শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সিলেটের আলেম জনতা মেয়র সাংসদ, জলে ভেজা সবার চোখ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রোকন রাইয়ান ।।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর, সিলেট কাজির বাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে বেলা সাড়ে ৩ টায় তার জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন মরহুমের দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা ইউসুফ।

জানাজা শেষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কাজির বাজার জামেয়ার বাগানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

জানাজা উপলক্ষ্যে জুমার নামাজের পর থেকেই হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে আলিয়া মাদরাসা মাঠে। একসময় মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তাও লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এসময় প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানের জন্য চোখের জল ফেলতে দেখা যায় উপস্থিত জনতাকে।

এর আগে বেলা আড়াইটা থেকে তার লাশ সামনে রেখে বক্তব্য দেন আলেম উলামা, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ সেবক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

গুণি এ রাজনীতিককে এক নজর দেখতে সিলেটের সাধারণ জনতার পাশাপাশি ছুটে আসেন সিলেটের মেয়র, সাবেক মেয়র, সংসদস্য সদস্য ও শীর্ষ রাজনীতিবিদগণ। সবার চেহারায় ছিল বিষাদ ও চোখে ছিল কান্না।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটে নিজ বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন বলে জানা গেছে। মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, চার ছেলে, তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।

জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সিলেট মেয়র আরিফুল হক বলেন, আজ জুমার দিনে আমরা হারিয়েছি দেশ বরেণ্য এক ইসলামি চিন্তাবিদকে। কাজির বাজার মাদরাসার অধ্যক্ষ প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানকে যিনি সিলেটের তৌহিদি জনতার অন্যতম নেতা।

তার সঙ্গে আমি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। একসঙ্গে কারাবরণও করেছি। আজ তিনি চলে গেলেন। প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান যে তৌহিদী জনতার শীর্ষ নেতা ছিলেন তার প্রমাণ আজকের লক্ষাধিক মানুষের জানাজা।

আমি আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ জানাচ্ছি যেন তিনি তাকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করেন।

সিলেটের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের নেতা বদরুদ্দীন আহমদ কামরান বলেন, মাওলানা হাবীবুর রহমান সারা জীবন ইসলামের জন্য কাজ করেছেন।

তার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি যখন একটি মসজিদে ইমাম ছিলেন তখন থেকে আজকের প্রিন্সিপাল হাবীব পর্যন্ত আমার সুসম্পর্ক।

তিনি শুধু একজন ইমাম বা আলেম ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ রাজনীতিক। সিলেটের মাটিতে যখনই কোনো অন্যায় কাজ শুরু হয়েছে তিনি ঝাপিয়ে পড়েছেন। আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।

জাতীয় পার্টির সংসদস সদস্য এহইয়া চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের অগ্রদূত আজ বিদায় নিয়েছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত আজ। তিনি ছিলেন আমাদের মুরুব্বি, আমাদের পরিবারেরও পরামর্শক।

সিলেটে এক সময় স্লোগান দেয়া হতো, বীর মুজাহিদ প্রিন্সিপাল বেঁচে থেকো চিরকাল। আজ তিনি আমাদের শূন্য করে চলে গেলেন। সিলেটবাসীকে এতিম করে গেলেন।

সিলেটে সব সময় দেখেছি যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে তাকে সামনে থেকে প্রতিবাদ করতে। আজ থেকে আর তাকে আমরা দেখবো না। আল্লাহ যেন তাকে কবুল করেন।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারী বলেন, আজ আমরা বীর মুজাহিদ প্রিন্সিপালের জানাজায় হাজির হয়েছি।

যিনি কেবল একজন আলেম নন, একটি বড় প্রতিষ্ঠান। যার আন্দোলনে বাতিল পালিয়েছে, নাস্তিক তসলিমা ও দাউদ হায়দার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তার কাজ আমরা চালিয়ে নেয়ার জন্য শপথ নিচ্ছি।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী বলেন, আমি সর্বপ্রথম খলিফায়ে মাদানী জমিয়তের সভাপতি আল্লামা আবদুল মোমিনের পক্ষ থেকে শোক বার্তা জানাচ্ছি। তিনি প্রিন্সিপাল হাবীবের জন্য দুয়া করেছেন যেন আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করেন।

আমরা সারাজীবন দেখেছি, বাতিল যখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সাথে সাথে মাঠে নেমেছেন আল্লামা প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান। তার কারণে বাতেল কোণঠাসা হয়েছে। আল্লাহ যেন আমাদেরকে তার কাজ করার তৌফিক দেন।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, আল্লামা প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানের লাশ সামনে রেখে আজ আমি এটুকু বলতে চাই, ইসলামী নেতৃত্বের জন্য তিনি নির্লোভে কাজ করেছেন।

আজ আমরা বহু নেতাকে চারদিকে দেখি কিন্তু তার মতো এমন নির্ভিক ও নির্লোভ লোক কম দেখি। তার গুণগুলো আমাদের অর্জন করতে হবে।

আজ আমরা শোকাহত, ব্যথিত কিন্তু আমাদের ব্যথিত হলে চলবে না। ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোনো কাজে আমাদেরকে তার মতো ঢাল হিসেবে রুখে দাঁড়াতে হবে।

তিনি কাজির বাজার মাদরাসা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মতো যে সমস্ত আমানত রেখে গেছেন তা রক্ষা করতে হবে। তাহলেই তার আত্মা শান্তি পাবে।

সিলেটের শীর্ষ আলেমে দীন মাওলানা শফিকুল হক আমকুনী বলেন, দুনিয়া থেকে সবাইকে একদিন যেতে হবে। বিদায় নিতে হবে। তার আগে যেন আমাদের আমল ঠিক হয়। আমরা যেন নেক আমল নিয়ে দুনিয়া ছাড়তে পারি। আমাদের যেন আল্লাহ সে তৌফিক দেন।

প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ঘনশ্যাম গ্রামে।

১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বরে এক জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আত্মপ্রকাশ করে। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ইন্তেকালের পর তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির নির্বাচিত হন। নব্বইয়ের দশকে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক খ্যাতি পান।

প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের শিক্ষা জীবনের শুরু হয়েছিল ফুলবাড়ির বইটিকর প্রাইমারী স্কুল থেকে। পরে কিছুদিন রুস্তুমপুর কওমি মাদরাসায় পড়ে ভর্তি হন ফুলবাড়ি আজিজিয়া আলিয়া মাদরাসায়।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ফুলবাড়ি মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ফাজিল এবং ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাশ করেন।

ছাত্র জীবন থেকেই তিনি তার বাবার সূত্রে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর হজরত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) কর্তৃক খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন।

পরে খেলাফত আন্দোলন ছেড়ে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিতি খেলাফত মজলিসে যোগ দিয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুকালে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমিরের দায়িত্বে ছিলেন।

‘আমরা একজন ইসলামি রাজনীতির অভিভাবক হারালাম’

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ