জহির উদ্দিন বাবর
আলেম, সাংবাদিক
চলে গেলেন ‘সিলেটের সিংহপুরুষ’ খ্যাত প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান। আমরা ছোটবেলা থেকে আপাদমস্তক বলিষ্ঠ সংগ্রামী একজন আলেম হিসেবে তাঁকে জেনে আসছি। বিভিন্ন সময় তাঁর বিপ্লবী হুঙ্কার ও সাহসী পদক্ষেপ দেখেছি।
দেখতে সাদাসিধে ও ছোটখাট এই মানুষটি যখন বাঘের মতো হুংকার মেরে উঠতেন তখন বাতিল শক্তিগুলো থরথর করে কেঁপে উঠতো। তাঁর সেই হুঙ্কার প্রতিটি ঈমানি চেতনায় ছড়িয়ে দিতো স্পৃহার বারুদ। লাখো জনতাকে উত্তাল করে তোলার ক্যারিশমা জানা ছিল তাঁর। নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল।
আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত সিলেটের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অপেক্ষাকৃত অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড ও অপসংস্কৃতিমুক্ত সিলেট। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান রহ.-এর।
সিলেটের যেকোনো আন্দোলন সফল করতে প্রিন্সিপালের কোনো বিকল্প নেই-সেটা তাঁর সমালোচকরাও স্বীকার করতেন। তাঁর চেতনা ছিল খুবই শাণিত। দীনের সামান্য অপদস্থতা, রাসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরামের বিন্দু পরিমাণ অবমাননা, আলেম-উলামার অবমূল্যায়ন তিনি একদম সইতে পারতেন না। তাঁর এই গুণটির কারণে তিনি সবার চেয়ে অনন্য হয়ে আছেন।
নানা সীমাবদ্ধতা ও পারিপার্শিকতার কারণে হয়ত তিনি শেষ সময়ে আগের মতো সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর হুঙ্কারে কখনও কোনো ঘাটতি আসেনি।
‘তিনি চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন’ সেই ভয়টুকু ছিল বাতিলের ভেতর। এজন্য নানা সময় তাঁকে কিছু করতে হয়নি, হুঙ্কার দিয়েই বাতিলের আস্ফালন থামিয়ে দিয়েছেন। আজ তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই হুঙ্কারের প্রয়োজনটা আমরা খুবই অনুভব করবো।
আগে বিভিন্ন ইস্যুতে দল-মত নির্বিশেষে দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রায়ই একমঞ্চে সমবেত হতেন। সারাদেশের দীনদার মানুষেরা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। সম্মিলিত সেসব সমাবেশে দুজন আলেমের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসত পুরো সমাবেশ।
তাদের নামের সঙ্গেই যেন জড়িয়ে ছিল স্পৃহার বারুদ, প্রতিবাদের স্ফূলিঙ্গ। এই দুজনের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ‘নারায়ে তাকবির’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত চারপাশ। তাদের একজন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ., যাঁকে আমরা হারিয়েছি ২০১২ সালে।
আরেকজন ছিলেন প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান রহ., যাঁকে আমরা আজ হারালাম। হুঙ্কার দিয়ে বাতিলের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়ার মতো এমন সাহসী আলেম আপাত দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না।
একজন মানুষ সবার কাছে সমান পছন্দের হবে না এটাই স্বাভাবিক। আর রাজনীতি করতে গেলে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটিও সমালোচনার শিকার হবেন এটা আরও স্বাভাবিক।
রাজনৈতিক কারণে প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান রহ.-এর সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর ঈমানি চেতনা, নবী ও সাহাবাপ্রেম, বাতিলবিরোধী বলিষ্ঠ ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।
তিনি দীনি অঙ্গনের কত বড় নেয়ামত ছিলেন তা এতদিন আমরা বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারবো। এজন্য প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানদের হারানোর আগেই আসুন কদর করা শিখি।
দুই.
আমরা থানভি-মাদানির যুগ পাইনি। ছদর সাহেব হাফেজ্জি হুজুরদেরও দেখিনি। পরবর্তী সময়ে যাদেরকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাদের দেখেই পূর্ববর্তীদের উঞ্চতা অনুভব করেছি।
কিন্তু আস্তে আস্তে তাদের চলে যাওয়ার মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে দীন ও ঈমানের যারা রক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন নানা সময় একে একে তারা সবাই চলে যাচ্ছেন।
যিনি চলে যান আর ফিরে আসেন না। যে জায়গাটি ফাঁকা করে যান সেই জায়গাটি আর ভরাট হয় না। হয়ত স্বাভাবিক নিয়মে কাউকে না কাউকে সেই চেয়ারটিতে বসানো হয়, কিন্তু পূর্বেরজনের তুলনায় পরেরজনের তফাৎটা থাকে বিস্তর। সেই যোগ্যতা, সেই ইখলাস, সেই ব্যক্তিত্ব, সেই ভূমিকা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
দুনিয়ার নিয়মই হলো নিম্নমুখিতা। রাসুল সা.-এর যুগের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের যুগ তুলনা করলে কিছু ঘাটতি থেকেই যাবে। সাহাবায়ে কেরামের যুগের সঙ্গে পরবর্তী যুগ তুলনা করলে এই ঘাটতির মাত্রা বাড়তেই থাকবে।
কয়েক দশক আগের আলেমদের সঙ্গে বর্তমান সময়ের আলেমদের তুলনা করলে নিশ্চিত হতাশ হতে হবে। কিন্তু ‘নিম্নমুখিতার’ সূত্রটি সামনে রাখলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
আকাবির যারা এখনও আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছেন তাদের নানা সমালোচনা থাকতে পারে। আগেকার বুজুর্গদের সঙ্গে তাদের তুলনা করলে হতাশা আসবেই। কিন্তু শত সমালোচনা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে যে গুণগুলো আছে তা একসময় বিরল হয়ে যাবে।
পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত এখনকার আকাবিরকেই উদাহরণ হিসেবে পেশ করবে। এজন্য বড়দের কোনো সমালোচনা পেলেই হাতে আসমান পাওয়ার মতো হামলে পড়া উচিত নয়।
আজ যাকে আমরা সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করছি তার অনেকগুলো গুণ কিন্তু আছে, যা আমরা সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি। আমাদের সমাজের কালচারই হলো জীবিত থাকতে কাউকে মূল্যায়ন করি না।
তার অবদান ও অবস্থানের কথা অনুধাবন করি মৃত্যুর পর। জীবিত থাকতে যাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি তাকেই মৃত্যুর পর মহীয়ান করে তুলি। এই কালচার পাল্টানো দরকার। আমার মত, বলয় ও দলভুক্ত না হলে তাকে পাত্তা দিতে চাই না।
আবার আমার পক্ষের লোকটির শত দোষও সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি। এতে আকাবিরের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা শুধু বাড়ছেই। এর পরিণতি কখনও শুভ হতে পারে না।
গত এক যুগের মধ্যে এমন অনেকেই চলে গেছেন যারা এদেশের দীনদার মুসলমানদের ঈমান ও আমলের সত্যিকারের পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতেন। তাদের এই চলে যাওয়ায় যে শূন্যতাগুলো সৃষ্টি হয়েছে তা আর পূরণ হয়নি। সেই শূন্যতা কোনোদিন পূরণ করা সম্ভবও নয়।
প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানদের মতো আলেমদের ইন্তেকালকে হাদিসের ভাষায় ‘আলমের’ (জগতের) ইন্তেকাল বলা হয়েছে। ‘আলমের’ ইন্তেকালের শূন্যতা কখনও পূরণ হতে পারে না।
তবে আমরা দোয়া করতে পারি, আল্লাহ চাইলে পূরণ করেও দিতে পারেন। আর এর জন্য আমাদেরও কিছু করণীয় আছে। নেয়ামতের কদর থাকতেই করতে হবে। হারিয়ে যাওয়ার পর নেয়ামতের জন্য মায়াকান্না করে কোনো লাভ নেই। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম