের প্রদর্শনী করা হয় ৷

হলরুমগুলের মাঝে মাঝে রয়েছে নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ওযু-ইস্তেনজাখানা এবং মনোরম নামাযের স্থান ৷ মেলা চলাকালীন প্রতি নামাযের জন্য সুমুধুর সুরে পরিবেশন করা হয় আযান ৷ আযানের পরপরই নামাযের স্থানগুলোতে শুরু হয়ে যায় নামাযীদের উপচে পড়া ভিড় ৷

মেলায় আগত দর্শনার্থীদের ক্ষুদা ও ক্লান্তি নিবারনের জন্য রয়েছে হলরুমের বাহিরেও ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো অভিজাত রেস্টুরেন্ট ৷ সেখানে রয়েছে মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থাপনা ৷

নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গ্রন্থমেলায় মানুষ যাতে নিরাপদে আসতে পারেন সেজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করা হয়। ভারি অস্ত্রধারী সেনা সদস্য, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যগন নিরাপত্তাসহ মেলা পর্যবেক্ষণ কাজে সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছেন৷

জ্ঞান-বিজ্ঞানের শহর কায়রোর ঐতিহ্যমন্ডিন এই বইমেলা যুগ যুগ ধরে মানুষের জ্ঞানচর্চা ও আহরণে যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে কবি, সাহিত্যিক, লেখক গবেষক।

বই কেনা আর বই পড়ার অভ্যাস অগণিত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তা-ই নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূবনকে বিকশিত করতে বিশাল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এই গ্রন্থমেলা ৷

শিক্ষা সংস্কৃতিকে রক্ষার লক্ষে প্রবর্তিত এই মেলা ৫০ বছর ধরে মিসরের শিক্ষা সংস্কৃতি উন্নয়ন ও রক্ষায় অসামান্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে ৷ তাই ৫০তম এই বই মেলার বিশেষ স্লোগান রাখা হয়েছে ‘খমসূনা আ‘মান মিনাছ ছাকাফাহ’ সংস্কৃতিময় পঞ্চাশ বছর ৷

এই মেলা মিসরের ছোট বড়, নারী-পুরুষ সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের স্পন্দন, মনের আকুতি এবং হৃদয়ের অভিব্যক্তি।

এই গ্রন্থমেলা শুধু বই বেচাকেনার মেলা নয়, এ হচ্ছে শিক্ষা-সংস্কৃতি,ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়ার মেলা৷ তাই সব স্তরের এবং সব বয়সের মানুষের মিলন ঘটে বইমেলায়।

মিসরীদের সংস্কৃতি-বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রন্থমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ মেলা মিসরের সকল মানুষের এক মিলনমেলা এবং জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবও৷

এই মেলাকে কেন্দ্র করে মিসরে সৃজনশীল প্রকাশনা জগতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে পাঠক সমাজ। সাহিত্য ও সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার যারা নিরন্তর সাধক, তাদের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমশ। গ্রন্থমেলাকে উপলক্ষ করে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বইপ্রেমী মানুষেরা আগমন করে এই মেলায়।

মেলায় রয়েছে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা প্যাভিলিয়ন ৷ সেখানে রয়েছে শিশু শিক্ষার বইয়ের অনেকগুলো স্টল ৷ হরেকরকম এই প্যাভিলিয়নে শিশুদের জন্য রয়েছে চিত্ত-বিনোদন, চিত্রাঙ্কন ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন।

বড়দের পাশাপাশি মিসরী শিশুদের উপস্থিতি চেখে পড়ার মত ৷ অভিভাবকদের সঙ্গে প্রচুর মিসরী শিশু মেলায় আসে ৷ এসব শিশুরা উচ্ছ্বসিত চিত্তে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, পুরস্কার গ্রহণ এবং ইচ্ছামতো বুকস্টলে ঘোরা-ফেরার মাধ্যমে আনন্দে মেতে উঠে ৷ তাদের আগমণে প্রতিদিন মেলা নতুন প্রাণে জেগে উঠে ।

কায়রো বইমেলাকে ঘিরে মিসরে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্রদের মধ্যেও সৃষ্টি হয় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। সবাই বছর ব্যাপী গুণতে থাকে এই মেলা শুরুর অপেক্ষার প্রহর ৷ দুষ্প্রাপ্ত ও স্বল্পমূল্যে অধিক কিতাব সংগ্রহ করার অপূর্ব সুযোগ এই মেলা ৷

বইপ্রেমীরা নিজের সাধ্যের সবটুকু অর্থ ব্যয় করে ক্রয় করে থাকে নিজের পসন্দের হরেক রকম বই ৷ বছরের অর্ধ-অবকাশে আয়োজিত এ মেলার সময়কে মিসরীদের মত তারাও কিতাব কেনার মৌসুম বলে অভিহিত করে থাকে ৷

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ